ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

রাবেয়া বসরির কিস্‌সা

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০২০

ইরাকের বসরা নগরীর দরিদ্র এক পল্লীতে জন্মান সুফি সাধক হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)। তিনি ৯৫ হিজরী, মতান্তরে ৯৯ হিজরি, ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তার জন্ম। পিতার নাম ইসমাঈল এবং মাতার নাম মায়ফুল। গরিব হলেও পরিবারটি ছিল পরম ধার্মিক। ছোটবেলা থেকেই রাবেয়া ছিলেন ভদ্র, নম্র, সংযমী এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। সব সময় তিনি গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। রাগ, হিংসা ও অহংকার তার চরিত্রকে কখনো কলুষিত করতে পারেনি। জীবনের ওপর দিয়ে ঘটে যাওয়া সকল বিপদ-আপদকে তিনি পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতেন। রাবেয়া দাসত্ব জীবনও কাটিয়েছেন। তার মনিব ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাবেয়াকে কাজ করতে হতো। কাজ শেষে তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে যেতেন। আল্লামা ফরিদ উদ্দীন আত্তার রচিত ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’য় তার বিষয়ে কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। সেখান থেকে কয়েকটি ঘটনাকে কাহিনিরূপ দিয়েছেন আবু তাহের সরফরাজ

প্রেমে চাওয়া-পাওয়া থাকে না

রাবেয়া বসরির মজলিশে কয়েকজন দরবেশ এলেন। নানা বিষয় নিয়ে তারা আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। একপর্যায়ে রাবেয়া জিগেশ করলেন, আচ্ছা, আপনারা কেন আল্লাহর ইবাদত করেন?
এক দরবেশ জবাব দিলেন, জাহান্নাম খুবই ভয়ানক এক জায়গা। আমি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেতেই আল্লাহর ইবাদত করি।
আরেক দরবেশ বললেন, জান্নাতের সুখ-সাচ্ছন্দ ভোগ করতেই আমি ইবাদত করি।
রাবেয়া এবার বললেন, জান্নাত-জাহান্নাম যদি না থাকত, তবে কি আপনারা ইবাদত করতেন না?
দরবেশরা কথা বলতে পারল না।
রাবেয়া বললেন, ভয়ে কিম্বা কোনো কিছু পেতে যে প্রেম তৈরি হয়, তা মেকি। সত্যিকারের প্রেমে কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকে না। থাকে কেবল আনন্দ।

প্রভাব

রাবেয়া বসরির মজলিশে বসে কথাবার্তা বলছেন সাম্মাক ও জুনুন মিশরি। একটু পরই উৎবা এসে বসলেন সেখানে। সাম্মাক তাকে বললেন, আপনার হেঁটে আসা আর বসার ভঙ্গিও মধ্যে এক ধরনের দর্প আছে।
উৎবা জবাব দিলেন, থাকবে না কেন, বলুন? আমি যার দাস, তিনি এই মহাবিশ্বের মালিক। তার কোনো প্রভাবই কী আমার ওপর পড়বে না?

কম্বল

এক শিষ্যের হাতে চার দিরহাম দিয়ে রাবেয়া বসরি বললেন, বাজার থেকে একটা কম্বল নিয়ে এসো।
শিষ্য জিগেশ করল, উলের, না পশুর চামড়ার?
সাথে সাথে শিষ্যের হাত থেকে দিরহামগুলো নিয়ে নিলেন রাবেয়া। এরপর বললেন, যে জিনিস কেনার আগেই এত রকমভেদ ভাবতে হয়, তা কেনার পর না-জানি আরো কত কী ভাবতে হবে। দরকার নেই আমার কম্বলের।

মুদ্রা কী উপকারে আসবে

রাবেয়া বসরি অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। খবর পেয়ে দেখতে এলেন হাসান বসরি। দরজার কাছে একজন দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে রুপার মুদ্রাভর্তি একটি থলে। হাসানকে দেখে লোকটি এগিয়ে এলো। সালাম দিয়ে বলল, হুজুর, রাবেয়ার অবস্থা জেনে আমি তার জন্য কিছু মুদ্রা এনেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না। শুনেছি, তিনি কোনো মানুষের কাছ থেকে কিছু নেন না। এখন আপনি যদি আমার ব্যাপারে একটু সুপারিশ করতেন...
হাসান রাবেয়ার সাথে দ্যাখা করে লোকটির কথা বললেন।
রাবেয়া বললেন, যে আল্লাহর বিরোধিতা করে আল্লাহ তার জীবিকা বন্ধ করেন না। আর যে তার জন্য এ জগৎ-সংসার ছেড়ে দিয়েছে, তাকে তিনি জীবিকা ছাড়াই বাঁচিয়ে রাখেন। এখন আপনিই বলুন, লোকটির মুদ্রা আমার কী উপকারে আসবে?
হাসান বসরি কোনো জবাব দিতে পারলেন না।

সুখি কে

মালেক দিনার এলেন রাবেয়া বসরির বাড়িতে। দেখলেন, ব্যবহারের জন্য দু’চারটে মামুলি জিনিস ছাড়া তার ঘরে আর কিছুই নেই। টুকটাক কথাবার্তার ফাঁকে তিনি রাবেয়াকে বললেন, আপনার অনেক ধনী ভক্ত আছেন। যদি অনুমতি দেন, তবে তাদেও কাছ থেকে আপনার দরকারি জিনিসপত্র আমি এনে দিতে পারি।
রাবেয়া জবাব দিলেন, আমার ও আমার ধনী বন্ধুদের জীবিকা দেন কে?
মালেক বললেন, আল্লাহ।
রাবেয়া বললেন, তিনি যখন আমাকে দিচ্ছেন না, তখন তারই দেয়া দান আরেকজনের কাছ থেকে আমি আবার কেন দান নেব? আমি যদি দরকার মনে করি, তবে আমারই উচিত তা আয় করে নেয়া। আমার যা আছে, আমি এতেই সন্তুষ্ট। জগতে এ সন্তুষ্টি যার থাকে, সে সুখি। এর বাইরে আর কোনো মানুষ সুখি নয়।

বোবা হয়ে যেতে

রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন রাবেয়া বসরি। কান্নার শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন, রাস্তার পাশে বসে একলোক কাঁদছে, আর বিলাপ করছে, হায় দুঃখ! হায় দুঃখ!
রাবেয়া তার কাছে গিয়ে বললেন, এভাবে না বলে, বলো, আহ, জীবন কত নিশ্চিন্ত। তোমার মধ্যে সত্যিকারের দুঃখ যদি থাকত, তুমি বোবা হয়ে যেতে।

প্রেমের সত্যিকারের চেহারা

রাবেয়া বসরির বাড়িতে এলেন মালেক দিনার ও শাকিক বলখি। মেতে উঠলেন তারা কথাবার্তায়। প্রেমের সত্যিকারের চেহারা কি, তা নিয়ে মতামত দিতে লাগলেন তারা।
মালেক দিনার বললেন, প্রেমাস্পদের দেয়া প্রতিটি আঘাত যে মানুষ বুক চেতিয়ে বয়ে বেড়াতে পারে, তার প্রেমই খাঁটি।
শাকিক বলখি বললেন, প্রেমাস্পদেও দেয়া আঘাতে রক্তাক্ত হতে হতে যে মানুষ প্রেমাস্পদের প্রতি আগের চেয়ে আরো বেশি প্রেম অনুভব করে, তার প্রেমই সত্যিকারের প্রেম।
ঠিক তা-ও নয়, বললেন দিনার।
রাবেয়া জিগেশ করলেন, তবে কী রকম?
দিনার বললেন, প্রেমাস্পদেও দেয়া আঘাতেও যে মানুষ আনন্দ অনুভব করে, তার প্রেমই সত্যিকারের।
রাবেয়া বললেন, হ্যাঁ, এইবার ঠিকাছে। তবে আরো একটু যোগ করা যেতে পারে।
শাকিক জিগেশ করলেন, সেটা কি?
রাবেয়া বললেন, প্রেমাস্পদকে দেখেই যে মানুষ তার দেয়া রক্তাক্ত সব আঘাতের কথা ভুলে যায় আর আনন্দ অনুভব করে, সে-ই আসলে প্রেমের রাজত্বে বেঁচে থাকে। আপনারা দেখুন, হজরত ইউসুফকে দেখে মিশরের তাবৎ রূপসীরা আপেল কাটতে গিয়ে নিজেদের আঙুল কেটে ফেলেছিল। অথচ তারা একটুও যন্ত্রণা টের পেল না।

