রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘নাট্যকর্মীদের দায়’

প্রকাশিত : জুলাই ২৪, ২০২২

সাধারণ নাট্যকর্মীদের উদ্যোগে আয়োজিত ‘থিয়েটার চর্চায় সাম্প্রতিক সংকট ও উত্তরণ’ শীর্ষক আজকের আলোচনাটি ছিল প্রাণবন্ত এবং যথেষ্ট চিন্তাসমৃদ্ধ। চিন্তাসমৃদ্ধ আলোচনাগুলি করেছেন প্রধানত নতুন প্রজন্মের নাট্যকর্মীরাই। আগের প্রজন্ম বা নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করলেও তাদের অনেকের বক্তব্য ছিল সেই চিরাচরিত ধারার। কখনো নিজেদের অতীতের ভুল-ত্রুটির কথাগুলো তারা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। বরং তারা প্রকারান্তরে নিজেদের সাফল্যের কথা বলতে বাকি রাখেননি। বহু কথাই বলেছেন তারা, কিন্তু সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখেননি। তবুও তারা সাধারণ নাট্যকর্মীদের নতুন ধরনের চিন্তাচেতনার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক। বিশেষ করে রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এর আগে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সঙ্কটের সমাধানে যে চিঠি দিয়েছেন, সেগুলি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ সম্পূর্ণভাবেই সেখানে যৌক্তিক প্রস্তাব দিয়েছেন, যার ভিতর দিয়ে সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার দুর্ভাগ্য বা অশনি সঙ্কেত এই যে, প্রতিপক্ষ সেই চিঠির জবাব দেয়া পর্যন্ত প্রয়োজন বোধ করেননি। রামেন্দু মজুমদারের চিঠি নিয়ে দু’চারজন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। মানুষকে সম্মান দেখানোর সাধারণ ভব্যতা পর্যন্ত ভুলতে বসেছেন কিছু মানুষ। সেসব প্রত্যক্ষ করে বা জেনে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রমুখের সঙ্গে আমার যথেষ্ট চিন্তাচেতনার পার্থক্য রয়েছে। সেসব কারণে তাদের সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু তাদেরকে অসম্মান করার কথা ভাবতেই পারি না। কারণ তাহলে তাদের সঙ্গে আমার এতদিনের ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের মর্যাদা কোথায় রইলো! বহুজনের বহু বক্তব্যের সঙ্গে আমি আজকেও একমত ছিলাম না। কিন্তু তার মানে এ নয়, তাদেরকে অসম্মান করতে হবে। সকলের সঙ্গেই আমার মত মিলতে হবে কেন?

যাই হোক, আজকে রামেন্দু মজুমদার, মফিজুর রহমান লাল্টু আর আজাদ আবুল কালাম পাভেলের বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়েছি। উদ্যোক্তাদের লিখিত বক্তব্যটি যথেষ্ট চিন্তার খোরাক জোগায়। কিন্তু তাদের সব বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ইতিহাস নিয়ে তাদের মন্তব্য আর গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে তাদের আবেগের সঙ্গে একমত নই। ঠিক যেমন একজন বলেছেন, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের জন্যই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগগুলো খোলা হয়েছে। এটা ভুল তথ্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ খোলার সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কোনো ভূমিকা নেই। সেখানে আছে কয়েকজন ব্যক্তির ভূমিকা। ইতিহাস জেনে বরং সেই ব্যক্তিদের সম্মান দেখানো দরকার। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সম্পর্কে বরং আমি রামেন্দু মজুমদারের আজকের বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সঙ্গে নাট্যচর্চার কী সম্পর্ক? নাট্যচর্চা করতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন লাগে না। কথাটা সঠিক বলেছেন তিনি। বরং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নাট্যচর্চা করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু দলকে নিজেদের প্রতিপক্ষ মনে করে। সত্যি বলতে ফেডারেশন এখন একটা পেশীশক্তি, ফেডারেশনের গঠনতন্ত্রই যারা মানছে না। মামুনুর রশীদ যে কথা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সহস্র নাটকের দল ছিল একসময়ে, যারা নিয়মিত নাটক করেছে। কিন্তু সেজন্য কোনো ফেডারেশন লাগেনি। কথাটা খুবই সত্যি। কোনো দেশেই নাটক করতে ফেডারেশন লাগে না। রামেন্দু মজুমদারের বক্তব্য এক্ষেত্রে খুবই জোরালো ও যুক্তিসঙ্গত। নাসির উদ্দীন ইউসুফও চমৎকারভাবে বলেছেন, এসব প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করে, যা সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে। এটা কি খুবই হাস্যকর নয়, তারা নাটক করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে না কিন্তু কর্তৃত্ব ফলাবে?


সবচেয়ে বড় কথা, একটা নাট্যদলের মাত্র একজন সদস্য থাকে ফেডারেশনে। তাহলে বাকি নাট্যকর্মীদের কী কাজে আসে এ প্রতিষ্ঠানটি? সাধারণ নাট্যকর্মীদের অনেক অভিযোগ ছিল আজকে, বর্তমান গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বিরুদ্ধে, তবুও তারা আবার ফেডারেশন নিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছেন। কান্নাকাটি করেছেন আগের অনেক চেয়ারম্যানসহ আসাদুজ্জামান নূর, মফিদুল হক প্রমুখ। বলেছেন, বিরোধ করা যাবে না। কী আশ্চর্য কথা! যাদেরকে মত বিনিময় করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও আসেননি, তাদের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া উপায় কী? রামেন্দু মজুমদারের বক্তব্য সেখানে ছিল ভিন্ন, ধারালো, স্পষ্ট। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নিয়ে তিনি কোনোরকম মায়াকান্না না দেখিয়ে বলে দিয়েছেন, নাট্যচর্চা করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানের দরকার নেই। শতভাগ সহমত আমি তার সঙ্গে। ভালো নাটক করার জন্য ফেডারেশনের কী দরকার?

নাট্যকর্মীদের অনেকে বলেছেন, তারা কারো সঙ্গে বিরোধ করতে চান না, এক সঙ্গে থাকতে চান। মনে রাখতে হবে, লড়াইটা যদি মতাদর্শগত হয়, তাহলে একসঙ্গে থাকার সুযোগ নেই। লড়াইটা যদি হয় স্বার্থের, ভাগাভাগির। তাহলে আবার মিলমিশ হতেই পারে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন তখন বড় জোর এক শক্তির পরিবর্তে আর এক পক্ষের ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা হবে। বরং নতুন প্রজন্ম নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে যে নতুন প্রবাহ এনেছে, নাট্য নির্দেশনার ক্ষেত্রে যেসব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, নতুন যেসব ইতিবাচক চিন্তায় আন্দোলিত করেছে তাদের উপস্থাপন করা ছোট প্রস্তাবনায়; সেজন্য গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং নাট্যকর্মীদের সকলের অংশগ্রহণ করার মতো নতুন একটি জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। সকলে যেখানে আসবে নাটককে আরো ভালো করে বুঝে নেয়ার জন্য। জনগণের সঙ্গে, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাট্যচর্চার যোগসূত্র কোথায়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য। জনবিচ্ছিন্ন নাট্যচর্চার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

সত্যি বলতে, গ্রুপ থিয়েটার বলে কি আদৌ কিছু আছে? গ্রুপ থিয়েটার চর্চা আবার কী? নাট্যচর্চা মানেই একটা দলগত ব্যাপার। সেখানে গ্রুপ থিয়েটার কথাটার আবার নতুন কী অর্থ দাঁড়ায়? গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের কেউ কি আমাকে বোঝাতে পারবে গ্রুপ থিয়েটার বলতে কী বোঝায়? প্রতিদ্বন্দ্বিতা জানিয়ে বলছি, একজনও বোঝাতে পারবেন না। সকলে তারা এসব কথা অন্যদের মুখে শুনে শুনে এখানে চালু করে দিয়েছেন। দু’পৃষ্ঠা লিখে কেউ বলুক দেখি, গ্রুপ থিয়েটার কী, কোথায় এর জন্ম, কথাটা কোথা থেকে এসেছে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মূল লক্ষ্যটা কী? আমি নিশ্চিত স্পষ্টভাবে কেউ বলতে পারবেন না। কিছু বলতে গেলে আমার বই থেকেই সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার বলে কোনো আন্দোলন ছিল বা আছে, তা প্রমাণ করতে পারবেন না। গ্রুপ থিয়েটার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নাটকের একটা দলের নাম। কিন্তু এ নামে কোথাও কোনো ফেডারেশন ছিল না। গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চা বলে কোথাও কিছু ছিল না।

ঋত্বিক ঘটক যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে একবার গ্রুপ থিয়েটার নাম দিয়ে নাটকের দল গঠন করতে চেয়েছিলেন। গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চা বলে যখন কিছু নেই, তাহলে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন থাকে কোন্ যুক্তিতে? গ্রুপ, থিয়েটার, ফেডারেশন, তিনটিই ইংরেজি শব্দ। বাংলাদেশে এমন বিদেশি শব্দবহুল ও অর্থহীন লক্ষ্যহীন একটা ফেডারেশন লালন করার দরকার কী? সামান্য দরকার নেই। বর্তমানে এর দরকার শুধু এটুকু যে, যদি এ প্রতিষ্ঠানে কোনো দুর্নীতি হয়ে থাকে, সেটার তদন্ত করে বিচার করার জন্য। সুস্থ নাট্যচর্চার জন্য এ রকম প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই। রামেন্দু মজুমদারের এ বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে লাল্টু আর পাভেলের কণ্ঠে কণ্ঠস্বর মিলিয়ে বলতে চাই, নাট্যকর্মীরা কারো দালালি করতে পারে না। বরং তাদের কাজ সমাজের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

সাধারণ নাট্যকর্মীদের উদ্যোগে শনিবার আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রেক্ষিতে লেখা

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