রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘যিশু ও খ্রিস্টধর্ম’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩

খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব রোমক সাম্রাজ্যের বল্গাহীন শোষণের ফলে, য়ুদেয়ার মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের গর্ভে, ক্রীতদাসদের মুক্তিকামনার প্রতিফলন রূপে। যিশুর জন্মকালে রোমক সাম্রাজ্যের অবক্ষয় এতই প্রতিভাত হয়েছিল যে, শাসক শ্রেণি প্রায় নিষ্কর্মা অলস হয়ে পড়েছিল। সম্পূর্ণ নির্ভর করতো দাসদের ওপর। দাসরাই ছিল রোমক সাম্রাজ্যের প্রধান উৎপাদনী শক্তি। তাদের কাছেই খ্রিস্টধর্মের আবেদন এসে পৌঁছেছিল সবচেয়ে উচ্চনাদে। কিন্তু পরে শাসকরা খ্রিস্টধর্মকে নিজ প্রয়োজনে আত্মসাৎ ও বিকৃত করে নিয়েছিল। য়ুদের সেই খ্রিস্টধর্ম বলতে চেয়েছিল এক কথা, কিন্তু শাসকদের হাতে পড়ে তা হয়ে দাঁড়ালো ভিন্ন আরেক খ্রিস্টধর্ম। সত্যি বলতে বৌদ্ধধর্মের বেলায়ও ঠিক তাই ঘটেছিল। যা গৌতম বুদ্ধ বলতে চাইলেন তা ধারণ করা সম্ভব ছিল না। ভিন্ন এক ধর্ম প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল সেখানে। বৌদ্ধ বলেছিলেন দুঃখের কারণ লোভ, বৃহৎ সব আকাঙ্ক্ষা। ব্যক্তিগত সম্পদ উচ্ছেদ করে সেই আকাঙ্ক্ষা নির্মূল করা যেতে পারে। খ্রিস্টধর্মের কিছু আগে সেই একই কথা বলেছিলেন রোমের সেনেকা। বলেছিলেন, সকল বৈষম্যের কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিন্তু তা উচ্ছেদের কথা সাহস করে বলতে পারেননি।

যিশুর বাণীর আদি প্রোলেতারিয় অংশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ধনীর প্রতি তীব্র, বিজাতীয় ঘৃণা। যিশু আসলে নতুন ধর্ম প্রচার করেননি। তিনি নিজেই ছিলেন ইহুদি। তিনি তাঁর সমাজের ইহুদি সুদখোর আর ধনীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তিনি মন্দিরে ঢুকে বণিক ইহুদিদের বের করে দেন এই বলে, তোমার ঈশ্বরের ঘরকে অপবিত্র করছো। ধনীদের প্রতি তাঁর ঘৃণা ছিল ভয়াবহ। লুকের সুসমাচার দিভেস আর লাজারাসের কাহিনির মধ্যে পাওয়া যায়, ধনী নরকে যাবেই। দিভেস খুবই দয়ালু ছিলেন, কিন্তু মরণের পর নরকবাস হলো। কারণ তিনি ধনী ছিলেন। লুকেই রয়েছে যিশুর বাণী, যারা দরিদ্র তারাই সুখি। কারণ ঈশ্বরের রাজ্য তোমাদের। ধনীদের বলা হলো, যাও ধনীর দল ক্রন্দন আর বিলাপ করো আসন্ন দুর্দশার কথা ভেবে। প্রথম দিকের খ্রিস্টধর্ম ছিল ঠিক এমন। যিশুর মৃত্যুর পরে এসব লেখা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু যিশুর বিশ্বাসকে মাথায় রেখে।

