প্রতীকী ছবি
রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘ত্রিপুরার উদয়পুর ভ্রমণ’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২০, ২০১৯
গতকাল সকালে ঢাকা থেকে ত্রিপুরা বেড়াতে এলাম। রথ দেখা কলা বেচা দুটাই উদ্দেশ্য। ত্রিপুরা বেড়ানোর সঙ্গে গোমতী জেলার উদয়পুরের একটা নাট্য উৎসবে যোগদান। নাট্য উৎসবে রাজশাহী থেকে নাটক মঞ্চস্থ করতে এসেছে অনুশীলন নাট্যদল। দলের কর্ণধার অধ্যাপক মলয় ভৌমিকের উৎসাহে এবার আসা। গতবার একটা প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আসার কথা ছিল, শারীরিক অসুস্থতার জন্য শেষপর্যন্ত আসা সম্ভব হয়নি। ফলে এবার না এলে অন্যায় হতো। তারচেয়ে বড় কথা, না এলে আমি নিজেই অনেক কিছু উপভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতাম। হারাতাম উদয়পুরের পাখি ডাকা সকাল আর স্নিগ্ধ পরিবেশ। সবচেয়ে মন জুড়ানো বিশাল একটা বড় দিঘি টাউন হলের কাছে বড় রাস্তার পাশে। যা আজকাল আর শহরে দেখা যায় না, যা আগে অনেক শহরেই ছিল ছোট বড় পুকুর, তা আবার উদয়পুরে পেলাম। রাজধানী আগরতলায় এরকম প্রচুর পুকুর দেখা যায়।
সীমান্ত পার হয়ে ষাট কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরার উদয়পুর গোমতী নদীর পাশে। ষাট কিলোমিটার পথের দুপাশের প্রকৃতিক শোভা নয়ন জুড়ানো, মন মাতানো। সীপাহীজোলা পার হয়ে এখানে আসতে হয়। আমি সিপাহীজোলাতে আগে বেড়িয়ে গেছি সেখানকার জঙ্গলে, কর্তা ব্যক্তিরা সেবার দুপুরে চমৎকার মধ্যাহ্নভোজ খাইয়ে ছিলেন। ক্রিপুরা সরকারের দেয়া চমৎকার গাড়ি ছিল সঙ্গে। নাট্যদলের পাঠানো এবারের গাড়িটা পুরানো, ভাঙাচোরা। তার মধ্যে আমরা তেরোজন। কিন্তু গাড়িটাতে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। চালক ছিলেন চমৎকার। কিন্তু আমি এসব লক্ষ্য না করে, সহযাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা না দিয়ে পথের দু‘ধারের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করেছি। তখন বেলা আড়াইটা-তিনটা বাজে, দুপুরের খাবার খাইনি কেউ। তবু পথটা আমাকে এতটা মুগ্ধ করেছিল, মনে হলো এ পথ যদি না শেষ হয়।
সহযাত্রীরা মানে অনুশীলনের সদস্যরা সবাই সারারাত না ঘুমিয়ে ট্রেনে বসে বসে ভ্রমণ করে রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছে। ঢাকা থেকে আবার জেগে জেগে সকাল আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত আখাউড়া ভ্রমণ। আর আমি তাদের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছি ঢাকা থেকে সকালবেলায়। মলয়দাকে বহুদিন ধরে চিনি, দলের অন্যদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিদের সঙ্গে আখাউড়ার একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা খাবার সময় খানিকটা গল্প সবার নাম পরিচয় না জেনে। সকালের নাস্তা আমি বেশি খেলাম সাড়ে এগারোটায়, দুপুরের খাবার কখন জুটবে অনিশ্চিত। দলের সঙ্গে অনেকে প্রথমবার যাচ্ছে ভারতে। ফলে খাওয়ার চেয়ে সীমান্ত পার হবার উৎসাহ তাদের বেশি। সীমান্ত পার হবার ঝামেলাগুলি জানা নেই অনেকের। তারপর বেশ হৈ চৈ করে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা ভোগের পর তেরোজনের চারঘণ্টায় সীমান্ত অতিক্রম করা হলো। সীমান্তের বাইরে আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছিলেন প্রদীপ সূত্রধর। প্রদীপ বিহনে সবই অন্ধকার। সীমান্ত পার হওয়ার পর প্রদীপ আলো হয়ে দেখা দিলেন।
দুপুরের খাবার না খেলেও সীমান্ত পার হতে গিয়ে সাহেবদের বা উর্দিপরাদের ধমক যে খাইনি, তা নয়; সেই, সঙ্গে সহবত শিখিয়েছেন অনেকে। দু’একবার কঠিন কথা বলার ইচ্ছা হলেও চুপ করেই থেকেছি। বয়স বহু কিছু শেখায়। তবে ঠিক, আবার দু’একজায়গায় সমীহ দেখালেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। বিশেষ করে বিজিবির দায়িত্বে ছিলেন যে দুজন মহিলা, সাধারণ কর্মকর্মা দুজনের মনোভাব ছিল খুবই পেশাদারিত্বপূর্ণ। সকলের সঙ্গে তাদের আচরণ ছিল যেমনটা হওয়া দরকার। বাংলাদেশ কাস্টমসের লোকরা আমাদের সম্মান দেখিয়েছেন তবে পরিচয় পাবার পর। বাকি অনেককে হেনস্তা করতে ছাড়েননি। কিন্তু আমরা তেরোজন যাত্রী এমন একটা উৎসাহ নিয়ে আর গল্পগুজবে, হাস্য-তামাশায় সীমান্ত পার হচ্ছিলাম যে, কিছুই গায়ে লাগেনি। দলনেতা মলয় বাবু অবশ্য মাঝে মাঝে অস্থিরতায় সুযোগ মতোই ধূমপানে নিমগ্ন হচ্ছিলেন। গ্যাং লীডার বলে কথা! তিনি সর্দিজ্বর, ঠাণ্ডা এসব নিয়ে পথ চলছিলেন কোনো অভিযোগ ছাড়াই। সিগারেট তাকে ভরসা দিচ্ছিলে।
যখন উদয়পুর পৌঁছালাম বেলা প্রায় চারটা, থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর দুপুরের খাবার খেলাম পাঁচটায়। খাবারের সামান্য বা পরিমিত আয়োজন চমৎকার, পরিবেশনা আর আন্তরিকতায় অসাধারণ। খুব পরিশ্রম করে আর অর্থকষ্টের ভিতর দিয়ে সাহস আর আন্তরিকতায় নাট্য উৎসবটা করছেন এখানকার নাট্যদলটি। দলটির নাম লিটল ড্রামা গ্রুপ। দলের কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন গৌতম সাহা, রঞ্জিত গোস্বামী, প্রদীপ সূত্রধর, অমিতাভ প্রমুখ। তাদেরকে সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ দিতে হয় অনুশীলনের নাট্যকর্মীদের চব্বিশ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় সামান্য বিশ্রাম ছাড়া কতে প্রাণবন্তভাবে পরের সব দায়িত্বগুলি পালন করে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় অনুশীলনের কর্মী আলো আর তার ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলন মৈত্র দুজনে বিশ মিনিটের একটা নাচ দেখালেন, রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায় অভিশাপ’ যা দেখে মুগ্ধ হলাম। ঢাকার নামিদামি শিল্পীদের নাচ দেখে ততটা মুগ্ধ হতে পারি না। দুজনেই, চব্বিশ ঘণ্টায় সামান্য বিশ্রাম ছাড়া মঞ্চে কী অনবদ্য আর সাবলীলভাবে নাচলেন! তাদের নাচের মুদ্রা, চোখের ভাষা, দেহের ছন্দ অনেক শিল্পীর ইর্ষার কারণ হবে। শিল্পের জগতে ইর্ষার ব্যাপারটা খুব চলে, কখনো কখনো প্রশংসা নেতিবাচকভাবে ইর্ষায় রূপান্তরিত হয়। দুই ভাইবোনের শারীরিক গঠন যেন মঞ্চকলায় অংশ নেবার জন্যই। আবার সেই তারুণ্যের প্রশ্নটি এসে যায় তাদের দেখলে, তাদের প্রাণবন্ততায়।
বর্তমানে যে বয়সে এসে দাঁড়িয়ে আছি, মানুষের বড় বড় দালানকোঠা, বিত্ত বৈভব দেখে ইর্ষান্বিত হই না, সেগুলি পাবার জন্য লালায়িত থাকি না; কিন্তু এই যে তারুণ্য প্রাণবন্ত সর্বদা তার দিকে তাকিয়ে ভাবি, যদি সেটা ফিরে পেতাম। বর্তমান বয়সের অবশ্যই একটা সৌন্দর্য আছে তার সঙ্গে তারুণ্যর শক্তি আর উদ্দামতা থাকতো, মনে হতো সেটাই শ্রেষ্ঠ সময়। আবার ভাবি, আমাদের পিতামাতারা কতে তারুণ্যকে গলাটিপে মারছেন। ভীতু আর আয়েসী করে গড়ে তুলছেন। ভদ্রঘরের পিতামাতারা এখন তাদের সন্তানকে তাদের মনের মতো করে প্রতিবন্ধি বানাচ্ছেন বিলাসিতা আর তাদের মিথ্যা আভিজাত্য প্রমাণের জন্য।
সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন আমি এটা লিখছি চুপচাপ, আমাদের মহান নাট্যকার আর নাট্য নির্দেশক মলয় ভৌমিক তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। সর্দিজ্বর নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছেন, তার আসলে দীর্ঘ বিশ্রাম দরকার। আমার আর একা একা কী করা, এ বার্তাটা লিখলাম। গতকালকের প্রাণ জুড়ানো ভ্রমণের কথাটা না বলতে পারলে যেন পারলে আমার পেটের ভাত হজম হচ্ছিলে না।