রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’

প্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০২৩

রুচির দুর্ভিক্ষ বিষয়টি আসলে কী? দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য। দ্রৌপদী পাঁচ ভাইকে বিয়ে করেছিল। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বা ভারতবর্ষে এমন ঘটনা ঘটলে বহু মানুষই মনে করতে পারে, পাঁচ ভাই আর দ্রৌপদী রুচিহীন। কিন্তু যখন মহাভারত পাঠ করে তখন এটা মানুষ সাধারণত ভাবে না। মহাভারত পাঠ করতে গিয়ে যা রুচিহীন মনে হয়নি, সেই ঘটনা আজ ঘটতে দেখলে রুচিহীন মনে হবে কেন? কারণ মহাভারত অনেক দূরের বস্তু, সেখানে যা ঘটে তা আমাদের জীবনকে আঘাত করে না। কিন্তু এখন তা ঘটলে আমাদের অনেকেরই মনে হবে, আমাদের পারিবারিক জীবন বা আমাদের কায়েমি স্বার্থকে তা আঘাত করছে।

 

আমার স্ত্রী আমার সম্পত্তি, আরও চারজন তার শয্যাসঙ্গী হবে আমি জীবিত থাকতে এটা কি মানা সম্ভব? বহু নারীও সেটা মানতেই পারবে না, যখন নিজেকে শ্বাশুড়ির জায়গায় দাঁড় করাবে। মূল কথাটা হলো, রুচি কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়। সবকিছুর মতো রুচিও পরিবর্তনশীল। সকল সমাজে রুচির পরিবর্তন ঘটে। রুচি তৈরি হয় নানাভাবে। রুচির ওপর সময়কাল প্রভাব ফেলে। ভৌগলিক কারণ থাকে, ধর্মীয় কারণ কাজ করে। সবচেয়ে বড় কারণটা হলো অর্থনৈতিক। প্রত্যেক সমাজেই নানা ধরনের রুচির মানুষ থাকে, রুটি রুজির সঙ্গে তার আসল সম্পর্ক। মানুষটির পোষাক কেনার সামর্থ্য নেই। ফলে ছোট বস্ত্রখণ্ড দিয়ে পাছা ঢাকলে বুক দেখা যায়, বুক ঢাকতে গেলে পাছায় কাপড় থাকে না।

 

সত্যি বলতে, এটা হচ্ছে রুচির আসল গল্প। টাকা থাকলেই রুচি দেখানো যায়। বলা যায় তখন এ ধরনের কথা, দ্যাখো লোকটা কত রুচিশীল। পিকাসোর মতো বিখ্যাত চিত্রকরদের দিয়ে তার ঘরের দেয়াল ভরা। কিছু মানুষের কাছে এটাই রুচি, কিন্তু বহু মানুষের ঘরে যে দেয়াল নেই, রুচির বিচারে তাদের কোথায় ফেলা যাবে? সত্যি বলতে, অনুকরণশীল সমাজে চিন্তার ঘাটতি থাকে। সবাই ধনীদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে রুচিশীল হতে চায়। ধনীদের অনুকরণ করাই সেখানে রুচির পরিচয়। কথাটা আরও স্পষ্ট করেই বলা যাক, সকল সমাজে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রুচির পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু রুচিশীল বলতে কোনটাকে ধরা হয়, যা ধনীরা আর ক্ষমতাবান নির্দিষ্ট করে দেয়। বাকি সবাই কুরুচিপূর্ণ ধনীদের দৃষ্টিতে।

 

সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবানদের চাটুকারদের কণ্ঠে দরিদ্র মানুষের রুচির নিন্দা শোনা যায়। যেমন, ওরা ছোটলোক। কারণ উচ্চারণ শুদ্ধ নয়। কথাবার্তায় ছোটলোক, গা থেকে গন্ধ আসে ইত্যাদি। নতুন টাকা হাতে আসলে মানুষ নিজের সমাজ থেকে বের হয়ে ধনীদের সমাজে প্রবেশ করতে চায়। ঢাকা ক্লাবের সদস্যপদ লাভ করতে চায়। শ্রমিকশ্রেণির জন্য যারা নাটক করতে চায়, শিল্প সাহিত্য করতে চায় তারা ঢাকা ক্লাবের সদস্য না হতে পারলে তাদের জাত চলে যায়। কারণ তাদের জাতটা কাচের মতো ঠুনকো, সামান্য আঘাতে ভেঙে যায়।

 

সত্যিকার অর্থে রুচির বিষয়টা আসলে কী? এক ধরনের চিন্তা-ভাবনার ছাপ। মানুষের চিন্তাভাবনার ওপর অনেক ঘটনার প্রভাব থাকে। সবচেয়ে প্রভাব থাকে অর্থনীতির। কিন্তু অর্থনীতি একমাত্র নয়। মানুষ যতরকম ঘটনার ভিতর দিয়ে যায় তার সবকিছুর ছাপ পড়ে মানুষের ওপর। সত্যিকার অর্থে ‘আমি’ বলে কিছু নেই। যদি থাকে সেটা হচ্ছে, বিভিন্ন ঘটনার প্রভাব। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষরা ভাত মাছ সবজি ডাল খায় কেন? বাঙালি খাবারের ঐতিহ্যের প্রভাব। বাঙালি ভদ্রলোকরা বাংলা না বলে ইংরেজি বলতে গর্ব বোধ করে কেন? ব্রিটিশ শাসনে দাসত্ব করার প্রভাব। ব্রিটিশ শাসনের দাসত্বের আরও প্রভাব আছে। বাংলাদেশে মানুষকে কষ্ট দিয়ে রাস্তাঘাট আটকে নামাজ পড়তে হয় কেন? কারণ বহু বছর ধরে শহুরে জীবনে তার যে মূল শিক্ষা, সেখানে স্বেচ্ছাচারকে সে মনে করে স্বাধীনতা।

 

ইসলাম ধর্ম থেকে সে এটা পায়নি। কারণ ভারতবর্ষের সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই স্বেচ্ছাচার দেখা যাবে। শুধু ধর্ম নয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এটা বেশি পাওয়া যাবে। তথাকথিত সংস্কৃতিবান মানুষরা সংস্কৃতির নামেও এটা করে থাকে। কথাটার ব্যাপক প্রমাণ ঘটবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে। যারাই যখন ক্ষমতায় আসে এই স্বেচ্ছাচারকে তাদের গলার মালা করে নেয়। ফলে সরকারি পর্যায়ের এরকম স্বেচ্ছাচারিতা বিপুল মানুষের মধ্যে তা আরও বেশি বেশি সংক্রমিত করে। সরকারের চাটুকার যারা, হতে পারে লেখক কবি নাট্যকার; সবাই মনে করে ক্ষমতা যখন পাওয়া গেছে স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষে থাকাটাই তার ধর্ম। স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাবার জন্য তখন অনেকেই সরকারি দলে যোগ দেয়, সরকার যখন যা বলে সেটাকেই তাদের নিজেদের কণ্ঠস্বর মনে করে।

 

ফলে ‘আমি’ বলে কিছু নেই। কারো না কারো কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে সে। ধরা যাক, এদেশের যুবকরা কী করে? টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় শিক্ষক। টাকা থাক বা না থাক, টেলিভিশন যেসব বিজ্ঞাপন প্রচার করে, সেইসব পণ্য লাভ করে বেঁচে থাকাটাই তার কাছে স্বপ্ন। ধর্মের শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নীতিশিক্ষা, রাজনীতিকদের মহান আদর্শের বুলি, কিছুই দাঁড়াতে পারে না টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের সামনে। পুঁজির এই ভয়াবহ শক্তি মার্কস এঙ্গেলস বহু আগেই টের পেয়ে মানবসমাজকে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, পুঁজিবাদের ধাক্কায় সকল মহৎ পেশা ব্যবসায়িক পেশায় পরিণত হবে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, শিক্ষক চিকিৎসক সবাই হয়ে দাঁড়াবে ব্যবসায়ী । তিনি কি মিথ্যা কিছু বলেছেন? পুঁজিবাদী সমাজে মাতৃস্নেহ পর্যন্ত পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, মা তার সন্তানকে লালন পালন করার সময় পাচ্ছে না।

 

কিছু মানুষ টাকার বিনিময়ে মায়ের দায়িত্ব পালন করছে। মা সন্তানকে সময় দেয়ার চেয়ে, সন্তানকে পুঁজিবাদী ভোগ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত করে তুলতে টাকা রোজগারে বেশি সময় দিচ্ছে। বর্তমান সমাজে এটাই মায়ের রুচির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা-বাবা এখন সন্তানকে কাছে পেতে চায় না। পুঁজির সেবক বানাবার জন্য দূরে বা পশ্চিমে পাঠাবার জন্য মরীয়া হয়ে থাকে। সন্তানকে নয়, তাদের দরকার সন্তানকে নিয়ে আর দশজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালানো। এসব কিছুই রুচির বহিঃপ্রকাশ। ভিন্ন ভাবে বলা যায়, আসলে এসব চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ। ফলে এই আমি হচ্ছে, সমাজের অনুকরণকারী ‘আমি’। হয় ধর্মের চোখে, নয় বিজ্ঞাপনের চোখে, না হলে অন্য কিছুর প্রভাবে এক এক ‘আমি’ তৈরি হচ্ছে। চীনে জন্মালে যে সাপ খাবে, পশ্চিমে জন্মালে সে সসেজ খাবে। সবটাই চারদিকের প্রভাবের ‘আমি’।

 

সমাজে কি এর ব্যতিক্রম নেই? আছে। বিপ্লবীরা, যারা সত্যিকারভাবে এ অবস্থাটা পাল্টাতে চায়, তার জন্য কাজ করছে এবং সবরকম ত্যাগ শিকার করছে তারাই এর বিপরীত মেরুতে রয়েছে। নমস্য তারাই। ধনিকশ্রেণি যে রুচি গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে, বিপ্লবীরা তার বিপরীত রুচি গড়ে তুলছে তাদের ভিন্ন ধরনের চিন্তার কারণে। ভিন্ন ধরনের চিন্তাই ভিন্ন ধরনের রুচি গড়ে তোলে। বিপ্লবীরা কারো চাটুকারি করে না, বৃহত্তর মানুষের মুক্তির পক্ষে কাজ করে যায়। যদি রুচির প্রশ্ন নিয়ে কথা বলতে হয়, সেটাই হচ্ছে একমাত্র উন্নত রুচি যা বৃহত্তম মানুষের পক্ষে রয়েছে। বাকি রুচির সবটাই স্বার্থপর সুযোগ সন্ধানীদের রুচি, সেটাকে যে দৃষ্টি থেকেই মহিমান্বিত করা হোক। বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে যারা সরকারের চাটুকারিতা করতে গিয়ে সত্য উচ্চারণ করেনি, কিংবা এক সরকারের সময়ে কণ্ঠ উঁচু করে যেটাকে বলেছে অন্যায়, আর এক সরকারের আমলে সুবিধা নেয়ার জন্য সেটাকেই বলেছে ন্যায়; তারা ভণ্ড এবং সুবিধাবাদী। তারা জনগণের শত্রু।

 

জনগণের শত্রুর আবার রুচি-অরুচি কী? তাদের রুচি মানেই ভণ্ডামি, পদলেহন করা। সুবিধা মতো পদলেহন, সুবিধামতো মাঝে মধ্যে আবার বিপ্লবী হবার চেষ্টা করা। পাশাপাশি ভিন্ন কথাও কিছু বলার থাকে। সমাজের মধ্যবিত্তরা পুঁজিবাদের পক্ষেরই লোক, কিন্তু ইতিহাসের অনিবার্য নিয়মে এই মধ্যেবিত্তরা অনেক সময় আবার বিরাট প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে নানাভাবে। কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটিয়ে, কখনো উন্নতমানের শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করে। কখনো জনগণের পক্ষে সাংবাদিকতা করে বা কলম ধরে। কখনো তীব্রভাবে সরকারের সমালোচনা করে। বিশ্বের সব দেশেই এমন প্রগতিশীল মানুষদের দেখা পাওয়া গেছে। শেক্সপিয়ার, ইবসেন, বার্ণার্ড শ, ম্যাক্সিম গোর্কি প্রমুখ হচ্ছেন শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেইরকম মহান বা প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশের তথাকথিত শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে সেইরকম মানুষরা কারা? কারা শেক্সপিয়ার ইবসেনদের সমগোত্রীয়? সত্যি আছে কি তেমন মানুষ? থাকলে তাদের সংখ্যা কত হবে?

 

কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার জন্য এ লেখাটা লিখছি না। ফলে সেদিকে যাবার চেষ্টা করছি না। সব সমাজেই শোষণ ছিল আবার সব সমাজে প্রগতিশীল মানুষ জন্মেছে। ফলে তাদের রুচি ছিল সেই সমাজের বাকিদের চেয়ে ভিন্ন। সামন্ত সমাজের সবটা খারাপ ছিল না, এটাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কথা। ফলে সেই সমাজেও সমাজের প্রয়োজনে মহৎ শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন যুগেও হয়েছে, পুঁজিবাদের যুগেও হচ্ছে। মার্কস এঙ্গেলস লেনিন তা স্বীকার করে বলেছেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের দ্বারা মহৎ যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তা যে সমাজেই বসে সৃষ্টি হোক, তা সকল মানুষের। ফলে পুঁজিবাদী সমাজে যা কিছু মহৎ সৃষ্টি তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে মানবকল্যাণে ও বিপ্লব পরিচালনায়। বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যের জগতে সেইরকম মহৎ সৃষ্টি কটা হয়েছে যা বিপ্লবের কাজে আসবে? না হয়ে থাকলে, রুচির দুর্ভিক্ষ বহুদিন বহু বছর ধরেই চলছে এদেশে। নতুন করে একজন মানুষ হঠাৎ একা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে না।

 

যদি হঠাৎ একজন মানুষকে সামনে টেনে এনে রুচির দুর্ভিক্ষের প্রশ্ন তোলা হয়, সেটা কি যুক্তিপূর্ণ বা বিজ্ঞানসম্মত কথা হলো? সকলের সব অপরাধের অপকর্মের দায় একজনের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো, বহু অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হলো এর ভিতর দিয়ে। মহাভারত হচ্ছে ব্রাহ্মণদের শাসনের, ব্রাহ্মণ্য শোষণের পক্ষে ভয়াবহ ওকালতি করা সাহিত্য, কিন্তু তার সাহিত্যমান আজ পর্যন্ত কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। কারণ মহাভারতে এত প্রশ্ন এত প্রসঙ্গে এসেছে যে, রচয়িতারা বহু সত্যকে স্থান না দিয়ে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শাসকদের মধ্যকার লড়াই, তাদের ব্যক্তিগত যুদ্ধের জন্য বৃহত্তর মানুষের জীবনে কত দুর্ভোগ নেমে আসে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কত জনপদ, কত প্রাণ, শঠতার আশ্রয় নেয় মহান শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত; দর্পনের মতো ইত্যকার নানা ঘটনা আজকের দিনেও মানুষের কাছে চিরায়ত এক সত্যি। রচয়িতাদের মেধা আর মননের জন্যই মহাভারত আজও এক স্বীকৃত উচ্চমান সম্পন্ন সৃষ্টি। কারণ যারা সৃষ্টিশীল এ কাজটি করেছে তাদের রুচি ছিল অন্যদের চেয়ে উচ্চমানের, যদিও তারা প্রায় সবাই ব্রাহ্মণ ছিল।

 

