রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, শপথ ও সাংবিধানিক আইন
মো. সোহাইল জামিল সরকারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০১৮
বাংলাদেশের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের সকল শাখার আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হচ্ছেন দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন এ দেশটি রাষ্ট্রপতির শাসন ও সংসদীয় গণতন্ত্র উভয় পদ্ধতিতেই পরিচালিত হয়েছে। ফলে সময়ে সময়ে বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পদ্ধতিতেও পরিবর্তন হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু করা হয়। অর্থাৎ ১৯৯১ সালে ১২তম সংবিধান সংশোধনের পূর্বপর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতো জনগণের ভোটের মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে ১২তম সংবিধান সংশোধনের ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আবারো সংসদের কাছে চলে যায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এ নিয়মেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
জাতীয় সংসদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর একটা বড় বিষয় সামনে চলে আসে। আর তা হলো, রাষ্ট্রপতির শপথ বাক্য পাঠ করানো। ১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের কমিটি ৪ ডিসেম্বর গণপরিষদে যে সংবিধানটি পাশ করায়, তাতে রাষ্ট্রপতির শপথ বাক্য পাঠ করানোর কাজটি প্রধান বিচারপতির উপর ন্যাস্ত করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরী ও রাষ্ট্রপতি মো. মুহাম্মদুল প্রধান বিচারপতির মাধ্যমেই শপথ বাক্য পাঠ করেন। বছর কয়েক পরেই ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রপতিকে শপথ বাক্য পাঠ করানোর বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে তুলে নিয়ে স্পীকারের কাছে অর্পণ করা হয়।
সংবিধানের এই চতুর্থ সংশোধনীটি অবৈধ আখ্যায়িত করে জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুলসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবং সে রাতেই (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করেন। উল্লেখ, ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক অর্ডিন্যান্স জারি করে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। সেই শপথটি ছিল স্পীকারের কাছে পাঠ করা বাংলাদেশের কোনও রাষ্ট্রপতির প্রথম শপথ বাক্য পাঠ।
এরপর সংবিধানে বহুবার সংশোধনী এসেছে। সাথে রাষ্ট্রপতিকে শপথ বাক্য পাঠ করানোর প্রক্রিয়াতেও এসেছে পরিবর্তন। সর্বশেষ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবারও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে শপথ বাক্য পাঠ করার বিধানটি স্পীকারের কাছে আনা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে শপথ পাঠ করানোর দায়িত্ব স্পীকারের কাছে দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন দাখিল করেন। সর্বশেষ গত ২৪/৪/২০১৮ তারিখে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ টানা দ্বিতীয় বারের মতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সাথে সাথে স্পীকারের দ্বারা রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়ানোর প্রক্রিয়াটাও এ ইতিহাসের সাথে নিজেকে সামিল করে নেয়।
উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে রাষ্ট্রপতিকে শপথ পাঠ করান সে দেশের প্রধান বিচারপতি। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে শপথ পড়ানোর নিয়মটা রাখা হয়েছিল।
লেখক: এলএলবি (অনার্স) এলএলএম
শিক্ষানবীশ
গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতি