রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’
পর্ব ১১
প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২১
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
হলোফার: তোমরা তাহলে বহু ব্যক্তির শাসন চাও? তা দেশের জন্য মঙ্গল কি অমঙ্গল তাতে তোমাদের কিছু যায় আসে না? কিন্তু এক ব্যক্তির শাসন যদি মঙ্গলজনক হয় তাও তোমরা প্রত্যাখ্যান করবে?
সস্ত্রাতাস: এক ব্যক্তির শাসন কখনো মঙ্গলজনক হতে পারে না।
হলোফার: থিউসের সেনেতোরদের শাসন সম্পর্কে তোমার ধারণা কি এই যে, তারা সর্বদা দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতেন। সেনেতোরদের শাসন মানেই এক ব্যক্তির শাসনের চেয়ে ভালো শাসন?
সস্ত্রাতাস: হ্যাঁ।
হলোফার: তাহলে রোমের জুলিয়াস সীজারের কথা স্মরণ করো। সীজার যখন রোমে দরিদ্র জনগণের পক্ষে কাজ করতে উদ্যোগী হলেন, তখন সেনেতোররাই তাকে হত্যা করেছিল। দাস মালিক ব্রুটাস পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। কারণ সীজার ভাবছিল, দাসপ্রথা তুলে দেয়া যায় কি না। শোনো, সস্ত্রাতাস, সেনেতোররা সব সময় নিজেদের আভিজাত্য এবং স্বার্থ সংরক্ষণের কাজেই ব্যস্ত। সেজন্য আমি সেনেতোরদের ক্ষমতা খর্ব করে রাজার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।
সস্ত্রাতাস: কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর আপনি কী করলেন? সারাদেশ এখন দুর্নীতি আর উৎকোচ গ্রহণের আখড়া হয়ে উঠেছে। তারা এক হাতে উৎকোচ গ্রহণ করে আর মুখে আওড়ায় দেবতা জিউসের নাম।
হলোফার: আমার চারপাশের সুবিধাভোগী লোকগুলো, যারা আমার নিযুক্তিপত্র পেয়ে নিজেদের বিত্তশালী করেছে, তাদের জন্য আমার এই নিন্দাবাদ।
সস্ত্রাতাস: কিন্তু আপনি নিজেকেই বা রক্ষা করতে চাইছেন কেন? ক্ষমতায় এসেই আপনি সাধারণ নাগরিকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ফিলোটাসের সময় সাধারণ নাগরিকদের বিনামূল্যে রুটি প্রদান করা হতো। আপনি ক্ষমতায় এসেই সে রুটির পরিমাণ অর্ধেক করে দিয়েছেন।
হলোফার: তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে দেশের সকল তরুণরা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে চরম ভুল তথ্য পায়। এবং সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ তাদের নেই।
সস্ত্রাতাস: এ কথা আপনি কেন বলছেন?
হলোফার: তাহলে শোনো, কেন আমি রুটির পরিমাণ অর্ধেক করে দিয়েছি। থিউসে যে সংখ্যক সাধারণ নাগরিক রয়েছে, তার চেয়েও দ্বিগুণ নাগরিকদের জন্য রুটি তৈরি করার বার্ষিক বরাদ্দ ছিল। এই বাড়তি নাগরিকদের নাম করে রাজপুরুষরা রাজকোষ থেকে প্রয়োজনের দ্বিগুণ অর্থ নিয়ে যেতো। আর এই উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের নিজেদের পকেটে ভরতো। সে কারণেই আমি এ বরাদ্দ অর্ধেক করে দেই। এতে করে রাজকর্মচারীদের অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারাই এখন আমার বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলছে।
সস্ত্রাতাস: তাহলে সে সব দুর্নীতিপরায়ণদের বিচার হচ্ছে না কেন? দেশপ্রেমিককে যেখানে রাজার বিরুদ্ধে বলার জন্য হত্যা করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে এসব দুর্নীতিবাজরা ক্ষমা পাচ্ছে কি করে?