বাংলাদেশে অনেকে সমাজের নকল ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন স্বাধীনতার পর। কিন্তু রুচির অভাবের জন্যেই বা বলা ভালো মেধার অভাবের জন্যেই বাংলাদেশে সেইরকম সৃষ্টিশীল কিছুর দেখা মেলেনি। মহাভারতের রচয়িতা ব্রাহ্মণরা ছিল স্বাধীন, চাটুকারিতা করতে হয়নি বলেই তাদের রচনা ধারালো। চাটুকারদের, মস্তক অবনত করা মানুষদের রচনা কখনো সেরকম তীক্ষ্ম হতে পারে না। ব্রিটিশ শাসনামলের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কয়েকটা কথা বললে তা বোঝা যাবে। ব্রিটিশরা ন্যায়বিচার করেনি, নানা অন্যায় করেছে। তবুও অবাক করা কাণ্ড এই, যখন শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা বিচারকের আসনে ছিল, বহুক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের যেহেতু মনোবল ছিল, বহু মামলায় তারা ন্যায়বিচারের উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছে। কারণ ইংরেজ বলেই ইংরেজ শাসকদের চাটুকারি তাদের করতে হয়নি। সেইজন্য অনেক বিপ্লবীরা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কখনো কখনো শাসকরা চেষ্টা করেও তাদের দিয়ে অন্যায় রায় দেয়াতে পারেনি। কিন্তু পরে যখন দেশীয়রা বিচারকের পদ পেল, দেখা গেল চাটুকারিতা করতে, ইংরেজ শাসকদের প্রিয়ভাজন হতে গিয়ে তারা নিজ ভাইদের বিপক্ষে অন্যায় রায় দিয়েছে নির্দ্বিধায়।

 

বর্তমানে সেই ধারা এখনো বজায় আছে। মানুষ তাই বলতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ শাসন ভালো ছিল । সত্যিই তো, ব্রিটিশ শাসনে কি এত কালাকানুন ছিল? চাটুকারিতা এক ধরনের রুচি, যা অনেকের থাকে। নিঃসন্দেহে তা হচ্ছে জনগণের স্বার্থের বিরোধী রুচি। প্রথম ন্যূনতম একজন আদর্শ মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে আগে নিজ কুকর্মের আত্মসমালোচনা করা। পরে অপরের দোষ ধরা। নিজের দোষ যে দেখতে পায় না, সেই জনগোষ্ঠীর রুচি কেমন হতে পারে? মূল কথায় আবার ফেরা যাক, যখন কারো কর্ম কারো জনপ্রিয়তা, আমার জন্য ভীতিকর হয়ে দাঁড়াবে, আমার স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াবে; তখন কিছুতেই তাকে টিকতে দেয়া হবে না। ব্রাহ্মণরা যে কারণে প্রাচীন যুগে চার্বাকদের নিশ্চিহ্ন করেছিল। কারণ চার্বাকদের দর্শন তাদের কাছে তাদের রুচির বিরোধী ছিল। ঠিক যেমন দৌপদীর পাঁচ ভাইকে বা একসঙ্গে পাঁচ পুরুষকে বিয়ে করা রুচিহীন মনে হবে আমাদের অনেকের কাছে? কথা হলো, রুচি নিয়ে এত হৈ চৈ কেন, রুচি কি কারো কাছে আদৌ পাট্টা দেয়া আছে? কথাগুলো কোনো একক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলছি না। বলছি তাদের সকলকে, বহু বছর ধরে জনগণের বিরুদ্ধে যারা চাটুকারিতার রুচি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর তাদের সকলকে। সেটা করতে গিয়ে তারা সেই পেশার অন্যদেরকে পর্যন্ত আহত করেছেন। বুঝতে কি পারছেন, সাধারণ মানুষ এখন তাদের কোন চোখে দেখছে।

 

বি দ্র: সকালে দেখলাম নাট্যকার মামুনুর রশীদ রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে কদিন আগে অনেকগুলো কথা বলেছেন। মামুন ভাইর অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। মামুন ভাই যখন বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুব নেতিবাচক জায়গায় চলে গেছে, সঠিক কথা বলেছেন। মামুনুর রশীদ স্বীকার করেছেন, রুচির যে দুর্ভিক্ষ সেটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা আবার তেমনি আমাদির সাংস্কৃতিক সমস্যা। কারণ আমাদের রাজনীতিও রুচিহীন হয়ে গেছে। মামুনুর রশীদ যে দীর্ঘদিন পরে হলেও এরকম সত্য উচ্চারণ করতে পেরেছেন, সেজন্য তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির অধঃপতন এতটাই যে, তা সুস্থ সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনাটা কঠিন। তিনি উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রুচির যদি উন্নতি না ঘটে তাহলে এসব উন্নতি কাদের জন্য। আমি সম্পূর্ণ একমত তার সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজনীতি যদি সুস্থ হতো, দুর্নীতি পরায়ণ না হতো, তাহলে ভালো কিছু ঘটতো। তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যা সাধারণত আমাদের সাংস্কৃতিক ভদ্রলোকরা বলতে সাহস করেন না। তিনি বলেন, রাষ্ট্র কোনো রুচির উন্নয়নে কাজ করছে না। তাই এতদিন পর এসে রাষ্ট্রের রাজনীতির কাছে, ধামাধরা সংস্কৃতির কাছে আর কোনো আবেদন নিবেদন নেই।

 

তিনি বলেন, আমার আবেদন যে মানুষগুলো সামাজিক কাজের প্রতি দায়বদ্ধ তাদের কাছে। তিনি বলেন, দায়বদ্ধ মানুষরা যদি আওয়াজ তোলেন, যদি প্রশ্ন করতে শুরু করেন, যদি সকল অন্যায়কে বাধা দেন, তাহলে সমাধান আসবে। মামুনুর রশীদ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন দীর্ঘদিন পরে হলেও, সেটা তার একটা অনুশোচনার দিক। কিন্তু তিনি নিজে একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তি হিসেবে, সাংস্কৃতিক জগতের নিয়ন্ত্রণকারীদের একজন হিসেবে রুচির দুর্ভিক্ষের দায় নিজের কাঁধে নেননি। সবটাই রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছেন। মামুন ভাইয়ের সকল সুন্দর বক্তব্যগুলো তাই প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণেই তার বক্তব্য নিয়ে নানারকম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সেই উত্তেজনার বড় একটি কারণ তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বারবার তার লেখায় বলছেন, তিনি হিরো আলমকে ভালোভাবে চেনেন না। অন্যের কাছ থেকে হিরো আলম সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য শুনে তিনি তার প্রতি বিরক্ত। কথা হলো, যার সম্পর্কে তিনি ভালো জানেন না, কানকথা শুনে যদি বলেন রুচির দুর্ভিক্ষের ভিতর হিরো আলমের জন্ম, কথাটা হাস্যকর শোনায়। যাকে ভালো করে চিনি না, জানি না, তার সম্পর্কে কি নেতিবাচক মন্তব্য করা যায়?

 

বাংলাদেশের মানুষের একটি খারাপ রুচি হলো, কানকথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া। রাষ্ট্রের ওপর মহলেও এসব চলে। কিন্তু আমাদের প্রিয় মামুন ভাই দেখছি সেই রোগেই আক্রান্ত। সত্যি বলতে একজন নাট্যকারের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের নাট্যজগতে যত বড় বড় ব্যক্তি আছেন, যতদূর আমি দেখেছি এদেশের নাট্যকর্মীরা তাদের মধ্যে মামুন ভাইকে বেশি সম্মান দিয়ে থাকেন। নিজেও আমি একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তাকে অসম্ভব পছন্দ করি তার সকল দোষগুণসহ। মামুন ভাই যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের বহু অন্যায় ও অনিয়ম দেখে দীর্ঘদিন নীরব ছিলেন, আপসকামী ছিলেন, তা এদেশের বহু মানুষকে বহু নাট্যকর্মীকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছিল। মামুন ভাই যদি তার সেই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসেন, সেটা অনেকের মনে আশার সঞ্চার করবে। মামুন ভাইকে সেই ভূমিকাতেই দেখতে চাইছি। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রোশে তিনি যেন উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপান।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