যিশুর ক্রশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধু ও অনুসারীরা যিশুর পথে এগিয়ে গেলেন। যিশুর বন্ধু আর অনুসারীদের হাতে প্রথম খ্রিস্টধর্মের জন্ম, যিশু নিজে সেই ধর্মের প্রচারক নন। কিন্তু যিশুর মতবাদ সেখানে ধ্বনিত হয়েছিল। নতুন এক ধর্মমত এলো পৃথিবীতে যিশুর মরণোত্তরকালে, যার মূল কথা বিদ্রোহ। ধনীদের বিরুদ্ধে। কারণ এই ধনীরা শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যিশুর মতো বিদ্রোহীকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে। যিশু জুলুমের বিরুদ্ধে আর শোষণে বিরুদ্ধে, ধনীদের লোভের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। যিশু স্বয়ং চাবুক হাতে জেরুসালেমের মন্দির থেকে ব্যবসায়ীদের বিতাড়িত করেছিল। যিশুর যে মূর্তি প্রথম দিকে কল্পনা করা হতো তা হলো, লকলকে অগ্নির মতো চোখ। যিশুর শিষ্যরা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগের নিদর্শন রেখে গেছেন। ক্রীতদাসদের প্রতি মনিবদের অত্যাচারের তুলনা করলেই ধারণা করা সম্ভব যিশু বা তাঁর শিষ্যদের ধনীর প্রতি বলপ্রয়োগ বা ঘৃণার কারণ কী।

যিশু নাকি বলেছিলেন, তোমার কি ভাবছ আমি পৃথিবীতে শান্তি বিলাতে এসেছি? না, আমি এসেছি অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে। বিরোধ সৃষ্টি করতেই আমি এসেছি। তিনি শেষভোজে সকলকে বলেছিলেন, যার তরবারি নেই, সে যেন নিজের পরিচ্ছদ বিক্রয় করে তরবারি কিনে নিয়ে আসে। যিশু কি তবে ধনীদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার কথা ভেবেছিলেন? যিশু সম্পর্কে এসব পাওয়া যাবে পুরানো খ্রিস্টধর্মের দলিলে। দ্রুত এই ধর্ম ক্রীতদাসদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। খ্রিস্টধর্ম প্রথম ছিল ক্রীতদাসদের ধর্ম। ক্রীতদাসরা যিশুর আদর্শে ধনী মনিবদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে চায়। স্পার্টাকাস বিদ্রোহ ঘটায় প্রথম। শাসকরা ভয় পেয়ে যায়। চার শতকে রোমক সাম্রাজ্যের সম্রাট কনস্ট্যানটাইন বুঝলেন সাম্রাজ্যেকে বিদ্রোহের হাত থেকে বাঁচতে হলে খ্রিস্টধর্মকে সাম্রাজ্যের সরকারী ধর্ম করা দরকার। তিনি তাই করলেন।

ঠিক তারপর থেকে শুরু হলো খ্রিস্টধর্মের সংস্কার।শাসকদের পক্ষে নতুন করে লেখা হলো খ্রিস্টধর্মের সবকিছু। চার্চের হাতে চলে এলো অনেক ক্ষমতা। খ্রিস্টধর্ম হয়ে দাঁড়াল শাসকদের ধর্ম। চার্চের ভয় ছিল যখন তখন আবার পুরানো মূর্তি পূজা ফিরে এসে খ্রিস্টধর্মকে উৎখাত করতে পারে। সেই জন্য চার্চ সকল  পুরানো দেবদেবির মূর্তি ভেঙে ফেলতে বললো। সকল গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলার হুকুম দিল। সাহিত্য নাটক দর্শন চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো। চর্চার একমাত্র বিষয় হলো বাইবেল। বলা হলো, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করলে হত্যা করা হবে। নিষ্ঠুরভাবে আলেকজান্দ্রিয়ায় হত্যা করা হলো হাইপেশিয়াকে চার্চের আদেশে জ্ঞান চর্চা বন্ধ করেনি বলে। মনীষীদের পালাতে হলো সাম্রাজ্যের বাইরে। প্রায় আটশো বছরের জন্য ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞান শিল্পকলা সাহিত্য চর্চা বন্ধ থাকলো, বলতে গেলে সেই রেনেসাঁ পর্যন্ত।

ঘটনাচক্রে চার্চের অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতা আরম্ভ হবার কিছু দিনের মধ্যেই ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম ধর্ম আরবে প্রতিষ্ঠা পেলে মুসলিমরা দেশ জয়ে বের হয়ে পড়ে। মুসলিম বা আরবদের কাছে তখন প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞানবিজ্ঞান মহামূল্যবান মনে হয়। আরবের শাসকরা তখন তা সংরক্ষণ করে। গ্রীসের জ্ঞানবিজ্ঞানকে সঙ্গী করে মধ্যযুগে শুরু হয় আরবদের জ্ঞান সাধনা।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক