রাহমান চৌধুরীর গল্প ‘আগে নিজেকে জানো’

প্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০২০

যুবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের প্রায় সমাপ্তি পর্বে চলে এসেছে। সবাই জানে সে সত্যিই আইনের খুব মেধাবী ছাত্র কিন্তু লেখালেখির অভ্যাস রয়েছে। যুবকটির ভূস্বামী বন্ধু একদিন তাকে বললো, যখন লেখালেখি করবে আমাদের পুরানো ক্যাসলে কদিনের জন্য বেড়াতে চলে যাও। রাজত্ব তো নেই, ফলে সেখানে কিছুই প্রায় নেই পুরানো ভবন ছাড়া। ঠিকমতো ভবনগুলি দেখাশোনা করার লোকজন নেই পর্যন্ত। কিন্তু তোমার দেখভাল করা, ঠিকমতো খাওয়ার যত্ন নেয়ার জন্য রয়েছেন বিশেষভাবে একজন তত্ত্বাবধায়ক। দু-জন প্রহরী আছে বাড়িটা দেখাশোনা করে দিনের বেলায়। ভবনের সব খবরাখবর নিজেও সঠিকভাবে জানি না। যদি যেতে চাও আমি খবর দিয়ে দিচ্ছি কদিনের জন্য ঘুরে আসো। মনে হয় খারাপ লাগবে না। চারদিকে গ্রাম ঠিক তার মাঝখানে ছোট ক্যাসলটি। ক্যাসলের ফটক দেয়াল বহু কিছু ভেঙে পড়েছে বরং বলা যায় তা এতদিনে হারিয়ে গেছে। ভবনটি এখনো টিকে রয়েছে।

যুবকটির যেন মনের স্বপ্ন পুরণ হতে চলেছে। পুরানো দিনের এমন ক্যাসলে বসে লিখবে কিছুদিন বহুবার তেমনটি মনে মনে ভেবেছে। গির্জায় ঢুকবার সুযোগ হয়েছে বহুবার কিন্তু কখনো কোনো ক্যাসলে থাকার সুযোগ হয়নি। বন্ধুর ক্যাসলটি খুব বড় নয়। কিন্তু ক্যাসল তো বটেই পুরানো সামন্ত প্রভুদের। বন্ধু যখন নিজেই প্রস্তাব দিয়েছে ঘুরে আসা যাক। যুবকটি ভিতরে ভিতরে টগবগ করছে যাবার জন্য। কিন্তু ব্যবসায়ীর পুত্র লুই তাকে গোপনে ডেকে নিয়ে ক্যাসলে যেতে নিরুৎসাহিত করলো। বললো, নির্জনতায় গিয়ে লিখবার কী আছে, লিখতে হয় মানুষের মধ্যে থেকে মানুষের জন্য। ব্যবসায়ী-পুত্র তাকে আরো জানালো ক্যাসলটি খুব বড় নয়, চারদিকটা খুবই ফাঁকা ফাঁকা। দুর্গের মতো করে বিরাট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল একদা ক্যাসলটা। প্রধান ফটক সহ সেই প্রাচীর ফরাসী বিপ্লবের সময় সেই যে কৃষকরা আক্রমণ করে ভেঙে দিয়েছিল, চিহ্ন পর্যন্ত নেই এখন। নতুন করে ঠিক করা হয়নি সে প্রাচীর আর। দরকারও হয় না।

ব্যবসায়ী-পুত্র লুই তাকে নিরুৎসাহী করার জন্য যতোই বিধ্বস্ত ক্যাসলের নানান বর্ণনা দিচ্ছিল, যুবকটির সেখানে যাবার আগ্রহ ততই বাড়ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার-পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা মাত্র ক্যাসলটি। যুবকটি একদিন সকালে রওয়ানা দিয়ে দুপুরের আগে পৌঁছে গেল। শহর পার হয়ে কয়েক মাইল গ্রামের ভিতর দিয়ে সড়কপথে যেতে যেতে ক্যাসলটা নজরে ঠিকই এলো, কিন্তু ক্যাসলের চারদিকে যেন বিরানভূমি। ক্যাসলটা ছোট হলেও স্থাপত্যরীতি সুন্দর কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে মোটেও তেমন ঝকঝকে তকতকে নয়। দূরে সুন্দর একটা গির্জা আর কয়েকটা কৃষকের বাড়ি নজরে পড়লো। কিন্তু সব কিছুই যেন ক্যাসল থেকে বেশ দূরে। ক্যাসলের প্রাচীর বলে কিছু নেই আর। মূল সড়ক থেকে বাম দিকে ভিন্ন শাখা-একটা ছোট্ট পাকা সড়ক ক্যাসল পর্যন্তই চলে গেছে। মিলেছে গিয়ে ক্যাসলের ভবনের সঙ্গে। ক্যাসল-ভবনের চারদিকের সবুজ গাছপালা ভবনটার আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মূল রাস্তা থেকে সরে গিয়ে সামান্য পাকা রাস্তা ধরে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো গাড়িটা। ভবন পর্যন্ত যেতে কোনো প্রহরীর দেখা মিললো না। বন্ধু তার নিজের ফিটন গাড়িটা দিয়েছিল, যুবকটিকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা আবার ফিরে যাবে প্যারিসে। বাড়ির সামনে দু-জন মানুষ অপেক্ষাই করছিল তার মালপত্র বহন করার জন্য। যিনি বাড়িটার দেখভাল করছেন তিনিও উপস্থিত ছিলেন, মধ্যবয়স্ক মানুষটিই বাড়ির বিশেষ তত্ত্ববধায়ক। সবকিছুই নাকি একহাতে তিনিই সামলান। নির্জন এলাকার ভিতরে বিশাল জমির উপরে দাঁড়িয়ে দ্বিতল মূলভবনটি। ক্যাসল ভবনটি থেকে সামান্য দূরে শহরে ফিরে যাবার মূল রাস্তা। যুবককে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা আবার ফিরে গেল সেই পথ ধরে। যুবকের মালপত্র ইতিমধ্যেই দুজন বহন করে নিয়ে গেছে তার জন্য রাখা নির্দিষ্ট কক্ষে। নির্জনতার ভিতরে ভবনের চারদিকের সবুজ গাছপালা যুবককে সত্যিই মুগ্ধ করলো।

যুবকটি প্রথম ঢুকে বসলো নীচতলায় বাড়ির বড় কক্ষটিতে। বাইরেটা যাই হোক ভিতরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বড় বড় ঝাড়লণ্ঠন লাগানো সব কক্ষের ভিতর। ঝাড়লণ্ঠন ছাড়া বিলাসিতার খুব বেশি কিছু চিহ্ন নেই তেমন। যুবকটি বিশেষ তত্ত্বাবধায়কের কাছে জানতে চাইলো, মনে হচ্ছে ধারে কাছে মানুষজন থাকে না। তিনি জানালেন ঠিক তাই। ক্যাসলের মালিকের জমি অনেকটা, প্রায় একটা গ্রাম জুড়ে। ক্যাসল ভবনের বাইরে যতদূর দেখা যায় প্রায়টাই মালিকের জমি। গ্রামের মানুষজন বাস করে ক্যাসলের বিশাল সম্পত্তির বাইরে গ্রামটার শেষপ্রান্তে। সারাদিন ক্যাসলের জমি চাষবাস আর বিভিন্ন কাজকর্ম সেরে সকলে রাতে নিজের বাড়িতে চলে যায়। ক্যাসলের যখন যা দরকার হয় শহর থেকে বা গ্রামের লোকরা নিজেরা তা পৌঁছে দিয়ে যায়। কিন্তু দরকার হয় না বিশেষ কিছু, কারণ মানুষজন আসে খুব কম। জানা গেল ক্যাসলটা দেখতে যাই হোক, সাড়ে তিনশো বছরের পুরানো।

যুবক জানতে চাইলো, রাতে এ বাড়িটাতে একা থাকেন আপনি? মানুষটি বিনয়ের সঙ্গে জানালেন ঠিক তাই। মানুষটির গঠন আর ব্যবহারে যেন সামন্ত সংস্কৃতি অবশেষ রয়ে গেছে। দিনের বেলায় প্রয়োজনীয় সব কাজ সেরে সকলে নিজেদের বাড়িতে চলে যায়। রাতে তিনি একা থাকেন ভবনে, নিজের মতো খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। বিশেষ-তত্ত্বাবধায়কের বয়স, ব্যক্তিত্ব সব মিলিয়ে যেন তিনি ক্যাসলের পুরানো ঐতিহ্য ধরে রাখার যোগ্য মানুষটি। যুবকটি জানতে চাইলো, বিরাট বাড়িতে একা থাকছেন। রাতে দস্যূর ভয় তো রয়েছে। তিনি বললেন, ক্যাসলে এখন আর লুট করবার কী বা আর আছে যে রাতে দস্যূ পড়বে। ফরাসী বিপ্লবের দিনে লুটপাট যা হবার হয়ে গেছে। দরিদ্র কৃষকরাই লুটপাট করেছে। সামন্ত-প্রভু যখন ছিলেন, রাজ্য যখন ছিল সেসব দিন কি আর আছে! সেসবই কতো যুগ আগের পুরানো গল্প।

দুপুরে বেশ যত্ন নিয়ে বিশেষ-তত্ত্বাবধায়ক তাকে খাওয়ালেন সামনে বিনয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে। যুবকটিকে বললেন, যখন যা দরকার বলবেন। ভূস্বামী মহাশয়ের বন্ধু আপনি, যদি আপনার অযত্ন হয় কর্তাবাবু মনে কষ্ট পাবেন। যুবকটি প্রয়োজন মতো ফলমূল, বিকালে এবং সন্ধ্যায় চা-কফি সব পেয়ে গেল। সারাদিনে লেখালেখি হয়নি, প্রথমদিনটা ক্যাসল-ভবনের পরিবেশ উপভোগ করতেই চলে গেল। দরকার হলে রাতে খেয়ে কিছুটা লিখতে বসবে। কিছু না হোক আজকের দিনটার স্মৃতি লিখে রাখবে। রাতের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেল বেশ আরামের সঙ্গে। যা কিছু খাবার দেয়া হয়েছিল সবটাই সুস্বাদু। নির্জনে এমন রাজকীয় জীবন এই প্রথমবার উপভোগ করছে। নিজে সে এক ধনী-কৃষকের ছেলে। ঝাড়লণ্ঠন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল সন্ধ্যায় কয়েকটি কক্ষের। খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করে নিজের কক্ষে চলে এলো যুবকটি। সেখানে দুটো গ্যাসের বাতি জ্বালানো, ইচ্ছা করলে যুবক সে আলোতে লিখতে পারবে। ঘুমাবার আগে চাইলে নিভিয়ে দিতে পারবে।

রাত বাড়ছে। যুবকটি উপভোগ করছে তার ক্যাসল-ভবনের ভ্রমণ। চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে কখনো কখনো ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে যেন। বিশেষ-তত্ত্বাবধায়ক হাজির হলো আবার তার কক্ষে, জানতে চাইতে চাইলন, মাননীয় আর কিছু দরকার আছে আপনার? না হলে, আপনার অনুমতি পেলে শুয়ে পড়বো। যুবকটির মনে পড়লো, রাতে খাবার জন্য কখনো কখনো তার এক গ্লাস পানির প্রয়োজন হয়। কৃষকের ছেলে, ক্যাসল ঢুকে হয়ে গেল মাননীয়। যুবকটি বিশেষ-তত্ত্বাবধায়কের কাছে এক গ্লাস পানির কথা বললো বিনয়ের সঙ্গে। তিনি পানি আনতে বের হয়ে গেলেন। যুবকটি ভাবছে লিখবার জন্য প্রস্তুতি নেবে। বিশেষ-তত্ত্বাবধায়ক আর পুরানো ক্যাসলের কথাই কিছু লিখতে চায় প্রথম দিন। সিগারেট আর দিয়াশলাই সামনে রাখলো। হালকা ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে, যুবকটির পরনে তেমনি রাতের পোষাক। বিশেষ-তত্ত্বাবধায়ক ফিরলেন হাতে এক গ্লাস স্বচ্ছ জল নিয়ে। দিনের সেই ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি জলের কাচের গ্লাসটা ধরে রেখেছেন নিজের দুহাতে।

যুবক হঠাৎ লক্ষ্য করলো, বিশেষ-তত্ত্বাবধায়ক যেহাত দুটি দিয়ে জলের গ্লাসটা ধরে রেখেছেন, মানুষের যেন হাত নয় তা। দুটো হাতের পাঞ্জাই ঠিক ঘোড়ার খুড়ের মতো। ঘোড়ার খুরের মতো হাত দিয়ে জলের গ্লাশটা রাখলেন মূল টেবিলের পাশে ভিন্ন একটি ছোট টেবিলের উপর। হাতের পাঞ্জা দুটি ঘোড়ার খুরের মতো বলেই দুহাত দিয়ে ধরতে হয়েছে পানির গ্লাশটা। বিশেষ-তত্ত্বাবধায়কের শরীরের সব অংশই দিনের মতো কিন্তু হাতের পাঞ্জা দুটি ঘোড়ার খুরের আকৃতি নিয়েছে মাত্র। তিনি যেন সেটা লুকাবার চেষ্টাও করছেন না। বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু প্রয়োজন মাননীয়? যুবকটির কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলেও সে বললো, ‘না, আর কিছুর দরকার নেই। ধন্যবাদ’। শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তিনি। যুবকটি বিস্ময়ে বিমূঢ়!

যুবকটি তখন ভিতরে ভিতরে একটু একটু ঘামছে আর কাঁপছে। সবকিছু আকস্মিকভাবে ঘটে গেছে। কী করণীয় তার এখন। সারারাত যে ঘুম হবে না সে জানে কিন্তু এ ভবনে রাতটা থাকা কি নিরাপদ! যদি এখান থেকে পালিয়ে যেতে চায় সেটা কি আর এখন সম্ভব। মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে যুবক। বন্ধু লুইয়েরে কথা হঠাৎ তার মনে পড়ে। বারবার তাকে আসতে বাধা দিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নেয়, রাতে আরো কিছু ঘটবার আগে এখান থেকে পালাতে হবে। ঘুমের পোষাকের ভিতরে সিগারেট আর দিয়াশলাইটা ভরে নিয়ে সে পালাবার প্রস্তুতি নেয়। খেয়াল করে মাথার হ্যাট আর গায়ের কোটটি নিতে ভোলে না। ধীর পায়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নীচতলায় চলে আসে। বুকের ভিতরে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ভবনের নীচের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রালোকে দেখতে পায় সামনের বিরাট চত্ত্বর পার হয়ে শহরে যাবার রাস্তাটা। পালাতে পারবে কিনা সে নিশ্চিত নয়। কিন্তু পরাজয় না মেনে চেষ্টা চালাতে হবে।

রাস্তায় গিয়ে তারপর কী করবে ভাবতে থাকে যুবক। রাত সে হিসেবে তেমন বেশি নয় কিন্তু এই রাত্রে নির্জন এই গ্রামে কোনো বাহন পাওয়া যাবে না ফিরে যাবার। না, পাওয়া যাক। হাঁটবে দরকার হলে সকাল পর্যন্ত। কিন্তু সবার আগে এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। না হলে মধ্য রাতে ভয়াবহ আরো কিছু ঘটতে পারে। দরকার হলে কাছের গির্জায় গিয়ে আশ্রয় চাইবে রাতের জন্য। যুবক দ্রুত হাঁটতে থাকে মূল সড়কের দিকে। কিছু ঘটবার আগে ভবনের নিজস্ব রাস্তাটা পার হওয়া দরকার যেকোনোভাবে। কিছুটা দ্রুত হেঁটে সে দৌড়াতে শুরু করে মূল রাস্তায় পৌছাবার জন্য। কিছুটা দৌড়ে ভবনটা পিছনে ফেলে চলে আসে মূল সড়কে। রাস্তায় পা দিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকে শহরের দিকে। যুবক তখন খুব হাফাচ্ছে। যুবকের হঠাৎ মনে হয় কিছু একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে, রাস্তা দিয়ে বাহন আসছে কোনো। যুবকের ধারণাই ঠিক। ঘোড়ার একটা গাড়ি ঠিক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তার। তাকে দেখে পথের উপরে থেমে পড়লো।

যুবক যেন কিছুটা সাহস পেল। ঘোড়ার গাড়ির চালক জানতে চাইলো, সম্মানিত পথিক, আপনি কোনদিকে যাবেন? গাড়ি দরকার? যুবক চালককে বললো নিজের সঠিক গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি সরবোনের পুরানো আবাসিক ছাত্রবাসে সে থাকে। গাড়ির চালক যেতে রাজি হলে যুবক ঝটপট উঠে পড়লো গাড়ির ভিতরে। পকেট যে তার শূন্য সে খেয়াল তখন নেই। যুবক তখনো হাফাচ্ছিল। গাড়ির ভিতরে ঢুকে যেন প্রাণটা ফিরে পেল। পাঁচঘন্টার বেশি সময় লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। যুবকের বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। কিন্তু তার মধ্যে ঘুমে কখন যেন ঢলে পড়েছিল। ঘুম ভাঙ্গলো মধ্য রাত পার হয়ে গাড়ির চালকের ডাকে। সম্মানিত, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গেছেন। নেমে পড়ুন। যুবক দেখলো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে। সরবোনের ছাত্রাবাসটি এখান থেকে সামান্য দূরে। যুবক ঘোড়ার গাড়ির চালককে ছাত্রবাস পর্যন্ত যেতে বললে তিনি রাজি হলেন না। তিনি জানালেন, ‘সম্মানিত, রাত অনেক হয়েছে। আমাকে গৃহে ফিরতে হবে। এখান থেকেই সোজা আমার বাড়ি চলে যেতে চাই।’

যুবক আর কথা বাড়ালো না। রেনেসাঁ আর ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই বহুকিছু পাল্টে গেছে। ফরাসী বিপ্লবের পর সকল মানুষের সমঅধিকারের কথা ঘোষিত হয়েছে। যুবক গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। কিন্তু ভাড়া মিটাতে গিয়ে মনে পড়লো, পকেট কপর্দক শূন্য। গাড়ির চালক বিনীতভাবে বললেন, ‘না, না, আমাকে কিছু দিতে হবে না। আপনি হলেন ক্যাসলের অতিথি। ঠিক এ রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয়টি পথেই পড়বে, যখন একাই যাচ্ছি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই। সামন্ত-প্রভুদের যুগ যদিও নেই, কিন্তু ক্যাসলের মানুষদের কাছ থেকে কখনো আমরা ভাড়া নেই না।’ যুবকটি বিস্মিত হলো। চালক বিনয়ের সঙ্গে আবার জিজ্ঞেস করলো, সম্মানিত এত রাত্রে আপনি ফিরছিলেন কেন আর আপনাকে দেখছিলাম খুব হাফাচ্ছিলেন।’ যুবকটি চলকের কথায় মুগ্ধ হলো। চালককে তার ক্যাসল ভ্রমণের পুরো ঘটনাটা বললো। চালক সব শুনে চন্দ্রালোকে রহস্যময় মিষ্টি হাসি দিয়ে পোষাকের ভিতর থেকে তার হাত দুটি বের করে বললো, ‘মানুষটির হাত দুটি দেখতে কি ঠিক এমন ছিল?’ যুবক দেখতে পেল, গাড়ির চালকের হাতের পাঞ্জা দুটো ঠিক ঘোড়ার খুড়ের মতো। বিশেষ-তত্ত্বাধায়কের হাত দুটি রাতে সে যেমন দেখেছিল।

যুবক আর কথা না বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবন থেকে নিকটবর্তী ছাত্রাবাসের দিকে দৌড়াতে থাকলো। মনে মনে সে ভাবছিল, মধ্যরাতে ছাত্রাবাসের ফটক খোলা থাকবে কিনা। জনমানবহীন সড়ক দিয়ে দৌঁঁড়াতে দৌঁড়াতে চ্যাপেল পার হয়ে যুবক ছাত্রবাসের নিকটবর্তী হয়ে দেখতে পেল ফটক খোলা রয়েছে। প্রহরী একজন পাহারারত আছে এই গভীর রাতে। বয়স্ক প্রহরীকে সে চিনতে পারলো। যুবক খুব হাফাচ্ছিল তখন। প্রহরী এত রাতে তাকে ছাত্রাবাসের ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে দেখে বিস্মিত হলো। যুবকটি ছাত্রবাসে ফিরে স্বস্তি পেল। মধ্যরাত তখন পার হয়ে গেছে। ছাত্রাবাস নির্জন, সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। যুবকটিকে হাফাতে দেখে প্রহরী তার দিকে বসার জন্য একটি আসন এগিয়ে দিয়ে বসতে অনুরোধ জানালেন। প্রহরী বললেন, ‘মনে হলো, আপনি যেন অনেকটা পথ হেঁটে এসেছেন। ঘামছেন খুব। সঙ্গে সঙ্গে হাফাচ্ছেন।’ যুবকটি বুঝতে পারছিল না, কক্ষে ফিরে গিয়ে চোখে তার ঘুম আসবে কিনা বা ভিতরের অস্থিরতা কমবে কি না।

যুবকটি প্রহরীর কাছে জানতে চাইলো, ‘এতরাত পর্যন্ত জেগে আছেন যে আপনি?’ প্রহরীটি বললো, ‘আপনি বোধ হয় জানেন না, এখানকার চাকরিটি আমার আগামীকাল পর্যন্তই আছে। কাল সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এখান থেকে অবসর নিয়ে চলে যাচ্ছি। রাতে হয়তো সে কারণেই ঘুম আসছিল না।’ যুবকটির ভিতরের আতঙ্ক যায়নি, বয়স্ক প্রহরীর সঙ্গে কথা বলে সে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছিল। নিদ্রাহীন মানুষটিরও গল্প করতে ভালো লাগছিল। যুবকটি জানতে চাইলো, কতোদিন হলো আপনি এখানে চাকরিতে? প্রহরী জানালো, ‘যখন নেপোলিয়ন নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করেন ঠিক তার পরপরই যোগদান করি। যুবক বয়স তখন।’ যুবকটি বললো, ‘তাহলে বিশ বছরের কাছাকাছি চাকরি করলেন?’ প্রহরীটি বললেন, ‘ঠিক তাই? ফরাসী বিপ্লবের সময় সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। নেপোলিয়ন পনেরো বছর পর এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় চালু করলেন।’ যুবকটি বললো, ‘বহুকিছুই দেখেছেন তাহলে তাহলে আপনি।’ পরে জানতে চাইলো, ‘বিপ্লবের কথা কিছু মনে আছে?’ প্রহরীটি বললো, ‘থাকবে না কেন? নিজে আমি যোগদান করেছি তেরো বছর বয়সে। সবচেয়ে বড় কথা আমার মা যোগদান করেছিলেন নারীদের সেই শোভাযাত্রায়, যারা ভার্সাই থেকে সম্রাট ষোড়শ লুইকে বন্দী করে প্যারিসে নিয়ে এসেছিলেন।’

যুবকটি তাকিয়ে রইলো প্রহরীর মুখের দিকে। বিপ্লব সে নিজে দেখেনি। কিন্তু কতোবার কতোজনের মুখে ফরাসী বিপ্লবের কথা শুনেছে। যুবকটির পিতামহ যোগদান করেছিলেন ফরাসী বিপ্লবে। গির্জার বিশাল বিশাল ভূসম্পত্তির মালিকানা কেড়ে নিয়ে তখন মানুষের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। যুবকটির পিতামহ তখন নিজের বুদ্ধিবলে কিছুটা সম্পত্তির মালিক হতে পেরেছিলেন। কিছু জমি কিনে নিয়েছিলেন তার পিতামহ, সব কৃষকদের ভাগ্যে অবশ্য তা ঘটেনি। কৃষকরা তখন সত্যিই খুব দরিদ্র ছিল। খাবার জুটতো না। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতো প্রতি বছর, বিপ্লবের মূল কারণ তো ছিল সেটাই। কৃষকদের ক্রোধ আগ্নেয়গিরির মতো ফুসে উঠেছিল। বিপ্লবটা হয়েছিল খুব বড় আকারেই কিন্তু সাধারণ কৃষকদের ভাগ্য পাল্টায়নি। বরং বিপ্লবের পর যেন আরো খারাপ হয়েছিল। যুবকটির পিতামহ নিঃসন্দেহে লাভবান হয়েছিলেন বিপ্লবে, তিনি দরিদ্র কৃষক থেকে ধনী কৃষকে রূপান্তরিত হন। যুবকটি প্রহরীর কাছে জানতে চাইলো, ‘বিপ্লব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’ যুবকটির মনের আতঙ্ক যেন কেটে যাচ্ছিলো মানুষটির সঙ্গে গল্প করতে করতে।

যুবকের মুখটি নিরীক্ষণ করে প্রহরীটি বললো, বহু মানুষ তো গর্ব করে বিপ্লব নিয়ে। সারাবিশ্বে নাকি এমন ঘটনা আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি। কিন্তু আমার কাছে জানতে চাইলে বলবো ভিন্ন কথা। বিপ্লবে গির্জার ক্ষমতা কমেছে। গির্জাগুলি বিশাল সম্পত্তির মালিক ছিল। বুর্জোয়া মধ্যবিত্তরা বিপ্লবের ডাক দিয়ে গির্জার সেসব সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে। ভূস্বামী সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের নালিশ ছিল। সামন্ত-ভূস্বামীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলো ঠিকই, কিন্তু সম্পত্তি তাদের হাতেই থেকে গেল। নিজনিজ স্বার্থে ভূস্বামী-অভিজাত আর মধ্যবিত্ত বণিকরা পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেললো। বিপ্লবকে তো তারা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছিল। রাজতন্ত্রকে পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে চাইলো তারা নিজেদের স্বার্থে। সত্যি বলতে কি বিশপ আর পোপের সঙ্গেও প্রায় হাত মিলিয়ে ফেলেছিল। প্যারিসের সর্বহারা আর কৃষকরা যদি জ্যাকোবিনদের রক্ষা করবার জন্য রাস্তায় না বের হয়ে আসতো, দাঁতো আর রোবসপিয়েররা ক্ষমতা লাভ করতেই পারতো না। ফরাসী দেশের কৃষকরা রাস্তায় নেমেছিলো বলেই, জ্যাকোবিনরা রাজাকে গিলোটিনে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন।’ প্রহরীটি থামলেন সামান্য সময়ের জন্য। প্রায় চল্লিশ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যেন সে উৎসাহ বোধ করছে।

যুবকটি বললো, ‘যা বলছিলেন বলেন। আপনার অভিজ্ঞতা শুনতে বেশ লাগছে।’ প্রহরীটি বলতে শুরু করলেন, ‘যদি এক কথায় বলতে বলেন তাহলে বলতে হবে, যে-কৃষকরা বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি সাড়া দিয়েছিল, রাস্তায় নেমেছিল নিজেদের মুক্তি ঘটবে মনে করে, বিপ্লবে তাদের মুক্তি ঘটেনি। নিজে আমি কিশোর বয়সে মায়ের সঙ্গে মিছিলে গিয়েছি, বিপ্লবের জন্য আমার বাবা প্রাণ দিয়েছেন বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বিনিময়ে কৃষকরা কী পেয়েছে বলেন তো? বিপ্লবী-সরকার যাদের ভাগ্য পাল্টাবার কথা বলেছিল, তাদের জন্য কিছুই করেনি। রাজা ষোড়শ লুইয়ের মস্তিষ্ক কাটা পড়েছে, পরে বুঁরবো রাজবংশ আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। কৃষকরা যা ছিল তাই রয়ে গেল বরং তাদের উপর করের বোঝা বেড়েছে।’ বৃদ্ধ চুপ করলে যুবকটি বললো, ‘আপনার কথা অনেকটাই সত্যি। বিপ্লবীদের নিজেদের মধ্যেই ঐক্য ছিল না। নানারকম মানুষ যুক্ত হয়েছিল বিপ্লবে। বহুজন নিজেদের মতন করে সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিপ্লব থেকে কেটে পড়লো, রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল অনেকেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে তবুও বলবো, বিপ্লব সকল মানুষের সাম্যের কথা বলেছিল, বিশ্বে প্রথমবার সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা স্বীকার করে নেয়া হলো।’ প্রহরীটি এবার যেন কিছুটা ধৈর্য হারিয়ে বসলেন, ক্ষিপ্ত স্বরে চট করে বলে বসলেন ‘সকল মানুষের সাম্যের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে, সকলের সম্পত্তির নিরাপত্তা দেবার প্রতিশ্রুতি রেখেছিল সংবিধানে। সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়া মানে? সম্পত্তি তখন কাদের হাতে ছিল ভদ্রমহোদয়? বিপ্লব কাদের সম্পত্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল?’

যুবক কিছু মনে করলো না বৃদ্ধের অধৈর্যে। বৃদ্ধের কথাটিতো সত্যি। সম্পত্তি তখন ছিল রাজপরিবার, গির্জা, সামন্ত-ভূস্বামী, ধনী ব্যবসায়ী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, কারিগর, আইনজীবী আর বিদগ্ধ মানুষের হাতে। গির্জার সম্পত্তিগুলি অবশ্য ব্যক্তির হাতে ছিল না, ছিল প্রতিষ্ঠানের হাতে। সংবিধানে ব্যক্তির সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি গির্জার সম্পত্তি বিক্রি করে গির্জার সকল পুরোহিতকে বেতনভোগী করা হয়েছিল। যুবকটির চোখে বিপ্লবের বিরাট সাফল্য সেটা। বিপ্লবের পর পর ফরাসী দেশে যে সবগুলি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল তার কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছিল গির্জা নিয়ন্ত্রিত। বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও তখন ফরাসী দেশ সহ ইউরোপের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ধর্মচর্চার জায়গা। বিপ্লবের পর মাত্র একটি কলমের খোঁচায় ফরাসী দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। চালু হয়েছিল নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা সারা দেশ জুড়ে, সেখানে প্রাধান্য পেয়েছিল প্রাথমিক আর মাধ্যমিক শিক্ষা। যখন নেপোলিয়ন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেন, প্যারিস বা পুরানো এই সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়টিই মাত্র পুনরায় চালু করলেন নতুনভাবে। কিন্তু দেশের নানারকম যুদ্ধ বিগ্রহে সব টাকা ব্যয় হয়ে যাচ্ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয় তেমনভাবে আর্থিক সাহায্য পায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসী বিপ্লব স্বাধীনতা আর সাম্যের যে বাণী উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিল, নতুন পৃথিবী নির্মাণে তার ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়!

যুবকটি প্রহরীর কাছে স্বীকার করলো, ‘যথার্থ বলেছেন আপনি,ধনীদের সম্পত্তি রক্ষা করার কথাই বলা হয়েছিল। ফলে সম্পত্তি ঠিক রয়ে গেল ভূস্বামী আর মধ্যবিত্তদের হাতে। সমাজের তারা সুবিধাভোগী। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ফরাসী বিপ্লব সারাদেশের মানুষকে সাম্যের অধিকার দিয়েছিল।’ প্রহরীটি যেন মনে মনে কিছুক্ষণ আগে অধৈর্য্য হবার জন্য লজ্জা পেলেন। যুবকটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এবার ধীর লয়ে নরম সুরে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে বললেন, ‘সম্পত্তি কিছু মানুষের হাতে রেখে আর বিরাট সংখ্যক মানুষকে বঞ্চিত করে কি সকল মানুষের জন্য সাম্য সৃষ্টি করা যায়?’ যুবকটি তর্ক না করে স্পষ্টই বললো, ‘সত্যিকার অর্থে তা যায় না।’ যুবকটি নিজে আইনের ছাত্র, ফলে এ সত্যটি না বুঝবার কথা নয়। প্রহরী বললেন, ‘মহান রুশো বলেছিলেন মানুষের সাম্যের কথা। মহান রুশো বিপ্লবের সময় বেঁচে ছিলেন। বিপ্লবীরা তাঁর বাণীটি আবেগের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। বিপ্লবের প্রথম দিকের নেতারা কিন্তু তার প্রকৃত মর্ম বোঝেননি। বুঝলে হয়তো এই ঘোষণা করতেন না।’ যুবক বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে রইলো প্রহরীটির দিকে, যেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক কথা বলছেন।

যুবক বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘কিন্তু পরের দিকের নেতারা, দাঁতো, রোবসপিয়ের তো সমান অধিকারের তাৎপর্য বুঝেছিলেন? কী মনে হয় আপনার?’ প্রহরী বললেন, ‘নিশ্চয় রোবসপিয়ের বুঝেছিলেন। কিন্তু চারদিকে তখন নানারকম হট্টগোল চলছিল। হট্টগোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে মহান রোবসপিয়ের বুঝতে পারছিলেন না, কে বিপ্লবের শত্রু আর কে যে মিত্র। তিনি বিপ্লবকে রক্ষা করতে চেয়েই বিপ্লবকে ধ্বংস করলেন। তিনি সন্ত্রাসের রাজত্ব চালালেন। যিনিই রোবসপিয়রের মতের সঙ্গে একমত হতে পারতেন না, তিনি তাঁকেই শত্রু ভেবে গিলোটিনে পাঠাতেন। ভয়াবহ একটা সময় তৈরি করলেন মহান রোবসপিয়ের। বিপ্লবীরা পর্যন্ত বুঝতে পারছিল না কী ঘটতে যাচ্ছে আর কীসব চলছে বিপ্লবের নামে। বাইরের শত্রুরা তখন ঢুকে পড়েছে দেশের মধ্যে বিপ্লবকে বানচাল করতে। বহুদিক সামলাতে হচ্ছিলো তখন রোবসপিয়েরকে। তিনি দিশেহারা হয়ে সন্ত্রাস বাড়িয়ে দিলেন। নিজের মানুষরাই তখন হঠাৎ একদিন গিলোটিনে পাঠালেন মহান রোবসপিয়েরকে। ভিন্ন দিকে সাধারণ কৃষক আর সর্বহারা মানুষকে নিয়ে নেপোলিয়ন যুদ্ধে হারিয়ে দিলেন বিদেশী শক্তিকে। নিজের শৌর্যবীর্যের জন্য কিছুদিনের মধ্যেই নেপোলিয়ন হলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। বিপ্লবীদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছেই তখন। সেইরকম একটা অবস্থায় ফরাসী দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হলেন তিনি সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই। কৃষকরা বিতাড়িত হলো বিপ্লব থেকে। বিপ্লব ঠাণ্ডা হলো সেনাপতির হাতে। বিপ্লব হলো বটে, বিপ্লব নিয়ে সারাবিশ্বে এখনো আলোচনার শেষ নেই, কিন্তু দরিদ্র কৃষকরা কৃষকই রয়ে গেল।’ প্রহরীটি থামলেন।

যুবক সব কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রহরীকে বললো, ‘কাল আপনি অবসর নিয়ে চলে যাচ্ছেন আর আজই আপনার প্রকৃত পরিচয় জানতে পারলাম। যদি আজ রাতে আপনার সঙ্গে এভাবে দেখা না হতো, আপনার এসব অভিজ্ঞতার কথা জানতেই পারতাম না।’ প্রহরীটি বললেন, ‘হ্যাঁ, গভীর রাতে আপনাকে এভাবে আসতে দেখে আমি প্রথম খুব অবাক হয়েছিলাম। যখন কাছাকাছি এলেন চিনতে পারলাম। গভীর রাতে এভাবে কোথা থে‌কে এলেন আপনি? যখন প্রবেশ করেন তখন খুব হাফাচ্ছিলেন। কী হয়েছিল মহোদয়?’ নিজের ভিতরের রাতের সেই উত্তেজনা যুবকটি চেপে রাখতে পারলো না। নিজের মনের ভাব হালকা করার জন্য প্রহরীকে সব কথা খুলে বললো। প্রহরী সব শুনে খুব নির্বিকারভাবে বললো, ‘মহোদয়, হরহামেশা এমনটা ঘটে থাকে। চারদিকের মানুষকে চেনা বড় কঠিন। কখন যে মানুষ কোন বিচিত্র রূপে আপনার সামনে উপস্থিত হবে আপনি ঘটনার পূর্বে জানতেই পারবেন না।’ প্রহরীর কথা যুবকটির কাছে দার্শনিকের মতো শোনালো। মনে মনে ভাবলো, ফরাসী বিপ্লবের পর ভলতেয়ার মন্তেস্কু আর রুশো প্রমুখদের প্রভাবে কতো দার্শনিকরাই জন্মাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগে প্রহরীটিকে মনে হয়েছিল ইতিহাসবিদ আর এখন মনে হচ্ছে দার্শনিক। সাধারণ মানুষরা এখন চিন্তাভাবনা করতে পারছে, গির্জার প্রভাবে আর ঠিক অন্ধ নেই আগের মতো। যুবকটি বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ প্রহরীর কথার জবাবে বললো, ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, আপনার বক্তব্য খুবই মূল্যবান’।

দার্শনিক প্রহরীটি বললেন, ‘যা বললাম তা শুধু মূল্যবান নয়। এরকমটাই বাস্তব। ক্যাসলে রাতে যা আপনি দেখে এসেছেন, জীবনে বহুবার তা আবার দেখতে পাবেন। সকল ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। যুগ যুগ ধরে পিতামাতার কাছে এরকম গল্প কতো শুনেছি। মানুষের উপর দুষ্টচক্র ভর করে। ধরা যাক আমার হাত দুটি, এখন দস্তানায় ঢাকা। কিন্তু দস্তানাটা খুললে যে কী দেখতে পাবো কে জানে। শয়তানের নানানরকম কারসাজি আছে। শয়তানের পাল্লায় পড়লে নিজের উপর আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। হ্যাঁ সত্যি বলছি আপনাকে।’ যুবকটির যেন হঠাৎ দৃষ্টি বিভ্রম হলো। প্রহরীটি যেন তাকে বললো, ‘মহোদয়, বিশেষভাবে খেয়াল করে দেখুন তো, সেই মানুষ দুটির হাত ঠিক আমার এই হাত দুটির মতোই ছিল কি না?’ বলে প্রহরী নিজের হাত দুটির দস্তানা খুলে যুবকের সামনে মেলে ধরলো। যুবক দেখতে পেল, প্রহরীর হাত দুটিও তখন ঠিক সেইরকম; দুটো হাতের পাঞ্জা ঠিক ঘোড়ার খুরের মতো।’ যুবকটির মনে মুহূর্তে সন্দেহ দেখা দিলো। বুঝতে পারলো না সেকি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসে ফিরে এসেছে, নাকি ঠিক নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের মতো দেখতে ভিন্ন কোথাও। ঘোড়ার গাড়ির চালক চালাকি করে তাকে কি ঘুমের মধ্যে ভিন্ন কোথাও নামিয়ে দিয়ে গেছে। ক্যাসলের মানুষদের পাতা চক্রজালের মধ্যে কি সে আটকে পড়েছে এই রাত্রে? চারদিকেই কি এরকম জাল পাতা রয়েছে এদের, যেখানে সে এখন বন্দী?’

বিনয়ের সঙ্গে প্রহরীটি জানতে চাইলেন, ‘মহোদয় কি কিছু ভাবছেন? ধরুণ এই রাত্রে যদি এখন এরকম হাজার হাজার হাত আপনার সামনে এসে উপস্থিত হয়? কী করবেন তাহলে? বিপদের মুখোমুখি না হয়ে বিপদ থেকে পালাতে চাইছিলেন, তাই না? বিপদ এড়িয়ে না গিয়ে বিপদের মুখোমুখি হওয়াটাই কি আদর্শ নয়? বিপদ থেকে পালাবেন কোথায়? ফরাসী বিপ্লবে আমরা কৃষকরা যে লড়াই করলাম লাভ কী হলো? লড়াইটা বন্ধ করা ভুল হয়েছিল। লড়াইটাই চালিয়ে যেতে হয়। মানুষ হাত দিয়ে বিরাট বিরাট সব অপরাধ করে, ফলে দেখবেন সকলের হাত আর আপনার হাতের মতো নেই। সকলের হাত লোভে ঠিক আমার হাতের মতো হয়ে গেছে। ঘোড়ার খুরের মতো হাত নেই, হায়রে এমন সৎ মানুষ এখন পাবেন কোথায়? সকল প্রতিষ্ঠিত জায়গায় দুনিয়াটা এমন মানুষেই ভরে গেছে।’ যুবকটি বুঝতে পারছিল না সে সব কথা ঠিক শুনছে কি না। প্রহরী বললেন, ‘মহোদয়! ঘামছেন কেন আপনি? পানি খাবেন?’ কথাটা বলে প্রহরী নিজের খুরওয়ালা সেই হাত দিয়েই ঝকঝকে তকতকে স্বচ্ছ পানি সহ কাচের একটা পাত্র এগিয়ে দিলেন যুবকের দিকে। বললেন, ‘নিন পানিটা খেয়ে নিন, আপনি পিপাসার্ত।’ যুবকটি আর কথা বলতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে নিজের আসন থেকে মেজেতে লুটিয়ে পড়লো।

পরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলো সে নিজের আবাসিক ছাত্রাবাসে নিজের কক্ষেই শুয়ে রয়েছে। ছাত্রবাসের শিক্ষার্থীরা আরো কিছু কৌতুহলী মুখ তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। নিজের দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও দেখতে পেল? বন্ধু দুজন জানতে চাইলো, ‘কী ব্যাপার, কী হয়েছিল তোমার? ছাত্রাবাসের ফটকের সামনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে কেন? ছাত্রাবাসের প্রহরীটি খবর দেবার পর তোমাকে আমরা কক্ষে নিয়ে আসি?’ কক্ষের জানালা দিয়ে দিনের আলো প্রবেশ করেছে। দিনের উজ্জ্বল দিগন্ত উদ্ভাসিত আলোতে সব কথা আবার তার মনে পড়লো। কিন্তু কাউকে সে কিছুই বললো না গতরাতের ঘটনা সম্পর্কে। সামান্য কিছুটা উঠে সে খা‌টে বসলো হেলান দিয়ে। বন্ধু দুজন আবার জানতে চাইলো, ‘কী ব্যাপার কথা বলছো না কেন?’ কিন্তু বললো না সে কিছুই। চুপ করে রইলো। বন্ধুদের একজন বললো, ‘চিকিৎসক তোমাকে দেখে গেছেন, কিন্তু তোমার জ্ঞান হারাবার কারণ ধরতে পারেননি। জ্ঞান হারাবার আগে কী হয়েছিল কিছু মনে আছে?’ যুবকটি তবুও নিরুত্তর। কথা বলতে সে ভয় পেল, যদি সবাই সেইরকম হাত বের করে ফেলে তার সামনে হঠাৎ। কী করে সে বুঝবে, চেনা মানুষগুলির কারো কারো হাতের পাঞ্জা দুটি যে ঘোড়ার খুরের মতো নয়! কিছু মনে হওয়ায় নিজের হাত দুটি সে হঠাৎ ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। বারবার নানাভা‌বে পর্য‌বেক্ষণ কর‌তে থাক‌লো নি‌জের হাত দু‌টি। নি‌জে‌কে নি‌য়েই যেন স‌ন্দেহ হ‌তে শুরু করে‌ছিল ম‌নের ভিত‌রে। সকল‌কে জানার অা‌গে নি‌জে‌কে চেনার চেষ্টা কর‌লো। সক্রেটিস সেই যে বলেছিলেন ‘আগে নিজেকে জানো’।