রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’
পর্ব ৫
প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২১
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
নেস্টর: দুঃখিত মহানুভব। জেকোনেত্তা সুন্দরী ও সাহসী, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। সে চমৎকার বাগ্মীও বটে। যে কোনো পুরুষের জন্যই সে লাভেনীয়। কিন্তু এ কথা সবাই স্বীকার করবে যে, আমি জেকোনেত্তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ হবার যোগ্য নই।
হলোফার: প্রিয় নেস্টর, ক্ষেপে গেলে কেন! জেকোনেত্তাকে নিয়ে তোমার সাথে খানিকটা রসিকতা করছিলাম। মেয়েদের ব্যাপারে তুমি যে বিশেষ ধরনের একটু উদাসীন, সে খবরটা আমিও রাখি।
নেস্টর: মহান রাজা, জেকোনত্তা বন্দী এবং অভিযুক্ত। জনগণকে যেভাবে সে ধর্মীয় উন্মাদনায় মাতিয়ে দিয়েছে সেজন্য শাস্তি তার প্রাপ্য। হয়তো ফাঁসিই হতে পারে তার যোগ্য শাস্তি। তবে আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলাতে গিয়ে রাষ্ট্র যেন বিপদের সম্মুখীন না হয়।
হলোফার: ফাঁসিই হতে পারে শুধু তার যোগ্য শাস্তি এবং জেকোনেত্তা ফাঁসিতেই ঝুলবে। ফাঁসির হাত থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না।
নেস্টর: মহান রাজা, স্মরণ রাখবেন, জেকোনেত্তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সঙ্গে সঙ্গে জেকোনেত্তার সমর্থকরা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। নিকিয়াস আপনার সেই দুর্বলতার সুযোগে সিংহাসন লাভের দিকে এগিয়ে আসবে।
ব্রাসিডাস: মান্যবর নেস্টরের কথার যুক্তি আছে মহানুভব। জেকোনেত্তাকে হত্যা করা হলে এখানকার খ্রিষ্টানরা তো বটেই, সমগ্র খ্রিষ্টান জগত আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে।
হলোফার: হু, এ সময় নিকিয়াসকে যদি পক্ষে টানা যেতো তাহলে আমি জেকোনেত্তাকে চরম শাস্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতাম হলোফারনেস কোনো দুর্বল চিত্তের লোক নয়।
নেস্টর: নিকিয়াসের কোনো সাহায্য আপনি পাবেন না। নিকিয়াস জানে একমাত্র সামরিক শক্তি ছাড়া, আপনার পেছনে আর কোনো দল বা জনসমর্থন নেই। সে মনে করে সেটাই তার জন্য এখন থিউসের ক্ষমতা লাভের সবচেয়ে বড় সুযোগ।
হলোফার: হ্যাঁ। রাজনীতির কুটকৌশল প্রয়োগে সে বড় অভ্যস্ত। সবরকম সস্তা রাজনীতি সে জানে। নির্লজ্জের মতো সে একই মুখে দু-সময়ে দু-রকম কথা বলতে পারে।
নেস্টার: বর্তমান রাষ্ট্রের যে বিপদ, পুরো ব্যাপারটিকে সামলানোর এখন একটি মাত্র পথ খোলা আছে।
হলোফার: বলো, কোন পথ?
নেস্টর: সেটা হচ্ছে জেকোনেত্তাকে শত্রু থেকে বন্ধু করে নেয়া।
হলোফার: কী বাজে বকছো। জেকোনেত্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব!
নেস্টর: হ্যাঁ, মহান রাজা। সেটা যদি আপনি করতে পারেন তাহলে আপনার শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
হলোফার: না, সেটা অসম্ভব।
ব্রাসিডাস: মহামান্য রাজা, ভেবে দেখুন মহীয়সী জেকোনেত্তাকে বন্ধু করে নেয়া হলে থিউসের খ্রিষ্টানসহ বিশ্ব-খ্রিষ্টান সম্প্রদায় আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। নিকিয়াসও এতে কিছুটা ঘাবড়ে যাবে। জনসমর্থন লাভ করবেন আপনি।
হলোফার: ব্রাসিডাস, তার মানে হবে থিউস রাষ্ট্রকে শক্তিশালী দুটো শিবিরে বিভক্ত করে ফেলা। ইতিমধ্যেই গথদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছি। নতুন করে তাহলে আবার রোম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
নেস্টর: ব্যাপারটা সাময়িক। থিউস রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেলে, গথবলয় এবং রোম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে আমরা নিজেদের পুনরায় মুক্ত করে নেবো। রোমের সঙ্গে আমাদের কিছুটা সম্পর্ক তৈরি হলে গথরা বুঝবে, চাইলেই তারা আমাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
ব্রাসিডাস: সম্মানিত নেস্টর চমৎকার যুক্তি দিয়েছেন মহামান্য রাজা। প্রতিপক্ষ আপনাকে দুর্বল ভাবছে বলেই তারা আপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু আপনিও যদি জেকোনেত্তাকে মিত্র বানিয়ে খ্রিষ্ট জগতের সমর্থন লাভ করতে পারেন, তাহলে প্রতিপক্ষ আপনার সামনে আর দাঁড়াতেই পারবে না।
নেস্টর: এবং খুব সহজেই প্রজাবিদ্রোহ দমিত হবে।
হলোফার: বুঝলাম চমৎকার যুক্তি। বুঝলাম আমার সিংহাসনের অধিকার পাকাপোক্ত করার জন্য বিশেষ একজন খুনী মহিলার সাথেই আমাদের বন্ধুত্ব করতে হবে। কিন্তু সেটা কি খুবই সহজ! কিভাবে জেকোনেত্তার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হতে পারে?
ব্রাসিডাস: আমার ধারণা সম্মানিত নেস্টর সে ব্যাপারে নিশ্চয় কিছু ভেবে রেখেছেন।
নেস্টর: মহান রাজা, মাস ছয়েক আগে আপনার স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে আপনি নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন। আমার প্রস্তাব, আপনি জেকোনেত্তাকে বিবাহ করে আপনার রানী করে নিন। জেকোনেত্তার জন্য সেটা হবে পরম সৌভাগ্যের বিষয়। এতে করে রোমের সাথে আপনার পুনরায় বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
ব্রাসিডাস: খুবই উত্তম প্রস্তাব। সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম উপায়। ক্ষমতার প্রতি সকলেরই কমবেশি লোভ থাকে মহানুভব। হোক সে ধর্মগুরু কিংবা বিদ্রোহী।
হলোফার: প্রিয় নেস্টর, তোমরা দেশের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজছো আমার সাথে জেকোনেত্তার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ভিন্ন আদর্শের এক বর্ষীয়ান মহিলার সাথে আমার বিবাহ দিয়ে। মানতেই হচ্ছে কখনো কখনো বিবাহ একটি রাজনীতির অংশ।
ব্রাসিডাস: নিকিয়াস আপনার পক্ষে থাকলে জেকোনেত্তাকে শাস্তি প্রদান আপনার জন্য কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু একই সাথে রাষ্ট্রের দুই বৃহৎ শক্তিকে শত্রু বানানো কোনো রাজার পক্ষেই মঙ্গলজনক নয়।
নেস্টর: তিনশো বছর আগের রোমে সীজারের মা, পম্পেইয়ার মা আর সীজারের কাকীমা রাজনীতি ভিন্ন অন্য চিন্তা কমই করতেন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কারণেই তাদের বারংবার বিয়ে হতো এবং বিচ্ছেদ ঘটতো।
হলোফার: রাজনীতির খেলায় তাহলে এই বর্ষীয়ান মহিলাকে বিবাহ করেই তবে আমার সিংহাসন পাকাপোক্ত রাখতে হবে?
নেস্টর: মহানুভব, জেকোনেত্তা যদিও দু দুটো যুবক পুত্রের জননী, তবুও আমি মনে করি ইডিপাস যেমন সুখের সঙ্গেই মাতার সাথে দাম্পত্য জীবন ভোগ করেছিলেন, বয়স কোনো সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। তেমনি জেকোনেত্তার বয়সও আপনার জন্য কোনো অন্তরায় হবে না।
হলোফার: ইডিপাস হচ্ছে সোফোক্লিসের নাটকের গল্প। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কিন্তু যেকথা সর্বদাই সত্য তা হলো, কোনো দাম্পত্য জীবনই বয়সের ভিত্তিতে নির্ণীত হয় না। সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে, সকল দাম্পত্য সুখ খুবই সাময়িক। চিরস্থায়ী দাম্পত্য সুখ বলে কিছু নেই। বিবাহ যেমন একটি রাজনীতি, ঠিক তেমনি একটি চুক্তি।
নেস্টর: মহানুভব কি তাহলে জেকোনেত্তার সঙ্গে এ বিয়ের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন? মহানুভব, আপনার সম্মতি পেলেই আমরা এ বিয়ের সকল আয়োজন করতে পারি।
হলোফার: জেকোনেত্তা রূপসী, বিদূষী এবং সাহসী। কিন্তু মৃত স্বামীর শোক যদি সে এখনো ভুলে না গিয়ে থাকে, তাহলে এ প্রস্তাবে কি সে রাজী হবে? একথাও সত্য যে, এ শুধুমাত্র একটি বিয়েই নয়, একই সাথে রাজনীতিও বটে। এ বিয়ে একটি কৌশলেরই নামান্তর মাত্র।
ব্রাসিডাস: মহানুভব, জেকোনেত্তা রূপসী, বিদূষী একই সাথে ধনাঢ্যও বটে। কিন্তু মহান রাজা, একই সাথে আপনার নিজের সৌন্দর্য এবং যোগ্যতার কথাও স্মরণ রাখবেন। যে কোনো নারী আপনার স্ত্রী এবং একই সঙ্গে থিউসের রানী হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে।
হলোফার: প্রিয় নেস্টর, তাহলে সব কিছুর আয়োজন করো। কিন্তু বিষয়টা কি আরো ভালো ভাবে একবার ভেবে দেখা দরকার নয়? এমনও তো হতে পারে জেকোনেত্তার সাথে আমার এ পরিণয় বহু রাজপুরুষই মেনে নেবে না।
নেস্টর: হয়তোবা। [সামান্য হেসে] আপনার সাথে জেকোনেত্তার এই শুভ বিবাহ উপলক্ষে রাজপুরুষদের ভাতা কিছুটা বাড়িয়ে দিন। দেখবেন রাজপুরুষরা খুব খুশি মনেই এ বিয়েকে স্বাগত জানাবে।
হলোফার: নিকিয়াস আর আমি একদা এক সাথে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। সেই নিকিয়াস কিনা আজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার শত্রু। আর বন্ধু হতে যাচ্ছে সেদিনের শত্রু জেকোনেত্তা।
নেস্টর: মহানুভব, ইতিহাস সাক্ষী দেবে, আমাদের নিজেদের মধ্যকার আন্তর্বিরোধই জেকোনেত্তার মতো শত্রুকেও মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে।
ব্রাসিডাস: নিকিয়াস খানিকটা নমনীয়তা প্রদর্শন করলেই, জেকোনেত্তার এই উত্থানকে রোধ করা যেতো। কিন্তু ক্ষমতার লোভই মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
হলোফার: রাজনীতি যে কতো বিচিত্র পধ ধরে হাঁটে। ক্ষমতা প্রাপ্তির পথটা ভয়ানক! মায়ামমতা, বিশ্বাস, আদর্শ, বন্ধুত্ব এমনকি নিজের অতীত; সবকিছুই তুচ্ছ। চলবে