রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ৮

প্রকাশিত : জুলাই ৩১, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

(ক্রীতদাসের প্রবেশ)
ক্রীতদাস: প্রভু, একজন যুবক আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। সে সুদূর ক্রীটের গ্রামাঞ্চল থেকে আপনার সাক্ষাৎ লাভের জন্য এসেছে।
ক্রানমার: এখন কোনো যুবকের সাথে আমার দেখা হবে না। দেখতেই পাচ্ছ আমি বন্ধুবর ক্রোনাসের সাথে আলাপরত। যুবককে পরে কখনো আসতে বলো।

ক্রীতদাস: যুবক বহুদূর থেকে এসেছে প্রভু।
ক্রনমার:  সে কথা তো একবার শুনেছি।

ক্রীতদাস: যুবক বলছিল আপনার সাক্ষাৎলাভ তার জন্য খুবই জরুরি।
ক্রানমার: খুবই জরুরি! কেন?

ক্রীতদাস: প্রভু, যুবক বলছিল সে একজন কাচ কারিগর। সম্ভবত সে ব্যাপারে সে কিছু কথা বলতে চায়।
ক্রানমার: কাচ কারিগর। ক্রোনাস, যুবকটির পেশা আমার ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত। যাও, যুবককে পাঠিয়ে দাও। [ক্রীতদাস চলে যায়। ক্রানমার পান করতে করতে] ক্রোনাস, এই এক জায়গায় আমি বড় দুর্বল। বাণিজ্য শুধু আমার কাছে অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়, এটা আমার কাছে এক ধরনের দায়িত্ববোধ। প্রত্যেকের যেমন নিজ নিজ কর্মে সৎ হওয়া দরকার, এক্ষেত্রে আমিও তাই। আমি জানি, তুমি আমার কথাগুলোকে বক্রভাবে দেখছো। কিন্তু যা সত্য তা হলো সৈনিক যেমন তার মহিমাকে উজ্জ্বল করতে চায়, এবং বিজয় লাভের জন্য যেমন সে প্রাণ দিতে দ্বিধা করে না, বাণিজ্য তেমনি আমার কাছে এক প্রিয়কর্ম।

(যুবকের প্রবেশ)
দ্রিমাস: মহান ক্রানমার দীর্ঘজীবী হোন।
ক্রানমার: দীর্ঘজীবী হও যুবক।

দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, আমার নাম দ্রিমাস। ক্রীটের সমুদ্র উপকূলের গ্রামগুলোর একটিতে আমার বাস।
ক্রানমার: বসো যুবক।

দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, আমি একজন কাচ কারিগরের পুত্র। নিজেও পিতৃপেশার সাথে জড়িত।
ক্রানমার: আমার কাছে তোমার কী প্রয়োজন?

দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, আমি আপনাকে আমার এক আবিষ্কারের কথা বলতে এসেছি। পৃথিবীতে এর আগে কেউ তা আবিষ্কার করেছে কিনা আমি জানি না।
ক্রানমার: বলো, কি আবিষ্কার।

দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, সেই ছেলেবেলা থেকেই বাবা যখন কাচপাত্র বানাতেন, আমি বাবার পাশে বসে কাচ নিয়ে খেলা করতাম।
ক্রানমার: খুব স্বাভাবিক।

দ্রিমাস: ছেলেবেলা থেকে কাচই ছিল আমার একমাত্র খেলার বিষয়।
ক্রানমার: বলে যাও।

দ্রিমাস: একদিন হঠাৎ খেলতে খেলতে আমি বাবার বানানো অনেকগুলো কাচপাত্র ভেঙে ফেললাম। সেগুলো ছিল ক্রীটের রাজার ব্যক্তিগত উপহারের জন্য তৈরি। বাবা অনেক পরিশ্রম করে অনেকদিন বসে সেগুলো বানিয়ে ছিলেন।
ক্রোনাস: পাত্রগুলো ভাঙার পর তোমার বাবা কী করলেন?

দ্রিমাস: (সামান্য নীরবতা) পাত্রগুলো ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে লৌহদণ্ড দ্বারা আমার পায়ে এমন সজোরে আঘাত করলেন যে, আমার বাম-পা চিরতরের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল।
ক্রানমার: হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমার পা পঙ্গু হবার কারণ তবে এই?

দ্রিমাস: কিন্তু পায়ের জন্য আমার কোনো দুঃখ ছিল না। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম কাচ কেন ভেঙে যায়। কাচ কেন ভাঙে?
ক্রোনাস: রাষ্ট্র, মানুষের সমাজ, সংসার সব ভেঙে যায়, আর কাচ ভাঙবে এতো খুবই স্বাভাবিক। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কি আছে?