কাপড়ের পট্টি

মসজিদে বসে আছেন রাবেয়া বসরি। এক শিষ্য এলো। মাথায় কাপড়ের পট্টি।
রাবেয়া জিগেশ করলেন, মাথায় পট্টি কেন?
শিষ্য জবাব দিল, মাথায় দারুণ ব্যথা হচ্ছে। তাই পট্টি বেঁধে রেখেছি।
রাবেয়া জিগেশ করলেন, তোমার বয়স কত?
শিষ্য জবাব দিল, তিরিশ বছর।
রাবেয়া জিগেশ করলেন, এতদিন সুস্থ ছিলে, না অসুস্থ?
শিষ্য বলল, সুস্থ ছিলাম।
রাবেয়া এবার বললেন, সুস্থতার জন্য এতদিন কোনো চিহ্ন কেন মাথায় বাঁধলে না? আর যেই অসুস্থ হলে, সাথে সাথে কষ্টের চিহ্ন মাথায় বেঁধে ফেললে?

বিনা বাক্যব্যয়ে

বিকেলে ছায়া ছায়া নরম আলো মসজিদের মাঠে। কিছু বাচ্চা খেলছে। হইচই করছে। মসজিদের দরজার কাছে বসে আছেন হাসান ও রাবেয়া বসরি।
রাবেয়াকে হাসান জিগেশ করলেন, আত্মার এত গভীরতা আপনি কীভাবে পেলেন?
রাবেয়া জবাব দিলেন, নিজের অস্তিত্ব সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিলীন করে দিয়ে।
হাসান এবার জিগেশ করলেন, তাকে কোথায় পেলেন?
রাবেয়া জবাব দিলেন, আপনি তাকে পেয়েছেন যুক্তিতর্ক শেষে। আর আমি পেয়েছি বিনা বাক্যব্যয়ে।
কিছু সময় চুপ থেকে হাসান জিগেশ করলেন, ইবলিস বিষয়ে আপনার ধারণা কি?
রাবেয়া জবাব দিলেন, আল্লাহর প্রতি আমি এতটাই মগ্ন যে, ইবলিসকে নিয়ে ভাবার সময় আমার নেই।

মোমবাতি, সুই ও চুল

সন্ধের মুখে একলোক এসে দাঁড়ালো হাসান বসরির বাড়ির দরজায়। হাঁক দিল, হুজুর কি বাড়িতে আছেন?
দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন হাসান।
লোকটি বলল, রাবেয়া বসরি আপনাকে এই বাকসোটি উপহার পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে গুপ্তধন আছে।
বাকসো হাতে নিয়ে হাসান বললেন, তাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবেন। আর বলবেন, শিঘ্রই আমি তার সাথে দ্যাখা করবো।
লোকটি বিনীতভাবে বলল, জি, এবার তবে আমি যাই।
লোকটি চলে গেলে ঘরে এলেন হাসান বসরি। কী এমন গুপ্তধন তাকে পাঠালেন রাবেয়া, বুঝে তিনি উঠতে পারলেন না। কিছু সময় বসে রইলেন। এরপর খুললেন বাকসোটি। দেখতে পেলেন, একগুচ্ছ চুল, একটি সুঁই আর একটি মোমবাতি। সাথে একটি কাগজ। তাতে ছোট ছোট তিনটে কবিতা।

এক.
নিজের দেহ নিজেই একটু একটু করে
পোড়াতে থাকে মোমবাতি
পুড়তে পুড়তে আর ক্ষয়ে যেতে যেতে সে
আলোয় রাঙিয়ে তোলে অন্ধকার
অথচ আত্মদানের বিনিময়ে কিছুই সে চায় না
যেন এভাবে ক্ষয়ে যেতেই তার আনন্দ
মানুষের উচিত মোমবাতি হওয়া।

দুই.
মানুষের ঘরে ঘরে সুঁই থাকে
সব মানুষেরই কাজে লাগে এই সুঁই
মানুষ কি সুঁইয়ের চেয়েও ক্ষুদ্র?
মানুষের উচিত, মানুষের কাজে লাগা।

