রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

(জোকাস্তাকে নিয়ে নেস্টরের প্রবেশ।)
জোকাস্তা: মহান রাজা কায়াস হলোফারনেস, আপনি দীর্ঘজীবী হোন।
হলোফার: থিউসের প্রতিটি নাগরিক দীর্ঘজীবী হোক। জোকাস্তা, ঐ বন্দী লোকটাকে কি তুমি চেনো? (জোকাস্তা কোনো কথা না বলে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে।) ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক। তোমার স্বামীর মতো যোগ্য ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা সবাই ব্যথিত।
জোকাস্তা: মহান রাজা, আমার এবং আমার স্বামীর প্রতি আপনি যে সহানুভূতি দেখালেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। মহান রাজা, আমি জানতে চাই ঐ খুনীটার কী শাস্তি হবে?

হলোফার: জোকাস্তা, সৈন্যরা পূর্বেই ওর জিহ্বা কেটে নিয়েছে। সে কারণে অনেকেই ওর প্রতি মমত্বশীল হয়ে পড়েছে। সবাই চাইছে ওকে যেন মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়া হয়।
জেকোনেত্তা: জোকাস্তা, বোন আমার, ওকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাও। একমাত্র তুমিই এখন আমার পুত্রকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারো।

হলোফার: উনি ঠিকই বলেছেন জোকাস্তা। যদি তুমি মহানুভবতা দেখিয়ে ফেরেসকে ক্ষমা করো, তাহলে আমরাও তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারি। শুধুমাত্র তোমার ক্ষমা পেলেই তার জীবন বাঁচতে পারে।
জোকাস্তা: মহান রাজা, যে স্বামী জীবিত অবস্থায় আমাকে ভালোবেসেছেন, আমার জন্য সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থেকেছেন, তার হত্যাকারীকে আজ আমি কেমন করে ক্ষমা করবো?

জেকোনেত্তা: বোন, তোমার স্বামী আর কোনদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু আমার সন্তানকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিও না। দেখো, বেচারা কথা বলতে পারছে না। সেজন্য তোমায় কোন অনুরোধও জানাতে পারছে না।
জোকাস্তা: আপনারা হচ্ছেন সেই সকল মানুষ, প্রয়োজনে যারা মানুষের পায়ে লুটিয়ে পড়তে দ্বিধা করেন না। আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে নিজের স্বার্থমতো নিরীহ মানুষের বুকেও ছুরি বসিয়ে দেন। পশুর মতো পেছন থেকে আঘাত করে ও আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। (হঠাৎ দুঃখে কষ্টে চীৎকার করে) ওর মৃত্যুই আমি চাই।

জেকোনেত্তা: জোকাস্তা, ক্রোধে তুমি অন্ধ হয়ে আছে। একটু শান্ত মনে ভেবে দেখো। পুত্রহারা মায়ের কথা স্মরণ করো।
জোকাস্তা: যখন আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়, তখন কি আপনার পুত্র স্বামীহারা স্ত্রীর বেদনার কথা স্মরণ করেছিল? ওর মৃত্যুই আমার কাম্য।

জেকোনেত্তা: জোকাস্তা, দয়া করো। আমাকে দয়া করো।
জোকাস্তা: অসম্ভব!

জেকোনেত্তা: তোমার কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি। আমি জেকোনেত্তা করজোড়ে তোমার কাছে আমার পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইছি। আমার পুত্রকে বাঁচতে দাও বোন।
জোকাস্তা: না না না! (সে কেঁদে ফেলে) না, না।

হলোফার: জেকোনেত্তা, আমি দুঃখিত। ব্যাপারটার এখানেই শেষ টানা দরকার। জোকাস্তা যদি ফেরেসকে ক্ষমা না করে থাকে, সেজন্য ওর ওপর আমরা কোনো দোষ চাপাতে পারি না। মানুষের কাছে কখনো কখনো প্রিয়জন হত্যার সান্ত্বনা হতে পারে আর একটি হত্যাকাণ্ড। ফেরেস যেভাবে নগর পাল ক্যাফিসকে হত্যা করেছে তারপর কোনো স্ত্রীর পক্ষেই তাকে ক্ষমা করা সম্ভব নয়।
ক্রোনাস: মহান রাজা, আমার মনে হয় এবার আমরা সরাসরি ফেরেসের বিচারকার্য সমাধা করে ফেলতে পারি। তার আগে মহীয়সী জেকোনেত্তার ব্যাপারেও আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসা দরকার।

নেস্টর: মহান রাজা, মান্যবর ক্রোনাসের সাথে আমার কোনো দ্বিমত নেই। মহীয়সী জেকোনেত্তা ও ফেরেসের বিচারকার্য এখন সম্পাদিত হতে পারে।
হলোফার: জেকোনেত্তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে পরবর্তী বিচার সভায়। আর তার পুত্রের বিচারের রায় শুনুন, আগামীকাল সন্ধ্যায় ক্রুশবিদ্ধ করে তাকে হত্যা করা হবে। ধর্মীয় উন্মাদনায় আর যাতে কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটে, তার জন্য থিউসের সকল জনতার সামনে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হবে। চলবে