প্রতীকী ছবি
রাসেল মাহমুদের গদ্য ‘দেড় যুগ পার হলো, বাবা এলেন না’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০২, ২০২৫
সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অন্তত ৭ কিলোমিটার। কম হবে? না, আরও বেশি? দূরত্ব যাই হোক, হেঁটেই যাই। একা। মাঝে মাঝে আঁচলের গিঁট খুলে মা ২০-৩০ টাকা দিলে তবেই ভ্যানে চড়ার সুযোগ হতো। সেটা না-পেলে হন্টনই একমাত্র উপায়। এভাবেই দিন যায়...
ছেলের কষ্ট হচ্ছে ভেবে একদিন বাবা মনস্থির করলেন, একটা সাইকেল কিনে দেবেন। সেই আনন্দে ছেলের `দিন কাটে তো রাত কাটে না` অবস্থা...। `দিন চলে যায় গুনগুনিয়ে` কিন্তু সাইকেল আর বাড়ি আসে না। মায়ের কাছে কতবার, `সাইকেল কবে পাব` জানতে চেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মা আমার সদুত্তর দিতে পারেননি। পাছে বাবার অর্থনৈতিক অক্ষমতা ছেলের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়!
তবে বাবা তার সক্ষমতা ঠিকই দেখিয়েছিলেন। ওই তো সেইবার, যেবার গমের ফলন ভালো হলো, ওই গম বিক্রির টাকা আর আমাকে নিয়ে কোনো এক শনি বা বুধবার বিকেলে হাটে গেলেন। অনেক ঘুরে সন্ধ্যার কিছুটা পরে সেকেন্ড বা থার্ড হ্যান্ড একটা সাইকেলে কিনে দিলেন। সাইকেল পেয়ে সেদিন কত যে খুশি হয়েছি...। তবে আমার থেকেও সেদিন বেশি খুশি দেখেছি বাবাকে।
পাট ধোয়ার মৌসুম। সকালে বাবা বিলে যান পাট ধুতে। বাড়িতে সেই পাট শুকান মা। আর আমি প্রহর গুণি, কবে শুক্রবার বা সোমবার হবে, কবে হাটে যাব, কবে পাট বিক্রি হবে, পেটপুরে মিষ্টি খাব।
এক শুক্রবার সকালে কয়েক মণ পাট আর আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বিত্তিডাঙ্গার হাটে যান বাবা। পাটের দাম ভালোই পাওয়া গেল। এবার মিষ্টি খাবার পালা। দোকানে গিয়ে দুই ছেলেকে মিষ্টি আর পাউরুটি খাওয়ালেও বাবা খাননি। দুই ছেলের খাওয়া দেখে বাবার চোখে যে তৃপ্তি দেখেছি, আজও তা আমার হৃদয়ে রাতের আকাশের নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে।
ছোটবেলার কথা। তখন আমার বয়স কতই-বা হবে। ১০ কী ১১। আব্বু বিড়ি খেতেন। একদিন আমার হাতে বিড়ি দিয়ে চুলা থেকে আগুন লাগিয়ে আনতে বললেন। চুলার কাছে গেলেও মা সেদিন আমাকে বিড়িতে আগুন দিতে দিলেন না। ওইদিন রাতে মাকে একটু উচ্চস্বরেই বাবাকে বলতে শুনেছি, ‘আপনি ছেলেকে দিয়ে বিড়ি ধরাচ্ছেন, ছেলে নিজে যদি বিড়ি ধরে? কিছু বলতে পারবেন?’
তারপর কত বড় হলাম। আমারও ‘বিড়ি খাওয়ার’ বয়স হলো! কিন্তু বাবাকে আর কোনোদিন বিড়ি খেতে দেখিনি।
বাবা তখন মাত্র ৪২/৪৩ অতিক্রম করছেন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার ডাক্তার ‘বেটে খাওয়া’ শেষ। কবিরাজের মিকচার বা গাছের বাকল, কিছুই বাদ নেই। রাত হয়, মা আব্বুর বুকে তেল মালিশ করেন। নির্ঘুম রাত দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘ হয়। সেই রাতেই মায়ের কাছে বাবা আবদার করেন, স্কুলের গণ্ডিতে থাকা তিন ছেলে-মেয়েকে যেন অন্তত বিএ পাশ করানো হয়।
মা যখন বাবাকে আশ্বস্ত করেন, যত কষ্টই হোক তিনি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাবেন। ওই আশ্বাসে বাবার বুকের ব্যথা কমেছিল কিনা জানি না। তবে আশ্বস্ত হতে দেখেছি, ভরসা পেয়েছেন বলে মনে হয়েছে।
সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। হোস্টেলে থাকি। ডিসেম্বর শেষে শীতের ছুটিতে বাড়িতেই আছি। বাবাকে তখন কিছুটা সুস্থ মনে হতো। বাবার দুই ছেলেই তখন কলেজ পড়ছে। একমাত্র মেয়েও পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে হাইস্কুলে। একটু একটু করে আমরা ‘বিএ পাশের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সংসারে অভাব থাকলেও বাড়িতে কেমন যেন শান্তি শান্তি আবহ।
তবে এক শীতের সকালে সেই শান্তির নীড়ে ঝড় এলো। প্রচণ্ড ঝড়, যেন সিডর-আইলা বা তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি গতির কিছু। বাবা স্ট্রোক করলেন। দ্রুত নেওয়া হলো হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ‘ভালো কোথাও’ নেওয়া যায় কিনা, ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যেই ডাক্তাররা পরামর্শ দিলেন বাড়ি ফিরিয়ে আনার। জানালেন, ‘সময় শেষ।’
হলোও তাই। একরাত হাসপাতালে কাটিয়ে বাবা যখন নিজের কুঁড়ে ঘরে ফিরলেন তখন আমাদের চারদিকে অসীম শূন্যতা। বাড়িভর্তি মানুষ। আত্মীয়-স্বজন।
হাসপাতাল থেকে ফিরে বাবা আর অপেক্ষা করলেন না। নিজের আসল ঠিকানায় ফেরার বড্ড তাড়া ছিল তার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের ভীষণ একা করে যাত্রা করলেন অনন্তের পথে...। সেই যে গেলেন, আর এলেন না।
আজকের মতো সেদিনও ছিল ২ জানুয়ারি...
তারপর,
তারপর এক এক করে দেড় যুগ পার হলো। বাবা আর এলেন না।