হলোফার: ক্ষমা না করে উপায় কি? দেখা যাবে সে দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রের উচ্চক্ষমতায় আসীন কারো না কারোর ভ্রাতা বা পুত্র। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলে সমস্ত রাজপুরুষ আমার বিরুদ্ধে চলে যাবে।। তখন দেশের জনগণও তাদের নেতৃত্বে আমার বিরুদ্ধেই দাঁড়াবে। এই হচ্ছে অশিক্ষিত নাগরিকদের সমস্যা, এরা কোনো কিছু ভালো করে বিচার করে দেখবে না। যার তার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে বসবে। জনতার মনে ক্ষোভ আছে, জনতার ত্যাগ-তিতিক্ষা আছে, কিন্তু বিচার বুদ্ধি করবার ক্ষমতা নেই। খুব অন্ধভাবে তারা নেতাকে বিশ্বাস করে, ঠিক যেমন অন্ধভাবে বিশ্বাস করে দেবতাদের। জানতে চাইবে না কখনো, সেই নেতার আসল চরিত্রটি কী। [কিছুটা থেমে] নিশ্চয়ই রাজপুরুষরা দুর্নীতিবাজ, সেটাও কখোনই আমি অস্বীকার করি না ।
জোকাস্তা: বহু যুবক রাজপুরুষদের এই সব দুর্নীতি নিয়ে চমৎকার চমৎকার কবিতা ও প্রহসন লিখেছে।
হলোফার: হায়! এ সব যুবকদের সম্পর্কেও আমার ভালো জানা আছে। এই মুহূর্তে হয়তো এরা কয়েকজন সরকারি কর্মচারীর ব্যক্তিগত চরিত্রের বিরুদ্ধে সরব বিদ্রপ করছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে সে নিজেই ব্যক্তিগত স্বার্থে ভিন্ন এক দুর্নীতির সাথে হাত মিলিয়েছে। কিংবা অন্য কোনো লোকের ওপর অন্যায়ভাবে আঘাত করে বসেছে। সত্যি বলতে কি, এ সব যুবকরা শুধু অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু নিজেদের ত্রুটিগুলো দেখতে পায় না।
সস্ত্রাতাস: কিন্তু সব যুবককে এক করে দেখলে হবে না। প্রচুর যুবক নিজ স্বার্থ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই কলম ধরেছে। তাদের রচনা নিশ্চয় আপনার পড়বার সুযোগ আসেনি।
হলোফার: বহু যুবক এবং কবি, এমনকি তুমি নিজেও আমাকে নিয়ে বেশ কিছু ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছো। সেগুলো তীব্র অশালীনও বটে। কিন্তু যুক্তি আছে সামান্য। দু-একটা ছাড়া বাকিগুলো নানা রকম অশ্লীল শব্দে রচিত।
জোকাস্তা: যুবকরা কেন আপনার বিরুদ্ধে অশালীন কবিতা লেখে, সেটা আপনাকে বুঝতে হবে। আপনার শাসন সর্বত্র এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যুবকদের রচনায় সে অস্থিরতাই ধরা পড়েছে।
হলোফার: প্রিয় জোকাস্তা, অনেকদিন হতেই এ রাষ্ট্র নানা রকম দুর্গতি ভোগ করে আসছে এবং তেমনি একটি পর্যায়ে আমি রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করি। এবং এ কথা মোটেও মিথ্যা নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য আমি নিজেও এ রাজ্যের উপর সবচেয়ে বেশি দুর্গতির বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি।
সস্ত্রাতাস: কিন্তু এর জন্য শুধু আত্মসমালোচনা করেই আপনি রেহাই পেতে পারেন না। আপনার রাজপুরুষরা রাষ্ট্রের তহবিল আত্মসাৎ করে নিজেদের বিত্তশালী করে তুলছে। অথচ আপনি সেটা জেনেও কোনো প্রতিকার গ্রহণের ব্যবস্থা নেননি।
