রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘কানকথা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান’

প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০২৩

বাংলাদেশের মানুষের কানকথা শোনার খুব অভ্যাস। বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাসহ বড় ব্যক্তিদের চরিত্রে এসব দেখা গেছে। কানকথায় বিশ্বাস করে বাংলাদেশের বহু মহাজনরা বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। রাতারাতি প্রকৃত বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে শত্রুকে খুব আপন করে নেন। কানকথা শোনার পাশাপাশি কর্তারা সমালোচকের চেয়ে অধিক পছন্দ করেন চাটুকারকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব কারণে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাই শুধু নন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একই কাজ করে থাকেন। শুধুমাত্র কানকথায় একজন অযোগ্য চাটুকার বড় দায়িত্ব পেয়ে যান, ভিন্ন দিকে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কানকথার কারণে সকল ত্যাগ তিতিক্ষার পর হয়তো প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য হন।

 

সংকটটা আসলে কোথায়? প্রথম সংকট, বাংলাদেশের মানুষ চাটুকারিতা করা পছন্দ করেন। দ্বিতীয়ত, সত্য জানার জন্য সময় দিতে প্রস্তুত নন। সত্য জানার জন্য সব পক্ষকে নিয়ে বসে মূল সত্য অনুসন্ধানে আগ্রহই নেই। সবাই এতরকম কাজ বা ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন যে, ঠাণ্ডামাথায় বসে সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বা ধৈর্য তাদের নেই। লক্ষ্য করলে দেখবেন, কেউই অন্যের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে চান না। সামান্য শুনেই অপর পক্ষকে থামিয়ে দেন। ভাবখানা সবটা না শুনেই তিনি সব জেনে বসে আছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন মুখোমুখি আলোচনার অনুষ্ঠানগুলো লক্ষ্য করুন, দেখবেন এক পক্ষ অপর পক্ষের কথা ভালোভাবে না শুনেই চিৎকার করে পাল্টা জবাব দিতে আরম্ভ করেছেন। মনে হয়, এটা অনেকটাই আমাদের জাতিগত চরিত্র।

 

সত্য জানা যে খুব কঠিন, সবসময় তা নয়। সত্য জানার আগ্রহ নেই। মিষ্টি করে যে কানকথা বলতে পারে তাকেই পছন্দ কর্তাদের। ফলে চাটুকারদের কানকথা শুনে সিদ্ধান্ত নেন। সেজন্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক পথে আগাতে পারে না। মুখে বড় বড় লক্ষ্য আদর্শের কথা বললেও, প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে মস্তবড় ফাঁকি। সবচেয়ে বড় যে সঙ্কট বাংলাদেশে দেখা যায়, সেটা হলো মানুষ খুব কম ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পায়। মানুষকে খুব কম ক্ষেত্রেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। কারণ আমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ধারণাটাই কাজ করে না। ফলে সকল বিচার, সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় গোঁজামিল দিয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাই যেমন সঠিক লক্ষ্যে আগাতে পারে না, ফলাফলে রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ে। রাষ্ট্র শেষ বিচারে কতগুলো প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তির সমাহার। রাষ্ট্র কখনোই গাছ পাথর মাটি নয়। শুধুমাত্র একটা সীমানা নয়।

 

বাংলাদেশের শিক্ষিত ভদ্র সমাজের মানুষরা পর্যন্ত যুক্তির ধার ধারে কম, নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। যারা এখানে প্রতিষ্ঠান বানান, পিছনে মূল লক্ষ্য থাকে নিজের প্রচার। নিজেকে অমর করে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন তারা। ফলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে নিজের প্রচারে বেশি ব্যস্ত থাকেন। সে কারণেই দেখা যায় অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি যত বড়, সেই প্রতিষ্ঠানের আকৃতিও হয়তো তত বড় কিন্তু মূল লক্ষ্যের ছিটেফোঁটা হয়তো সেখানে নেই। কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধররা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেয়ে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখা আর নিজের প্রচারে সময় ব্যয় করেছেন।


গল্প আছে একটা। গল্পটা এরকম, প্রথমজীবনে কিছু লক্ষ্য আদর্শ নিয়ে প্রতিষ্ঠান বানালাম। প্রতিষ্ঠানকে বড় করার জন্য টাকার পিছনে ছুটে বেড়ালাম। টাকা জোগার হলো, প্রতিষ্ঠান বড় হলো, সেই সঙ্গে আমার প্রচার আরম্ভ হলো। ঠিক তারপরে আমি নিজের প্রচারের পিছনেই ছুটে বেড়ালাম। প্রশংসা বাক্য শোনাটাই তখন আমার অভ্যাসে পরিণত হলো। প্রকৃত বন্ধুরা সমালোচনা করলে ক্ষেপে যেতাম। চাটুকারদের প্রশংসা শুনে গলে যেতাম। প্রকৃত বন্ধুদের সরিয়ে চাটুকারদের বসিয়ে দিলাম বড় বড় পদে। যখন হঠাৎ একদিন সৎ মন নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে চাইলাম, দেখলাম প্রতিষ্ঠানের দালান, অর্থ, জনবল সব আছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে সারা পৃথিবী আমাকে চেনে। কিন্তু যে লক্ষ্য আর আদর্শ নিয়ে আমি প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলাম, হায়! দেখলাম সেই লক্ষ্য আর আদর্শটাই শুধু নেই।

 

কানকথা কোনো প্রতিষ্ঠানকে সঠিক লক্ষ্যে দাঁড়াতে দেয় না। অতিরিক্ত প্রচার এবং আত্মপ্রচার প্রতিষ্ঠানের খুঁটি নড়বড়ে করে দেয়। প্রতিষ্ঠানের শুরুতে প্রতিষ্ঠানের দুর্দিনে যারা আসে, তারা একটা আদর্শ নিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠানের সুদিনে যারা আসে তাদের বেশির ভাগ আসে সুবিধা নিতে। যারা কানভারী করে তাদেরকে এড়িয়ে চলাই ভালো। বরং সবরকম ত্রুটি বিচ্যুতির কথা মুক্ত সভায় আলোচনা করার সুযোগ থাকা দরকার। প্রকৃত কর্মীদের বলতে দেয়া দরকার সংগঠনকে তারা কীভাবে দেখছে। কি ধরনের সংকটের ভিতরে কাজ করতে হচ্ছে। সমালোচনা শোনার অভ্যাস করা উচিত ।ঘরের মধ্যে বসে বড় কর্তারা মনগড়া সব কর্মসূচী ঠিক করে দিলে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো যায় না। যুদ্ধের মাঠে থেকেই যেমন যুদ্ধ করতে হয়, প্রতিষ্ঠানের বেলায়ও তাই।