রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘মুক্তিযুদ্ধ, ভদ্রলোক ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী’
প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধের পর শিক্ষিত ভদ্রলোককরা এই যুদ্ধে কে কী করেছে, এবং কে কী পায়নি তাই বলতে থাকলেন। মাঝে মাঝে খুব উচ্চস্বরেই ভদ্রলোকরা তাদের ত্যাগ আর না পাওয়ার গল্প বলতে বলতে বাজার মাত করলেন। কিন্তু সকলের বলার কথা ছিল, পুরো জাতির বৃহত্তর অংশকে এই যুদ্ধে কতে রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, এবং স্বাধীনতার পর পুরো জাতির কী প্রাপ্য ছিল। কী ছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা।
সমগ্র জাতির প্রাপ্য ছিল: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ভোটাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা। যুদ্ধের পর যখন যে ক্ষমতায় বসেছেন, এ চাহিদাগুলো পুরণ করা তাদের দায়িত্ব ছিল। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শেষে নিজেদের জন্য আলাদা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চাননি। সমগ্র জাতির জন্যই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রদান করা গেলে আলাদাভাবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার কি দরকার ছিল?
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা প্রদান হচ্ছে টোটকা চিকিৎসা। পুরো জাতিকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কিছু মানুষকে সুবিধা প্রদান। সেই ভাতাটাও যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছেন, তাও নয়। কারণ মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র, যে মুক্তিযোদ্ধা নয় তেমন লোকরাই বেশি পেয়েছে। তার বড় বড় বহু উদাহরণ আছে। যার জন্ম ৭১ সালে সেও নাকি মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র পেয়েছে।
এসব বুঝতে সাহায্য করে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষা কীভাবে ভূলণ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়িয়েছে এখন, কিছু মানুষ সবরকম সুবিধা ভোগ করবে, বৃহত্তর জনসাধারণ কিছুই পাবে না। ন্যায়বিচারটা পর্যন্ত নয়। স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়িয়ে আছে এখন ব্যাংকের লক্ষ লক্ষ টাকা লুটপাট হবে, কিন্তু তার জন্য কারো কোনো শাস্তি হবে না। বরং যারা লুটপাট করেছে, তাদেরকে আরো লুটপাট করার সুযোগ দেওয়া হবে।
রাষ্ট্র প্রশাসন শুধু তাদেরকে দেখলেই সমীহ করবে। লুটপাটকারীরা রাষ্ট্রের জন্য আইন বানাবে। তিপ্পান্ন বছর পর এই অর্থ দাঁড়িয়েছে, আমাদের স্বাধীনতার। স্বাধীনতা মানে, দেশের লক্ষ লক্ষ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে, যা আগে করতো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সব হলো আমাদের স্বাধীনতা, বহু মানুষের রক্ত দেওয়ার পরিণাম। ফলে প্রতি বছর ঘটা করে যে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়, সেটা কেন?
যারা লুটপাট করেছে, সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকছে তাদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা খুব প্রিয় ঘটনা। স্বাধীনতা তাদেরকে এতে কিছু দিয়েছে যে, তারা না হয় স্বাধীনতার আনন্দ ভোগ করছে। কিন্তু স্বাধীনতা যাদেরকে একটা সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়নি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়নি, যাদের জমি কিছু ভূমি দস্যুরা দখল করে নিয়ে গেছে, যারা স্থানীয় গুণ্ডা ও প্রশাসনের কাছে জিম্মি, যাদের নুন আন্তে পান্তা ফুরায়, যারা শীত বৃষ্টিতে পথের ওপর বা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়; তারা কেন এই স্বাধীনতা দিবসে আনন্দ করবে?
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যগুলো কি আদৌ অর্জিত হয়েছে? সত্যি কি আমরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারি, যাদের ওপর অন্য কারো চোখ রাঙানি নেই? একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকের কি মূল্যবোধ আমাদের আছে? আমরা কি স্বাধীনতার আগে কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যেতাম? সন্তানের পড়াশুনার জন্য এতো বিপুল হারে বাইরের দিকে তাকাতাম?
প্রমাণ হয় আমাদের কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। খুব স্পষ্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়। তাহলে স্বাধীনতার পর কি অর্জন করলাম আমরা? যদি আদালতের আঙিনাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে তাহলে দেশের বিচারব্যবস্থার অবস্থা কি, সহজেই বোঝা যায়। স্বাধীনতা বলতে, বিজয় বলতে তাহলে আসলে আমরা কি বুঝি? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিপক্ষের হাতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়, কখনো কখনো নির্মমভাবে প্রাণ দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, এমনকি উপাচার্যরা পর্যন্ত আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকে, সনদপত্র বেচাবিক্রি হয়; স্বাধীনতার মূল্যবোধটা তবে কী? শিক্ষার অঙ্গনেই যদি অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট চলে; তাহলে মানুষ সততা, দায়িত্ববান হওয়া শিখবে কোথায়? সাংবাদিকরা যদি চাটুকার হয়, দলের লেজুরবৃত্তি করে, ক্ষমতাবানদের পদলেহন করে, বিলাসবৈভবে দিন কাটাতে চায়, তাহলে সত্যিকারের সংবাদ পাওয়ার সুযোগ আছে কি?
অযোগ্যতরা যেখানে প্রতিনিয়ত পুরস্কার পদক পায়, সেখানে কি যোগ্য লোকরা পূর্ণমাত্রায় নিজেদের বিকশিত করতে পারে? স্বাধীনতার পর একটা রাষ্ট্র কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আসলে? সমাজতন্ত্র ছিল সংবিধানের চার মূলনীতির এক মূলনীতি। সেই সমাজতন্ত্র কি এখন আর শিক্ষিতদের আলোচনায় আছে? কখনো সেই সম্পর্কে কি সরকারি ভাষ্যে কিছু পাওয়া যায়? সাধারণ মানুষ ৮৫ শতাংশ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এই আশায় যে, যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে তাদের ভাগ্য পাল্টাবে।
কিন্তু যারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, স্বাধীন দেশের সব প্রতিষ্ঠানে কিংবা সব বাড়িতে কি তাদের প্রবেশাধিকার আছে? তাহলে এটা কেমন স্বাধীনতা, কার জন্য এই স্বাধীনতা? মুক্তিযুদ্ধের পর সাধারণ ঘরের মানুষরা যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গেল। যারা নিজের জায়গায় থেকে চাষবাস বা অন্য কিছু করছিল, নিজের জায়গাতেই রয়ে গেল। যুদ্ধের পর পদক ভাগাভাগির ব্যাপারটা তারা জানতো না বা বুঝতো না।
সেখানে যে তাদের কিছু পাবার আছে, সেটাও মাথায় রাখতো ন না। কখনো নিজেরা তারা নিজের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিয়ে আস্ফালন করেনি। স্বপ্ন দেখতো, দেশ স্বাধীন হয়েছে এখন আর আগের সঙ্কটগুলো তাদের জীবনে থাকবে না। সব মানুষ স্বাধীন দেশে ভালো থাকবে। কিন্তু তেমন ঘটলো না।
স্বাধীন দেশে লুটপাটকারী ভদ্রলোকদেরই কণ্ঠস্বরই সর্বদা অনেক উঁচুতে আছে। যা খুশি তারা বলতে পারে, যতরকম দরকার ক্ষমতা দেখাতে পারে। কিন্তু যারা স্বাধীনতা এনেছিল এবং এদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে, সেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা বলার সুযোগ নেই। তাঁদের দায় শুধু মাত্র ক্ষমতাবান ভদ্রলোকদের ভোগবিলাসের জন্য শ্রমদান করা। এই হলো সার্বিক অর্থে আমাদের স্বাধীনতা।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