
রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘তরুণদের নতুন দল’
প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২৫
নতুন লক্ষ্য নিয়ে নতুন উচ্ছ্বাসে ভরপুর হয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে তরুণরা। এই উদ্যোগকে সর্বান্তকরণে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের অভাব নেই। বহু দলই ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। বহু দল ক্ষমতায় যাবার মতন সক্ষমতা অর্জন করেনি। বহু দল নানাভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। বহু দল হারিয়ে গেছে। কয়েকটি দল ঘৃণ্য চরিত্র অর্জন করেছে।
তরুণরা কয়েক বছর আগেও একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে জনগণের আস্থা আর অর্জন করার জায়গায় যেতে পারেনি। বাংলাদেশে অনেকেই মনে মনে বহুদিন ধরে একটি গণমুখি বাস্তববাদী রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছিল, যারা হবে দুর্নীতিমুক্ত গঠনমূলক ও চিন্তা-চেতনায় ধারালো ও মতাদর্শ দ্বারা শাণিত; যারা যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে ছড়ি ঘুরাবে না।
কবে সেরকম দলের দেখা মিলবে বা দ্রুত কিংবা আদৌ কখনো মিলবে কিনা, বাংলাদেশের মানুষ সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশে কিছুদিন আগে ভয়াবহ এক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি গণ অভ্যুত্থানের পর, নানারকম অস্থির সময় পার করছিল দেশের আপামর মানুষ। সেই রকম সময় একটি নতুন দলের ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। যদিও আমরা এখনো নিশ্চিত নই, এই দলটি কোন পথে হাঁটবে কিংবা বৃহত্তর জনগণের আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ করতে পারবে। ফলে এখন অপেক্ষা করার পালা আমাদের।
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল সফল হতে চাইলে দেশের কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের স্বার্থ নিয়ে তাদেরকে ভাবতেই হবে। বৃহত্তর জনগণের ভাগ্য পাল্টানোই হবে এ সময়ের একটি আদর্শ রাজনৈতিক দলের কাজ। ভিন্ন দিকে একই সঙ্গে সংখ্যার দিক থেকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা হবে তাদের আর একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ঠিক একইভাবে, সংখ্যালঘু হিসেবে বাংলাদেশে যারা বহুকাল ধরে চিহ্নিত হয়ে আসছে তারা যাতে নিজেদেরকে এদেশে বাকিদের সমান মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক ভাবতে পারে, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি না করা গেলে নতুন রাজনৈতিক দলটি মতাদর্শগতভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য।
বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে এমন একটি অধিকার বোধ তৈরি করা দরকার, যেখানে কেউ নিজেকে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু হিসেবে দেখবে না। সবাই মনে করবে, তারা এদেশের সম্মানিত নাগরিক। রাষ্ট্রের ভিতরে সবাই একই রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। গণতন্ত্র তুলনামূলক ভালো শাসন ব্যবস্থা, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা নয়। কারণ তা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই মূল্য দেয়। সংখ্যার বিচার দিয়ে তাকে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা সেটাই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সবার মত ও অধিকার রক্ষা করা হয়।
স্বৈরশাসন বলতে কেবলামাত্র এক ব্যক্তির ইচ্ছাকেই সবার ওপরে চাপিয়ে দেয়া বোঝায় না, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় তাদের মিলিত ইচ্ছাকে সংখ্যালঘুর ওপর চাপিয়ে দেয় সেটাও স্বৈরাচার। স্বভাবতই সেটা সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচার সংখ্যালঘুর প্রতি। ফলে সেটা কোনো সুশাসন নয়, যেখানে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করা হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করার কথা বলা হচ্ছে। স্মরণ রাখতে হবে, তার প্রতি করুণা দেখানোর কথা বলা হচ্ছে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের দয়া নয়, সাংবিধানিকভাবেই সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করা দরকার। সেটা হতে হবে সবক্ষেত্রেই।
