রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে’

প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০২৩

শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের ভিতরে বসে কতটুকু পড়াশুনা করল, তা দিয়ে সেই শিক্ষার্থীকে সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায় না। পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম শ্রেণি পেল কি পেল না, শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন তা দিয়েও হতে পারে না। প্রত্যেকটি মানুষকে বিচার করতে হবে তার সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, জীবনসংগ্রাম— সব কিছুর আলোকে।

 

ক্লাসরুমের ভিতরে বসে শিক্ষার্থীর হাবভাব বা তার পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে পুরো মানুষটাকে চিনতে যাওয়ার মতো মূর্খতা আর কিছু নেই। ধরা যাক যে, শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে সবচেয়ে অযোগ্য বলে মনে হয়। বাইরের দুনিয়ায় সে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, এমন নয়। বরং সম্পূর্ণ উল্টো হতে পারে। মানুষের অন্তরের জগৎ, তার অনুভূতি ও বোধ— সেগুলো এতই ব্যক্তিগত ও গভীর ব্যাপার; হঠাৎ করে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলা যায় না।

 

বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্লাসের সবচেয়ে অযোগ্য শিক্ষার্থী ক্লাসের বাইরে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অনেক বেশি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। ক্লাসে যাকে মনে হয়েছে সবচেয়ে বেশি নির্বোধ, দেখা যাবে অন্যত্র সে সবচেয়ে বেশি বোধের পরিচয় দিতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যার সম্ভাবনা ধরা পড়েনি, দেখা গেল অন্যত্র সেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময়।

 

নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শ্রেণিকক্ষের ভিতরে যে শিক্ষার্থী ছিল অনুজ্জ্বল, হঠাৎ দেখা গেল দারুণ ছবি আঁকে সে। কিংবা সুন্দর কবিতা লেখে। মানুষের প্রতিভা, জ্ঞান, উজ্জ্বলতা এক একজনের ক্ষেত্রে এককভাবে প্রকাশ পায়। সব মানুষের মধ্যে নানারকম গুণ থাকা সত্ত্বেও, সব সময় সব জায়গায় সে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না, নিজের গুণগুলো চাইলেই যখন তখন প্রকাশ করতে পারে না। মানুষের বড় হয়ে ওঠা এক বিচিত্র ব্যাপার। নানা রকম কত বৈপরীত্যের ভিতর দিয়ে মানুষ বড় হয়, পরবর্তী জীবনে তার ছাপ পড়ে মানুষের ওপর।


ফলে সবসময় সেজন্য তাকে চৌকস লাগে না। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, তার ভিতরে আগুন লুকিয়ে নেই। নিজেকে প্রকাশ করার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র চাই। মানুষের ভিতরে থাকে অফুরন্ত প্রতিভা। যোগ্য কিছুর ছোঁয়া পেলেই তা সাড়া দেয়। সেইজন্য মনে রাখতে হবে, ক্লাসরুমের ভিতর সে অসহায় বা দুর্বল বলে, সঙ্কোচে সঙ্কুচিত বলে সে সর্ব ক্ষেত্রে তা নয়। শিশুকে দেখা যায় অনেক সময় নতুন পরিবেশে গিয়ে সে আর চঞ্চল থাকে না, প্রাথমিক ভীতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তেমন ঘটে। নিজেকে মেলে ধরতে অনেক শিক্ষার্থীর অনেক সময় চলে যায়।

 

বহু প্রাণবন্ত মানুষ সর্বত্র প্রাণবন্ত থাকে না। সপ্রতিভ থাকে না। মানুষ সম্পর্কে তাই চট করে মূল্যায়ন করে বসা যায় না। শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে কথাটা একইভাবে সত্য। পরীক্ষায় খুব খারাপ ফলাফল করছে, ক্লাসের ভিতর কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না; ফলে তাকে বাতিল বলে ধরে নেয়া যাবে না। সময় তাকে পরে নতুনভাবে উপস্থিত করতে পারে। শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় খারাপ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে উপরের ক্লাসে উঠতে বাধা দেয়া যেতে পারে, কিন্তু এটা যেন মনে না করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য বলে সর্বস্তরে সে অকৃতকার্য হবে। প্রশ্নই ওঠে না।

 

সকল মানুষের মধ্যেই নানান সম্ভাবনা থাকে, সময় ও পরিবেশের ভিতর দিয়েই তার প্রকাশ ঘটে। ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের আশাবাদী হতে হবে। প্রত্যেকে শিক্ষার্থীকে সম্ভাবনাময় মানুষের মর্যাদা দিতে হবে।

 

লেখক: শিক্ষাবিদ