তিন.
মানুষ যখন মোমবাতি হয়ে যায়
মানুষ যখন সুঁই হয়ে যায়
মানুষ তখন চুলের মতো ক্ষীণ থেকে
ক্ষীণতর হতে থাকে, আর
যত সে ক্ষীণ হতে থাকে, তত সে
বুঝতে পারে, জগতের ভেদকথা।

আমি চোর

মধ্যরাত। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।
নামাজে মগ্ন হয়ে আছেন রাবেয়া বসরি। দরজা ভেজানো। পা টিপে টিপে এক চোর ঢুকল। দড়ির ওপর ঝোলানো রাবেয়ার গায়ে দেয়ার চাদরটা নিয়ে সে বেরোতে গেল, কিন্তু দরজা কোথায়?
সারা ঘর ঘুরেও চোর দরজা খুঁজে পেল না। ঘাবড়ে গেল সে। কাঁপতে কাঁপতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাবেয়ার পায়ের ওপর। মগ্নতা ভেঙে গেল তার। চোরকে দেখতে পেলেন তিনি। জিগেশ করলেন, তুমি কে?
চোর বলল, আমি চোর। আমায় ক্ষমা করুন। লোকমুখে শুনেছিলাম, আপনি দরবেশ। কিন্তু আমি তোয়াক্কা করিনি।
রাবেয়া জিগেশ করলেন, তবে এখন তোয়াক্কা করছ কেন?
চোর বলল ঘটনাটি।
বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে গেলেন রাবেয়া বসরি। চোর যা বলছে, তা কীভাবে সম্ভব? ওই তো খোলা রয়েছে দরজা। চোরকে তিনি জিগেশ করলেন, তুমি কি এখন দরজা দেখতে পাচ্ছ?
চোর এবার দরজার দিকে চেয়ে দরজা দেখতে পেল। আর কী, চট করে সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।
আর রাবেয়া বসরি দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরলেন, তোমার হাতেই আমি তুলে দিয়েছিলাম আমার জানমালের নিরাপত্তা। তুমি তা নিশ্চিত করেছ, আজ প্রমাণ পেলাম।

দশগুণ ফেরত পাব

দুই অতিথি এলো রাবেয়া বসরির বাড়িতে। ওই বেলার আহার হিশেবে রাবেয়ার কাছে দুটো রুটিই ছিল। তিনি তা-ই এনে দিলেন অতিথির সামনে। এসময় এক ভিখিরি এসে দাঁড়ালো দরজায়। কাতর স্বরে বলল, মা, মাগো, কিছু খেতে দাও।
রাবেয়া অতিথিদের সামনে থেকে রুটি দুটো নিয়ে ভিখিরিকে দিয়ে দিলেন।
তাজ্জব বনে গেলেন অতিথি দুজন। এবং অপমানিত হলেন। তারা বললেন, আপনার মতো মহিয়ষী নারীর কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার আমরা আশা করিনি।
রাবেয়া বসরি কিছু বললেন না। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরই এক বাঁদি এলো কতগুলো রুটি ও রান্নাকরা মাংস নিয়ে। সে বলল, আপনার খেদমতে আমার মনিব এগুলো পাঠিয়েছেন।
রাবেয়া রুটিগুলো নিয়ে গুনে দেখলেন, বিশটি। বাঁদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বিদায় দিলেন। এরপর অতিথিদের ডাকলেন, আসুন। এবার আপনারা খেতে বসুন। অতিথি দুজন অবাক চোখে চেয়ে রইলেন রাবেয়ার মুখের দিকে। রাবেয়া ডাকলেন, কই, আসুন। আপনাদের তো খুবই খিদে পেয়েছে।
এক অতিথি জিগেশ করলেন, তার আগে বলুন, এসবের মানে কি?
রাবেয়া বললেন, তেমন কিছু না। আপনারা দুজন খুবই ক্ষুধার্ত, আমি জানি। ঘরে দুটো রুটিই ছিল। তা-ই দিলাম আপনাদের সামনে। ভিখিরির কাতরতা শুনে মনে হলো, রুটি দুটো তার জন্য ঠিক আছে। আপনাদের খিদে দুটো রুটিতে মিটবে না। তখন আমার মনে পড়ল, একটি দানের বিনিময়ে আল্লাহ দশগুণ ফেরত দেন। তাহলে আর আমার চিন্তা কী! আমি তো দশগুণ ফেরত পাব। তাই রুটি দুটো ভিখিরিকে দিয়ে দিলাম।