ধর্ম দিয়েই যে কেবল সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু চিহ্নিত হয় তা নয়, নানা রকম মতাদর্শের প্রশ্নে, জীবন যাপনের প্রশ্নে, পোশাক-খাদ্য গ্রহণের দ্বারাও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর প্রশ্নটি এসে যায়। ঠিক যেমন নিরামিশ কিংবা আমিষ ভোজি এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু প্রশ্নটি সামনে চলে আসবে। ভারতের এমন কিছু পবিত্র স্থান রয়েছে, সেখানে ধর্মীয় বিধান বলে অন্যরা নিরামিষ খেতে বাধ্য। কারণ সেখানে প্রাণীজ আমিষ খাদ্য গ্রহণ নিষিদ্ধ।
প্রাচীন ভারতে চার্বাকরা ছিলেন মতাতর্শের প্রশ্নে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রাহ্মণরা যাদের নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। চার্বাকরা কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল না। তবুও তাদের মতের স্বীকৃতি দিতে চায়নি ব্রাহ্মণরা। বিজ্ঞান আজ চার্বাকদের মত গ্রহণ করেছে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বর্তমান ভারতে যেমন সকলের গোমাংস খাওয়ার স্বাধীনতা নেই। আসলে একটি সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলতে গেলে প্রতিটি মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা থাকতে হবে। কতিপয়ের পছন্দ অপছন্দ কোনোভাবেই অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
সেটা করা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা গুণ্ডামির নামান্তর। সেইরকম কিছু করা মানেই স্বৈরশাসন ও বৈষম্য প্রতিষ্ঠা করা। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, সম্প্রদায়ের নামে, বিশেষ কোনো ধর্মগ্রন্থের নামেও যদি সেটা করা হয়; তাহলে সেটা বৈষম্যই হবে। প্রাচীন ভারতে বর্ণপ্রথার নামে, ঐশ্বরিক গ্রন্থ বেদের নামে মানুষকে বর্ণপ্রথার অজুহাত তুলে বছরের পর শূদ্র বা দাস বানিয়ে রাখা হয়েছিল। ভয়াবহ এক বৈষম্য তৈরি করা হয়েছিল ঐশ্বরিক ধর্মগ্রন্থকে বারবার সামনে টেনে এনে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা তাদের রাজনৈতিক দলে এমন কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করবে কিনা ধর্মের প্রশ্নে, জাতপাত বা ভাষার প্রশ্নে সেটা গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন ও সর্বপ্রধান প্রশ্ন। সকল মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সেখানে থাকবে কিনা সবার আগে এই প্রশ্নটি আসবেই। কারণ জুলাইয়ের আন্দোলনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি এসেছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ ছিল সেটা।
দলটিতে সকলের স্থান সমতা মতন থাকবে কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন? সকল ধর্মের, সকল বয়সের মানুষের স্থান সেখানে হবে কিনা, নারীদের সংখ্যা সেই জনসংখ্যার সমতা রক্ষা করবে কিনা? কৃষক-শ্রমিক বা মজদুররা সেখানে স্থান পাবে কিনা? এইসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। জুলাইয়ের আন্দোলনে শ্রমিক-মজুরদের বিরাট ভূমিকা ছিল। সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? বারবার এটাকে তারুণ্যের দল বলা হচ্ছে।
সেখানে প্রশ্ন দাঁড়ায়, বাংলাদেশের তরুণরা আর বয়স্করা কি তবে এই দেশের দুটা আলাদা সম্প্রদায়? বয়স্করা বয়স্কদের ভোট দেবে, তরুণরা তরুণদের ভোট দেবে এটা কি এমন দ্বিধাবিভক্ত একটি বিষয়? তাহলে কি ধরে নিতে হবে, গত আন্দোলনে তরুণ ছাড়া বয়স্কদের কোনো ভূমিকা ছিল না? ভবিষ্যতের কোনো আন্দোলনে তাহলে কি বয়স্কদের আর দরকার নেই? প্রায় শোনা যায়, বহু সন্তানরা নাকি তাদের বৃদ্ধ পিতামাতাকে বাতিল বলে গণ্য করে। বাংলাদেশের সম্মানিত নতুন তরুণ রাজনীতিবিদরা কি তাহলে তরুণদের ছাড়া আর সকলকে ইতিমধ্যেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন?
বাংলাদেশের চাকরিতে অবসর গ্রহণের বয়স সীমা কি তাহলে চল্লিশ এ নেমে আসবে? আসলে তরুণদের রাজনৈতিক দল মানেটা কি? বিশ্বের কোথায় কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দল কি এভাবে গঠিত হওয়া সম্ভব? তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে কি আট মাসের ইতিহাসই একমাত্র সত্য, তার আগের সবটাই কি মিথ্যা?
খুব ভালো করেই আমি জানি, তরুণরা গর্ব ভরে মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করেছে। কিন্তু আবার ইঙ্গিতে এমনটাও বলেছে, পিছনের দিকে তাকালে চলবে না। পিছনের দিকে না তাকিয়ে কি কখনো সামনে আগানো যায়? সত্যিকারভাবে যে সামনে আগাতে চায়, সে পিছনে ফিরে তাকাতেও ভয় পায় না। তারুণ্য অবশ্যই একটা শক্তি, সাহসের প্রতীক। সেটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে বিপদ। বিপদ নয় কেবল, ভয়াবহ বিপদ। সে কারণেই কয়েক বছর আগে গঠিত তরুণদের দলটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
মনে রাখতে হবে, সব তরুণরাই বৃদ্ধ হবে, তারুণ্য এক জায়গায় দাঁঁড়িয়ে থাকে না। স্মরণ রাখতে হবে, সব তারুণ্য মিছিলে যায় না, সব বয়স্করাও ঘরে বসে থাকে না। একথা সত্য না হলে, হাসিনা আরো সাত বছর আগে ক্ষমতা ছাড়তো। তারুণ্য লোভি হয়, লুটপাটে অংশ নেয়, তারুণ্য অস্ত্র হাতে নারীকে অসম্মান করে, ভাইয়ের বুকে ছুরি চালায়।
তারুণ্য ফ্যাসিবাদের দোসর হয়, ফ্যাসিবাদের ত্রাণকর্তা হতে লজ্জাবোধ করে না। ফলে তারুণ্য মানেই একটা পবিত্র কিছু তাও নয়। মনে রাখতে হবে, ঘটনার স্রোত দ্বারা, পূর্ব বাস্তবতা দ্বারা পরের বাস্তবতা নির্মিত হয়। বহু মানুষের সেখানে ভূমিকা থাকে। শুধু তারুণ্য একা থাকে না।
নতুন দলকে আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে আশা করি সকল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, বিশ্বের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে নিশ্চয় তারা আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেবেন। ক্ষমতার মোহের চেয়ে জনতার মঙ্গলের কথা ভেবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
কারণ তাঁদের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার জন্য হাতে এখনো অনেক সময় রয়েছে। জনগণের ভাগ্য পাল্টাতে চাইলে ঔপনিবেশিক আইন ও বিচারব্যবস্থা পাল্টাতে হবে সবার আগে, শিক্ষার বাহন হিসেবে, অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে মাতৃভাষাকে সবার আগে স্থান দিতে হবে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে, মানুষের মননশীলতাকে সম্মান জানাতে হবে।
সকল মানুষের প্রতি সমতার নীতি প্রদর্শন করে এমন এক সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তা সারা বিশ্বের কাছে একটা গ্রহণযোগ্য উদাহরণ হয়। নিজ দেশের মানুষের স্বাধীনতার কথা থাকবে সেখানে, একই সঙ্গে সকল দেশের মুক্তিকামী নাগরিকদের জন্য সেখানে মৈত্রীর বন্ধন এবং সম্মান ঘোষিত হবে। সস্তা কথাবার্তা, মন ভোলানো কথা বার্তা না বলে প্রতিটা বাক্য খুব হিসেব করে উচ্চারণ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক