রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘গত কদিনের ঘটনায় আমার প্রতিক্রিয়া’
প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২৪
মঙ্গলবার দেখলাম ভয়াবহ সব ডাকাতি হয়েছে। কারা এসব করেছে? কাদের হাতে অস্ত্র আছে? পনেরো বছর ধরে কারা অস্ত্র পেয়েছে? ক’দিন ডাকাতির ব্যাপারে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তদের তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে হবে। ছাত্রদের কিছুই করার ছিল না। পরাজিত শক্তি যেসব অপপ্রচার করছে এবার তার কিছু জবাব দেই। তার আগে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পরের রাষ্ট্রের কিছু সংবাদ বা চিত্র দেই।
১৯৭২ সালে শেখ মুজিব ক্ষমতা নেন তখনো এরকম ঘড়বাড়ি পোড়ানো, ডাকাতি এবং থানা লুট হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে। সেই সময়ের দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক এবং সংবাদ পত্রিকা দেখুন। সব পত্রিকা এ মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নেই। যা হাতের কাছে আছে তা থেকে সামান্য কিছু তুলে ধরছি। দৈনিক সংবাদে ১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবরের সংবাদের শিরোনাম, ‘সশস্ত্র ডাকাত দল গ্রাম-বাংলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে’।
একই পত্রিকায় সেই বছরের ১৫ অক্টোবরের সংবাদ, অস্ত্রশস্ত্রসহ ডাকাত ধরা পড়ে ছাড়া পেল। ১৮ অক্টোবরের শিরোনাম, বিক্রমপুরের সর্বত্র ত্রাশের রাজত্ব। ২১ তারিখে সংবাদে লেখা হয়, ডাকাতি রাহাজানি খুন খারাবির ভয়ে সমস্ত দেশবাসীর দাবি দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে জানমালের নিরাপত্তা চাই। সংবাদ পত্রিকায় ১৯৭২ এর ২৮ অক্টোবরের শিরোনাম, ডাকাতি ছিনতাই লুট ও নরহত্যা দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত। ৩০ তারিখে সংবাদে বলা হয়, ‘ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, নারীধর্ষণ অপরাধীদের শাস্তির খবর নেই’।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এসব খবর সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ভরা। নাটকগুলো পড়ুন তখনকার, এই একই ঘটনা পাবেন তার মধ্যে। সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলায় ১৯৭২ সালের ১ নভেম্বরের শিরোনাম: দেশের সর্বত্র ডাকাতি রাহাজানি খুন ও লুটতরাজ। নভেম্বরের ২৩ তারিখে একই পত্রিকার সংবাদ: ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, খুন, চোরাচালানের রেকর্ড সৃষ্টি। সরকারি পত্রিকার ভাষ্য এসব। বর্তমান হাসিনার সমর্থক শক্তি এসব খবরের কী জবাব দেবেন? এরকম বহু তথ্য আছে সেই সময়ের পত্রিকার পাতায় পাতায়। কী জবাব দেবেন এসবের?
আপনাদের আমাদের বঙ্গবন্ধুর শাসনে এসব ঘটেছে, এসব নতুন নয়। তখন স্বাধীনতার পরপর, পরদিন ১৭-১৮ তারিখ থেকেই এসব হয়েছে; এরকম অনেক কিছু হয়েছে। এসব নিয়ে লিখতে চাইছিলাম না। লিখতে অনেকে বাধ্য করলেন। আওয়ামী লীগের বহু স্থানীয় নেতাদের দ্বারা যে এসব হয়েছে পত্রিকার সংবাদে তা আছে। রাজাকারদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এমন করেছেন, সে সংবাদ আছে অনেক। পত্রিকা ঘাটলে এমন সব খবর বের হবে, কথা বলতে পারবেন না তখন। ফলে আন্দোলন সম্পর্কে আপনারা মতামত দেন, কিছুই প্রশ্নের ঊর্ধে নয়। কিন্তু একপেশে মিথ্যাচার করবেন না। সবকিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেন।
যারা বর্তমান কয়েকদিনের নানারকম ডাকাতি, মানুষের ঘরবাড়ি আক্রমন, ভাঙচুর নিয়ে আন্দোলনের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন, বোঝা যায় সেটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত একটা কৌশল। সঙ্কটের মূল কারণ না খুঁজে তারা সুকৌশলে আন্দোলন হেয় করার চেষ্টা করছে। যা যা ঘটেছে তার প্রতিটা ঘটনা দুঃখজনক, তার জন্য নিন্দা জানাই। কিন্তু পরাজিত শক্তি বারবার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, এর জন্য দায় কার তা বলছেন না। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ক্ষমতায় নেই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নেই। ফলে হাসিনার রেখে যাওয়া রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান এখন রাষ্ট্রের সকল দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।
রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায় এখন তাদের। কিন্তু তারা তা পালন করছেন না কেন? সারাদেশকে তারা বিশৃঙ্খলা অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখেছেন কেন? মানুষের যে দুর্গতি, যে দুর্ভোগ পোহাতে হলো এবং হচ্ছে তার দায় তবে কাদের? আন্দোলনকারীরা এখন ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতার প্রধান ব্যক্তি এখন রাষ্ট্রপতি। হাসিনা মনোনীত এই রাষ্ট্রপতি কোন উদ্দেশ্যে পুরো রাষ্ট্রকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে রাখলেন? ভিন্ন দিকে পরাজিত শক্তি তাঁদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বারবার আন্দোলনকে আক্রমণ করছেন কোন অসৎ উদ্দেশ্যে? হাসিনা সরকারের এবং তার দালালদের মিথ্যাচারের বহু নমূনা দেখেছেন মানুষ আন্দোলন চলাকালে, এখন তা আবার ভিন্নরূপে উপস্থিত হচ্ছে। লক্ষ্য করবেন, এই পরাজিত শক্তি ঘরবাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর এসব নিয়ে কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে ফেলছে। কিন্তু আন্দোলনে হাসিনার দ্বারা এত মানুষের মৃত্যুর জন্য একবারও দুঃখ প্রকাশ করেনি। ফলে এদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বুঝতে ভুল করবেন না।
বর্তমান সময়টা আমরা ভালো আছি। কিছুদিন আগে হাসিনার শাসনে খুব খারাপ ছিলাম। তিনি প্রতিদিন বহু ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছেন। তিনি আন্দোলনে পদত্যাগ করলে কিছু সঙ্কট সৃষ্টি হয়। সেটা হলো, তিনি গোপনে পদত্যাগ করে চলে যান। তিনি পদত্যাগ করার পর দেশে এখন সরকার নেই। দেশের সকল ক্ষমতা এখন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের হাতে। দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়া এখন তাদের দায়িত্ব। কিন্তু তারা দুজন তা করেননি। দুজনেই তারা হাসিনা সরকারের দ্বারা নিয়োগ পাওয়া। আর্মি প্রধান হলেন হাসিনার পিসতুতো বোনের স্বামী। দুজনে তারা পুরো দেশকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখেন। সেই অবস্থায় কিছু কিছু ভাঙচুর হয়, কিছু মানুষের বাড়িঘর লুটপাট হয়। কিছু মন্দির আক্রমণ করা হয়।
আমার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর বাসায়। তার পিতার দোকানে হামলা হয়। ছাত্রীটি খেয়ে না খেয়ে আন্দোলন করেছে পুরো সময়টা, কিন্তু তার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন বলে হামলা চালায় বিএনপির স্থানীয় নেতা। সঙ্গে সঙ্গে আমি বিএনপিতে যাদেরকে চিনি, তাদেরকে জানাই। তারা বলেন, আমরা এটা অবশ্যই দেখবো। বিএনপির দ্বারা এরকম কিছু অঘটন ঘটেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু সবটা কারা করেছে, বলা কঠিন। কিছু কিছু ধারণা করা যায়। কিন্তু এসব ঘটানোর পেছনের আসল অসৎ উদ্দেশ্য হচ্ছে, আন্দোলনকে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা। মানুষ যে আন্দোলনকে খুব মহান মনে করেছিল, তাকে যাতে খারাপ চোখে দেখে। যারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনবিরোধী ছিল, ফলে প্রচ্ছন্নভাবে এসব তাদের দ্বারাই ঘটেছে। হিসাব মেলালে সেটাই প্রমাণ হবে।
লুণ্ঠন চলছে শুধু হিন্দুর বাড়িতে নয়, মুসলমানদের বাড়িতেও। আগে আওয়ামী লীগ গুণ্ডারা বিএনপিকে এলাকা ছাড়া করেছে, এখন বিএনপি শোধ তুলছে। সেটা হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক। তবুও আমরা একে সমর্থন করিনি। তবে সবটা বিএনপির দ্বারা হয়নি, সুযোগ সন্ধানিরা বেশি করেছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও করেছে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। ধরাও পড়েছে তারা। যখন আন্দোলন চলে, তখনই সরকার মন্দির ভেঙে হিন্দু মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ লাগাতে চেয়েছে, যাতে আন্দোলনকে দুর্বল করা যায়। যখন আন্দোলন চলে তখন আন্দোলনের নেতারা এসব ষড়যন্ত্র টের পায়। ফলে আন্দোলনের নেতাদের ভিতরে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ষড়যন্ত্র যাতে সাফল্য লাভ না করে তার জন্য তখন আন্দোলনকারীরা হিন্দুদের মন্দিরগুলো পাহারা দিয়েছে। কিন্তু হাসিনা পদত্যাগের পর যা ঘটেছে তার দায় রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের। তারাই এখন সরকার। কারণ এখনো নতুন সরকার আসেনি।
হাসিনা পদত্যাগ করার পর খুনী পুলিশরা নিজেদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে পুলিশ কার্যত নাই এখন। কিন্তু তারা তাদের হাতের অস্ত্র নিয়ে কোথায় কী করছে তাও জানতে পারছি না। রাষ্ট্রপতি ভবনে কী ঘটছে জনগণ জানতে পারছে না। হাসিনা পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান তার বক্তৃতায় বলেছে শিক্ষার্থীরা আর মাঠে না থেকে ঘরে ফিরে যাক। আমি সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছি। সারা দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমার। একথা বলার পর কেন, এসব ঘটনা ঘটলো? কিছু মানুষের জীবনের উপর দিয়ে এত ভীতিকর ঘটনা ঘটে গেল, বিজয়ের আনন্দ তাঁদের জীবনে আসেনি। মূল প্রশ্ন হলো এত লুটপাট, এত ভাঙচুর, এত আক্রমন; এর দায় কার? কেন এখন পর্যন্ত হাসিনার মনোনীত রাষ্ট্রপতি বিশেষ জায়গাগুলোতে সেনাবাহিনী দেয়নি? বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে জেনেও কেন সারাদেশে সেনাবাহিনী পাঠায়নি? বুঝতে পারছেন অবস্থাটা? আর্মি বা রাষ্ট্রপতি মানুষকে রক্ষার জন্য কোনো আর্মি না নামিয়ে, কতগুলো ফোন নম্বর দিয়েছে আক্রান্ত হলে যোগাযোগ করার জন্য। এটা কি একটা ফাজলামি না?একটি পরিবার আক্রান্ত হলে, আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করার পর গিয়ে কি আর্মি তাদেরকে রক্ষা করবে? এটা হয় কখনো?
ফলে নানা রকম অঘটন ঘটেছে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাকৃত দায়িত্বহীনতার কারণে। ছাত্ররা এসব দেখে পরদিন থেকে মানে মঙ্গলবার থেকে আবার মাঠে নেমে রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। ছাত্ররাই মানুষের ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছে। মন্দির পাহারা দিচ্ছে। স্মরণ রাখবেন এমনও হয়েছে যে, যখন একটি হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়, পাশের মসজিদ থেকে মাইক দিয়ে মানুষ ডেকে ইমাম নিজে তাদের রক্ষা করেন। বহু মাদ্রাসার ছেলেরা এখন মন্দির পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী দালালরা এসব ইতিবাচক কথা বলা বাদ দিয়ে কেবল হিন্দুদের উপর আক্রমণ, মূর্তি ভাঙার খবর বলছে। ভারতের পত্রপত্রিকা, ফেসবুক এসব বলছে। কিন্তু এসবের জন্য দায়ী কে, তা বলছে না। রাষ্ট্রপতি ও আর্মির প্রধান এজন্য দায়ী, দেশ এখন তাদের জিম্মায়। তাদের হাতে ফোর্স আছে, আর্মি বিজেবি আছে। বিশেষ জায়গাগুলোকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের নামাচ্ছে না কেন। সেই জায়গাগুলো সব উন্মুক্ত কেন? যা যা ভাঙা হলো কারা ভাঙছে এসব? কারা ভাঙছে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কারা এসব ভাঙার সুযোগ করে দিচ্ছে।
কথা ছিল হাসিনা পদত্যাগ করার পর নির্দলীয় সরকার হবে। এটা আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল। আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট বলেছিল, আমরা একদলের জায়গায় আর একদলকে ক্ষমতায় আনতে চাই না। প্রথম একটি নির্দলীয় সরকার চাই। কিন্তু হাসিনার পদত্যাগের পর ছাত্রনেতাদের বাদ দিয়ে জামাতের নেতাদেরকে কারা বা কে ডেকে এনেছে? হাসিনার আর্মি প্রধান। কারাগার থেকে রাতারাতি কে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছে? চব্বিশ ঘণ্টায় কে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে? হাসিনার আর্মি প্রধান, হাসিনার রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর ছাড়া এসব ঘটতে পারে না। কিন্তু পরাজিত শক্তি এসবজেনে সেই আগের নির্লজ্জ ভঙ্গিতে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে আন্দোলনের বিরুদ্ধে। মানুষের উপর যে অত্যাচার হয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা রুখে দাঁড়িয়েছে। সবাই আমরা তার নিন্দা করছি। এসবের দায় নিতে হবে রাষ্ট্রপ্রধানকে, এখানে বাকিদের কি দায়? বরং ছাত্র সমাজ এবং আমরা প্রশ্ন তুলছি, কার নির্দেশে জামাতের নেতাকে ডাকা হলো, বিএনপিসহ অন্যদের ডাকা হলো? আওয়ামী লীগের বাড়ি যখন আক্রমণ হয়, তখন আর্মি কী করেছে? আর্মি বসে বসে চুপচাপ এইসব মজা দেখছিল কেন?
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক