রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২১

দ্বিতীয় দৃশ্য
(রাজা হলোফারনেসের প্রাসাদ। প্রাসাদে রাজার ব্যক্তিগত কক্ষে আলাপরত রাজা হলোফারনেস, সেনাধ্যক্ষ ব্রাসিডাস ও সভাসদ নেস্টর। সকলেই গভীর চিন্তামগ্ন।)
নেস্টর: মহাম্যন রাজা, রাষ্ট্রের শেষ সংবাদ হলো, প্রজারা সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত। শহরের বিভিন্ন স্থানে যে বিক্ষোভ চলছে, সশস্ত্র বিপ্লবের তা পূর্ব লক্ষণ। দেশের নাট্যকার, কবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সকলেই সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে তাদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছেন। সকলের দাবি, থিউসে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হোক। গত দুমাস ধরে থিউসের সকল নাটক, কবিতা ও সভা সমিতিতে এই একই কথা ঘোষিত হচ্ছে। সকলের ধারণা, আপনি থিউসের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন এবং বাহুবলে থিউসের ক্ষমতা দখল করে আছেন।
ব্রাসিডাস: রাষ্ট্রের সর্বত্র তারা আপনার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। যে কোনো সময় তারা আঘাত হানবে। বিদ্রোহী যুবকরা ইতিমধ্যেই নগরের বেশ কয়েকটি স্তম্ভ ভাঙচুর করেছে। দু একটি স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। প্রয়াত রাজা ফিলোটাসের ভ্রাতুষ্পুত্র নিকিয়াসের উস্কানিতেই এসব ঘটছে।

নেস্টর: নিকিয়াস এখন তার পিতৃব্য ফিলোটাসের হত্যাকারীদের বিচারও দাবি করছে।
হলোফার: নিকিয়াসকে তাহলে বন্দী করা হোক। কয়েকদিন কারাগারে থাকুক। ঠিক তারপর তার সঙ্গে বিশেষ গোপন আলোচনার ভিতর দিয়ে আমাদের একটা আপোষে আসতে হবে। যে কোনো রকম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এখন আমাদের এড়াতে হবে।
ব্রাসিডাস: মহামান্য রাজা, বিদ্রোহী নিকিয়াসের সাথে কোনো রকম আপোষ আলোচনার আর কোনো সুযোগ আছে বলে তো মনে হয় না। এর আগেও তার সাথে আলোচনা চালাবার চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

নেস্টর: গত বছরের বন্যায় প্রজারা যে দুর্ভোগ বহন করেছে, নিকিয়াস প্রজাদের বারবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে প্রজা আসন্তোষ সৃষ্টি করছে। সে জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, তার পিতৃব্য রাজা ফিলোটাসের শাসন-আমলে জনগণ বেশি সুখে ছিল। রাষ্ট্রে নাকি তখন গণতন্ত্র ছিল।
হলোফার: নিকিয়াস যদি সোজা পথে সমঝোতায় না আসে; নেস্টর, এবার আমাদেরও উচিত হবে নিকিয়াসের পিতৃব্যের কিছু কিছু কুকীর্তি জনগণের মধ্যে প্রচার করা।

নেস্টার: ক্ষমা করবেন মহানুভব, এভাবে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হলে, জনগণ দুপক্ষ সম্পর্কেই সজাগ হয়ে উঠবে। কিন্তু তাতে করে নিকিয়াসের কিংবা আমাদের কারোরই কোনো লাভ হবার সম্ভাবনা নেই। কোনো তৃতীয় পক্ষ তখন এ কাজের ফল ভোগ করবে। দুপক্ষের এই লড়াইয়ের সুযোগে মাঝখান দিয়ে কোনো তৃতীয় শক্তি তখন জয়ী হয়ে যাবে।
হলোফার: হ্যাঁ, তোমার কথা যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু নিকিয়াস যে ভাবে মিথ্যা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে সেটা ভীষণ রকম নিন্দনীয়। নিকিয়াস নিজেও জানে গত বন্যায় ফসল নষ্ট হবার ফলে যে খাদ্যাভাব দেখা গেছে, তার জন্য দায়ী আমি নই। দায়ী ছিল প্রকৃতি।

নেস্টর: মহানুভব রাজা, এটাই তো লড়াইয়ের নিয়ম, যেভাবেই হোক প্রতিপক্ষকে হারাতে হবে। যে করেই হোক সাধারণ মানুষের চোখে প্রতিপক্ষকে খাটো করে তুলতে হবে। নিকিয়াস সে খেলার নিয়ম মেনেই এ সব করেছে।
ব্রাসিডাস: গত বন্যায় রাজকর্মচারীরা ত্রাণ দেবার নাম করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বহু টাকা লুটপাট করেছে। জনগণ সে-কারণেও ক্ষুব্ধ। সকলেই বলছে, রাজকর্মচারীদের বড় বড় লুণ্ঠনের বিচার হচ্ছে না। রাজা স্বয়ং তাদের লালন করছে।

হলোফার: কথাটা চাইলেই যে আমি অস্বীকার করতে পারবো তা নয়। রাজকর্মচারীরা আমাকে ক্ষমতায় থাকতে যেভাবে সাহায্য করছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাট করে আমার দুর্নাম বাড়াতে সমানভাবে সাহায্য করছে।
নেস্টর: রাজকর্মচারীরা সর্বদাই তাই করে। নিজেদের সকল লুটপাটের দায় শাসকদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা সুখেই থাকে। শাসকরা সর্বদা তাদের দুর্নীতি করবার সুযোগ দেয় আর মনে করে, রাজকর্মচারীরা তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে। মহামান্য রাজা, রাজকর্মচারীদের তোষণের ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা পাল্টানো দরকার।

ব্রাসিডাস: সম্মানিত ক্রোনাস, এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় নয়। সামনে দুর্দিন। নিকিয়াসের উস্কানিতে যখন তখন রাষ্ট্রের ভিতরে গণরোষ দেখা দিতে পারে।
হলোফার: জনগণের বিরুদ্ধে সৈন্যদের লেলিয়ে দেয়া কোনো সুখকর কাজ নয়। কিন্তু বিদ্রোহ দমনের জন্য দেখছি এখন তাই করতে হবে। সেনাধ্যক্ষ ব্রাসিডাস, এখন থেকে সব রকম বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। নেস্টর, এ ঘোষণা প্রচার করে দিতে বলো। সেনাধ্যক্ষ, যে কেউ এ ঘোষণা অমান্য করলে সৈন্য পাঠিয়ে তাকে দমন করুন।

নেস্টর: মহানুভব, সৈন্যদের নিয়োগ করে এ বিদ্রোহ দমন করা হলে সব সময়ের জন্য জনগণের সাথে সেনাবাহিনীর একটি বৈরী মনোভাব তৈরি হবে। জনগণ মনে করে সৈন্যদের কাজ দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা কিংবা ভিন্ন কোনো দেশ জয় করা। সৈন্যবাহিনীকে এখনি প্রজাবিদ্রোহ দমনে পাঠাবেন না।
ব্রাসিডাস: হ্যাঁ মহানুভব। রাজনৈতিক এসব ঝামেলায় সৈন্যবাহিনীকে এখনি, না জড়ানোই ভালো।

হলোফার: ব্রাসিডাস, আপনারা কি আমায় শিখিয়ে দেবেন দেশ কি করে চালনা করতে হয়? পাশের রাষ্ট্র গথদের নানা রকম সুবিধা দিয়ে আমরা এ স্বাধীনতা ভোগ করছি। গথরা চাইলে যখন-তখন ক্ষুদ্র এ রাজ্যটি জয় করে নিতে পারে। তা জেনেও, মিছামিছি এত বড় এক সৈন্যবাহিনীকে কেন লালন করা হচ্ছে তার অর্থ বোঝেন? যদি রাজার বিপদে আপনারা রাজার পাশে দাঁড়াতে না চান, কেন আমি সৈন্যবাহিনী লালন করবো?
ব্রাসিডাস: ক্ষমা করবেন মহানুভব, আপনার ঘোষণার কথা সব সৈন্যদের জানিয়ে দেবো। থিউসের প্রজারা কোনোভাবেই দ্বিতীয়বার বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সুযোগ পাবে না।

হলোফার: যতটা সম্ভব কম রক্তপাত ঘটানোর চেষ্টা করবেন। সুযোগ পেলেই সৈন্যরা নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে রাজার নির্দেশকে ছাড়িয়ে যায়। সৈন্যরা যাতে মহিলাদের প্রতি কোনরকম অসম্মান প্রদর্শন না করে, বিশেষ করে সেদিকটাতে লক্ষ্য রাখবেন।
ব্রাসিডাস: মহান রাজা, যে ধরনের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে তারপর তাদের কাছ থেকে মহৎ কোনো গুণাবলী আশা না করাই সঙ্গত।

নেস্টর: মহানুভব, সৈন্যদের দিয়ে প্রজা বিক্ষোভ দমন করা হলে ঘটনা ভিন্ন খাতে বইতে পারে। এতে প্রজা অসন্তোষ আরো বাড়বে। আমাদের এখন সেই পথই গ্রহণ করা উচিত হবে, যেখানে সমস্যার একটি সহজ সমাধান সম্ভব।
হলোফার: প্রিয় নেস্টর, ভুলে যাও কেন, প্রজা বিদ্রোহই এখন শুধু আমাদের সমস্যা নয়। খ্রিষ্টাননেত্রী জেকোনেত্তাও এখন আমাদের জন্য একটা সমস্যা। দুই শত্রু এখন, জেকোনেত্তা এবং নিকিয়াস। জেকোনেত্তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইতিমধ্যেই রোম থেকে আমার কাছে একটি চিঠি এসেছে।

নেস্টর: মহীয়সী জেকোনেত্তা যা করেছে তা খুবই অন্যায়। কিন্তু এ কথাও সত্য যে জনগণের একটা বড় অংশ তার সমর্থক। দেশের খ্রিষ্টধর্ম অবলম্বীদের অনেকেই জেকোনেত্তার এই বন্দী অবস্থা সহজে মেনে নেবে না। ধর্মীয় গুরু হিসাবে জেকোনেত্তা তাদের কাছে পরম পূজনীয়।
হলোফার: হায়রে মূর্খ জনগণ! যাকে পূজনীয় ভেবে হৃদয়ে স্থান দাও, কখনো কি ভেবে দেখেছো, সে পূজার যোগ্য কিনা! সে তোমাদের সত্যিকার বন্ধু কিনা! বন্ধুর মুখোশ পরে সে শুধু ধর্মের নামে তোমাদের নিজের স্বার্থেই ব্যবহার করে।

নেস্টর: মহান রাজা, জনগণ ভুলভাবে যাদের বন্ধু মনে করে তাদের জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে না। নিকিয়াস প্রয়োজন মনে করলে, জেকোনেত্তাকে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। সেজন্য নিকিয়াস ও জেকোনেত্তার বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়তে যাওয়ার কিছু অসুবিধা আছে।
হলোফার: হুঁ।

ব্রাসিডাস: বিশেষ করে মহীয়সী জেকোনেত্তার ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। খ্রিষ্ট সম্প্রদায় তার ভীষণ ভক্ত।
হলোফার: জেকোনেত্তার প্রতি কোথায় যেন তোমার একটা দুর্বলতা টের পাচ্ছি প্রিয় নেস্টর। সে সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী। তুমি নিজেও এখন পর্যন্ত অবিবাহিত। জেকোনেত্তা বিধবা। জেকোনেত্তার প্রতি তোমার মনে কি কোনো প্রেম জেগেছে? চলবে