দ্রিমাস: কাচ কেন ভাঙে, কেন ক্রীটের রাজার জন্য তৈরি কাচ সামগ্রী ভেঙে যাবে, ভাবতে ভাবতে আমার ছেলেবেলা পার হয়ে যায়। রাতের পর রাত আমি নিদ্রাহীন ভেবেছি সে কথা। একা। আমরা সে ভাবনার কোনো সঙ্গী ছিল না। শুধু মাত্র আমার এই পঙ্গু পা আর আমি ভেবে গেছি।
ক্রানমার: তোমার জীবন খুব বিস্ময়কর। বলে যাও তারপর।

দ্রিমাস: তারপর শুরু হলো কাচ নিয়ে আমার নতুন খেলা। নতুন জীবন। সেই খেলার মধ্যে দিয়ে একদিন মহান ক্রানমার, আমি এমন কাচ আবিষ্কার করলাম হাত থেকে পড়ে গেলেও যে কাচ ভাঙে না। আমার তৈরি কাচপাত্র ভঙ্গুর নয় মহান ক্রানমার। ছুড়ে দিন সে কাচপাত্র ভাঙবে না, বেখেয়ালে হাত থেকে নাড়া খেয়ে পড়ে গেলেও তা থাকে অক্ষত।
ক্রোনাস: বিস্ময়কর যুবক। তুমি এক বিরাট আবিষ্কারক। এ খবর পৃথিবী জানার সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ পড়ে যাবে।

ক্রানমার: কিন্তু যুবক, তুমি আমার কাছে আসতে গেলে কেন। আমাকে এ খবর দেয়ার কি প্রয়োজন ছিল? আমি একজন কাচ ব্যবসায়ী।
দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, আপনাকে আগেই বলেছি আমি এক গরীব কাচ কারিগরের ছেলে। এই কাচ দিয়ে পাত্র তৈরি করে দেশে দেশে বিক্রি করবো সে সামর্থ্য আমার নেই। আমি তাই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি।

ক্রানমার: আমার কাছে না আসলেই ভালো করতে! তবুও বলো কী সাহায্য চাই তোমার?
দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, আপনি হচ্ছেন সারা গ্রিসের মধ্যে সবচেয়ে সফল কাচ ব্যবসায়ী। সারা বিশ্বের কতোনা রাষ্ট্রে আপনার বাণিজ্যবহর ছুটছে। আপনি যদি আমার তৈরি এ কাচগুলো বাজারজাত করতে সাহায্য করেন, তাহলে খুব শীঘ্রই আমার এ পণ্য দেশে বিদেশে সমাদৃত হতো।

ক্রোনাস: ক্রানমার, অবশ্যই তোমার এ যুবককে সাহায্য করা দরকার। এ যুবক সারা গ্রিসের গৌরব।
ক্রানমার: হুঁ।

দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, হয় আপনি আমার পণ্য কিনে নিন,  কিনে বাজারজাত করুন, অথবা আমাকে বাজারজাত করতে সাহায্য করুন যে কোনো চুক্তিতে।
ক্রানমার: যুবক, তোমার কি এ ধরনের অনেক পাত্র তৈরি আছে?

দ্রিমাস: না, মহান ক্রানমার। নুমনা হিসাবে মাত্র বিশটি পাত্র এ মুহূর্তে আমার কাছে আছে। বাজারজাত করবার সম্ভাবনা দেখা দিলেই আমি আবার তৈরি শুরু করবো।
ক্রানমার: তোমার বিশটি নমুনাপাত্র  যদি আমি ক্রয় করে নিতে চাই তাহলে কি তুমি তা বিক্রি করবে?

দ্রিমাস: নিশ্চয় মহান ক্রানমার।
ক্রানমার: তাহলে তোমার এ বিশটি পাত্র আমি ক্রয় করে নিলাম। বিশটি পাত্রের জন্য আমি তোমাকে দাম দেবো দুই লক্ষ সেস্টাস।

দ্রিমাস: দুই লক্ষ সেস্টাস! কি বলছেন মহান ক্রানমার! বিশটি পাত্রের দাম একহাজার সেস্টাসের বেশি হতে পারে না।
ক্রানমার: যুবক, এই দুই লক্ষ সেস্টাস তোমার কাজের পুরস্কার। তোমার আবিষ্কারের দাম দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কোনো আবিষ্কারের দামই কেউ দিতে পারে না। লুসিয়াস, যাও, আমার সবচেয়ে দামি মদ নিয়ে আসো আমার এই সম্মানিত অতিথির জন্য।
(ক্রীতদাস মদ আনতে চলে যায়)

দ্রিমাস: মহান ক্রানমার, আপনি অতিশয় দয়ালু। যোগ্যলোকের কাছেই আমি এসে পৌঁছেছি।
ক্রানমার: যুবক, তুমি বোধ হয় আমার কাছে না আসলেই ভালো করতে! যুবক, তোমার বয়স কতো হলো?

দ্রিমাস: বাইশ, মহান ক্রানমার।
ক্রানমার: পৃথিবীর বহু কিছু দেখা এখনো তোমার বাকি রয়ে গেছে যুবক। তবে এ কথা সত্য তুমি যা আবিষ্কার করেছে তা বিরাট এক আশ্চর্য।

ক্রোনাস: যুবক, তোমার পণ্য যাতে থিউসের রাজ দরবারে স্থান লাভ করে তার জন্য আমি মহান রাজার কাছে সুপারিশ করবো।
দ্রিমাস: সে আপনার মহানুভবতা।
(ক্রীতদাস মদ নিয়ে আসে। ক্রানমার দুটো পাত্রে মদ ঢালে। একটি পাত্র নিজ হাতে তুলে নেয়।) চলবে