হলোফার: যুবক, একটা দেশ শাসন করতে সহজাত যে সব অসুবিধা আছে আমাকে তাহলে সেগুলো তোমার সামনে স্পষ্ট করে তুলতে হবে। তোমাকে বোঝাতে হবে, এ ব্যাপারে একজন শাসককে কী পরিমাণ আপোষ করতে হয় যোগ্য লোকদের লোভের সঙ্গে, অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে, এমনকি প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে।
সস্ত্রাতাস: যখন একজন শাসক ন্যায়নীতি না মেনে ক্ষমতায় আসে, তখনই সে এ সব করতে বাধ্য হয়। ঠিক সেই কারণেই আপনি ভূমিবণ্টনের সময় সৈন্যদের অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছিলেন।
হলোফার: সস্ত্রাতাস, আমি জানি সেটা অন্যায়। কিন্তু আমি আর কি করতে পারতাম? জনগণ আমার বিরুদ্ধে। ভালোমন্দ যাই করি না কেন কখনোই জনগণের সমর্থন আমার পেছনে ছিল না। সৈন্যদের ক্ষেপিয়ে তুললে আমি ক্ষমতায় টিকতাম কি করে? সৈন্যদের দাবি মেনে না নিলে ওরাই আমাকে হত্যা করতো।
সস্ত্রাতাস: ঠিক! ঠিক! আর এই সৈন্যদের দিয়েই আপনি সাধারণ জনগণের স্বাধীনতা হরণ করে বসে আছেন।
হলোফার: সস্ত্রাতাস, সাহসী মানুষের কণ্ঠস্বরকে কে স্তব্ধ করতে পারে? যারা সাহসী এবং সৎ তারা কারো কাছ থেকে স্বাধীনতা ভিক্ষা নেয় না। যদিও আমি এ কথা অস্বীকার করছি না যে, থিউসের অধিকাংশ দুগর্তির জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু ভালো কিছু করতে চাইলেও আমি পারতাম না। বিশেষ করে গত কয়েকমাসে প্রতিটি পদক্ষেপে আমার মনে হয়েছে, আমার দুচোখ বাঁধা। আমার ভেতরের মানুষটা যা চায়, তার সামনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকতো-
সস্ত্রাতাস: রাজা, তাহলে কি রাষ্ট্রের জনগণ ক্রমাগতই শাসকদের এ সব দুগর্তির বোঝা বহন করে যাবে? আর শাসকরা নিশ্চিত আরামে নিদ্রা দেবে?
হলোফার: তোমরা যুবকরা যারা আমার বিরোধিতা করছো, তারা বলো কী ভাবে তোমরা এ রাজ্যকে রক্ষা করতে পারো? বলো তোমাদের কী যুক্তি?
সস্ত্রাতাস: গণতন্ত্রই রাষ্ট্রকে রক্ষার একমাত্র পথ। একজন শাসকের খেয়ালকে বাদ দিয়ে বহুজনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। বহুজনের মিলিত চিন্তাই রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে।
হলোফার: বেশি সংখ্যক মানুষের ধারণাই যে সঠিক, এ কথা সত্য নয় সস্ত্রাতাস। পাঁচশত জুরির মধ্যে প্রায় সবাই সক্রেটিসের মৃত্যুর পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেদিন এথেন্সের লোকরা অন্যান্য গ্রিক নাগরিকদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত ছিল কিন্তু আবার কম কুসংস্কারগ্রস্থও ছিল না। সক্রেটিসের শিষ্যরা সেজন্য এথেনীয় গণতন্ত্রকে কখনোই ক্ষমা করেনি। অধিক সংখ্যক লোকের সিদ্ধান্ত কোনো দেশকে রক্ষা করতে পারে না। একটি দেশকে রক্ষা করতে পারে যুক্তি এবং সঠিক চিন্তা। চলবে