রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘তাহাদের কথা’

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০২১

বর্তমান সমাজ নানারকম স্তরে বিভক্ত। সর্বোচ্চ স্তরে আছে সমাজের সবচেয়ে বড় বড় ধনীরা। ধনীদেরকে অনেকে অভিজাত বলে মান্য করে। সকলে অবশ্য সব ধনীদের অভিজাত বলে মানতে চায় না, সকলের পারিবারিক বনেদিয়ানা না থাকার কারণে। মানতে না চাইলে কী হবে, টাকা কথা বলে! কিন্তু টাকা থাকলেও বনেদিয়ানা না থাকার কারণে কিছু ধনী মানুষ যে হীনমন্যতায় ভোগে না, তা নয়। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করে বা আত্মীয়তা গড়ে অনেকে বনেদিয়ানা কিনছে। এসব হলো সমাজের সবচেয়ে ধনী মানুষদের কথা।

সমাজের সবাই ততটা ধনী নয়। কিন্তু কম ধনী সমাজেও কিছু অভিজাত মানুষ থাকে। কারণ সামন্তবিশ্বাস বা সেই সংস্কৃতি এখনো আমাদের সমাজে বহমান। বিয়ের বাজারে এখনো বংশপরিচয় আলোচনায় আসে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এখনো পুরোপুরি স্থান পায়নি আমাদের সমাজে। পিতা বা স্বামীর পরিচয়টা খুব দরকার হয়, রাজনীতি বা সবক্ষেত্রে। নারীবাদীরাও অনেকে সুবিধা মতো স্বামী বা পিতার নাম কাজে লাগায়। পুরুষরা অনেকে দরকার মতো মাতার নাম বা বংশ পরিচয় কাজে লাগায়। পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমাদের সমাজে, খুব তাড়াতাড়ি হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে পুঁজির দৌরাত্ম্য আর ব্যাপক লুটপাটের কারণে।

যা বলছিলাম, সব মানুষ অভিজাতদের দলে থাকার সুযোগ পায় না। ফলে তাদের অনেকে অভিজাতদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। অনেকে অভিজাত সমাজ ভেঙে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এবং তার জন্য লড়াই করে।

বহুজন আছে, অভিজাত সমাজের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না কিন্তু সমাজে এ ধরনের বৈষম্য থাক, সেটাও চায় না। যদিও তাদের সংখ্যাটা খুব কম। বহুজন আছে, অভিজাত সমাজের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না, সেটাকে ইতিহাসের নিয়ম হিসেবে দেখে। সেই সঙ্গে মনে করে, সমাজে এরকম বৈষম্য থাকা ঠিক নয়। যুক্তির দ্বারা বা সংস্কারের দ্বারা এর পরিবর্তন আশা করে বা সমাজ বিপ্লবের দ্বারা। বহু অভিজাত মানুষ আছে, তারাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এরকম বৈষম্য থাকার দরকার নেই। তাদের মধ্যের একদল আবার এমন সমাজ ভাঙার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়তে প্রস্তুত। ইতিহাসে এমন উদাহরণ অনেক।

ভিন্ন দিকে আরেক দল মানুষ আছে যারা অভিজাত সমাজের বাইরে যতক্ষণ থাকে অভিজাতদের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করে, হীনমন্যতায় ভোগে। নিজের হীনমন্যতা থেকেই আবার তীব্রভাবে অভিজাত হবার বাসনা লালন করে। সুযোগ পেলেই তারা জীবনযাপনে অভিজাতদের নকল করে। নিজেদের রুচি বা মতাদর্শ বলে তাদের কিছু থাকে না। সবসময় ধনীদের নকল করে সমাজে বা আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের কাছে নিজেকে বড় বা মান্য করে তুলতে চায়। সব সময় তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে গাড়ি বাড়ি পোষাক গহনা আর নামিদামি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার গল্প।

বিভিন্ন বড় বড় শহরের নাম করা পোষাকের দোকান বা রেস্টুরেন্টের এরাই সর্বাধিক ক্রেতা। নিজেদেরকে তারা এসব পণ্যের ভোক্তা বলে প্রমাণ করে। কারণ তা নাহলে তাদের মানসম্মান থাকে না। সত্যি বলতে, তাদের কাচের মানসম্মান যখন তখন ভেঙে যেতে পারে। ফলে প্রতিনিয়ত তারা বিলাস দ্রব্য কেনাকাটার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। নিজের আয়ের দিকে না তাকিয়ে এরা প্রতিযোগিতা করে বাজারে নিজের সম্মান বা প্রতিপত্তি বাড়াবার জন্য। সত্যিকারের অভিজাত হয়ে ওঠর সামান্য গুণাবলি এদের নেই, এদের মুখের বুলি শুনলে যে কেউ সেটা টের পাবে।

সমাজে যে তাদের তেমন কোনো অবদান, নেই তাও না। কখনো কখনো যথেষ্ট অবদান রাখে এ দলের কেউ কেউ। কিন্তু তাদের আচরণ বা কথাবার্তা খুবই স্ববিরোধী। যখন তখন তারা রূপ পাল্টাতে পারে। ফলে তাদের কাজকর্ম সমাজের অনেক ক্ষতি করে। নিজেরাও নিজেদের অনেক ক্ষতি করে। সমাজের অগ্রগতির পথে এরা এক বিরাট বাধা। মনে রাখতে হবে, সমাজে এদের প্রভাব যথেষ্ট। কারণ বাজার অর্থনীতির এরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।