ইবনে বতুতা

ইবনে বতুতা

রাদ আহমদের গদ্য ‘চিন্তা নিয়ে প্যাঁচানো: রোল roll’

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২২

ইংরেজি রোল roll শব্দের একটা ছোটো, ব্যবহার যোগ্য কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আছে কিনা, ভাবা যায়। গুটানো, গড়ানো, পাকানো, পেঁচানো, চোঙা করা, মুড়ানো ইত্যাদি। এসবের মধ্যে মুড়ানোটা হতে পারে সবচেয়ে কাছাকাছি। কিন্তু, এখন, ধরা যাক আমি এলিফ্যান্ট রোডে গিয়ে একটা কার্পেট কিনছি। কেনা শেষে আমি দোকানদারকে বলব বরং কার্পেটটা রোল করে দেন। সহজে বলব না, কার্পেটটা মুড়িয়ে দেন, অথবা গোল করে প্যাঁচায়ে দেন।

রোল শব্দটা নির্মাণ কিংবা ঘর সাজানোর উপকরণের সাথে যুক্ত। এই শব্দের বেশি ব্যবহার পাওয়া যেতে পারে সমৃদ্ধ বাণিজ্যনির্ভর এলাকায়, হাটে, বন্দরে, বাজারে বেশি। বাংলা এলাকার কথা ভাবি। ১৩৪৬ সালে যখন ইবনে বতুতা এক ধরনের সাময়িক সফরে এইদিকে আসে (চিটাঁগাঙ > কামরূপ > তারপর ফেরত যাবার সময় সিলেট অঞ্চল > ঢাকার অদূরে সোনারগাঁ)— তখন উনার বর্ণনা অনুযায়ী, এই এলাকাগুলি বন্দর বাণিজ্য/নদী বাণিজ্যে জমজমাট ছিল।

আরবীয় বণিকেরা এই এলাকায় শস্য/খাবার/ ফলজ উৎপাদনের প্রচুরতা, কিন্তু গরম আর্দ্রকালে অত্যধিক আর্দ্রতা বা হিউমিডিটি উদ্ভূত ঘাম আর অস্বস্তির কারণে এই এলাকাকে ডাকতো অনেকটা ‘নিয়ামত পূর্ণ দোজখ’ বলে— এইটা উনি বলছেন। বতুতা ফেরত যাবার সময় সোনারগাঁ থেকে একটা চীনা জাহাজে সওয়ার হন, যেই জাহাজের পরের লক্ষ্য ছিল জাভা। বাঙালি বণিকেরাও নদী-সমুদ্রপথে অনেক দূরের দেশে মাল-সামানা নিয়ে যাইতেন। অর্থাৎ, মোটামুটি ইন্টারন্যাশনাল একটা বাণিজ্য আবহ স্থলভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। নদীবন্দর কেন্দ্রিক।

তো এত এত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রোল শব্দের কোনো এক-প্রয়াসে-উচ্চারণ-সম্ভব (এক সিলেবালের), বহুব্যবহৃত কোনো শব্দ বাংলায় আসলো না কেন, এটা ভাবা যায়। যদি এইরকম কোনো শব্দ এসে থাকেও সেই সময়, অথবা আরও আগে, শব্দটা বহুব্যবহৃত হয়ে থাকলে ইংরেজি বা ভিনদেশি ‘রোল’ শব্দটা সেই শব্দকে প্রতিস্থাপন করতে পারত না বর্তমানে সহজে।

এই থেকে দুই রকম চিন্তায় আসা যায়।

এক.
হতে পারে, বঙ্গীয় এলাকায় ‘রোল’ করার মতো কোনো ম্যাটেরিয়ালের প্রাচুর্য্য অথবা বহু-ব্যবহার ছিল না। রোল করা যায় যেইসব ম্যাটেরিয়াল সেইগুলি আধা শক্ত, আধা নরম ও মসৃণ। যেমন, কার্পেট বা মোটা গালিচা, রাবার ম্যাট, মিনারেল উলের ফোম, এমনকি বেতের পাটি। এগুলিকে রোল করা যত সহজ, ভাঁজ করা ততটা নয়। একমাত্র বেতের পাটি বাদে আর কোনোগুলাকে এই দেশের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মেলানো যাচ্ছে না।

কাপড়, কাপড়ের পাটি বা কাঁথা বেশি নরম, সেগুলি ভাঁজ করা সহজ। ভাঁজ করলে পরিবহন আর সংরক্ষণ করাও সহজ। ফলে কাপড় বা কাঁথা (যেগুলি বাংলায় প্রচুর উৎপাদিত হবার কথা)— সেগুলিকে রোল করার দরকার নাই। বেতের পাটির ক্ষেত্রে কী বলা যায়? কোথাও কি একবার শুনছিলাম যে, বেত বেসিকালি সম্পূর্ণ এই দেশীয় নয়। নাকি এই তথ্য ভুল?

বাঁশের চাটাই অনেক ব্যবহার হয়। সেই চাটাই আর যা-ই করা যাক, অতি কসরত করে রোল করে স্টোর করা সম্ভব না। বেশি শক্ত। বরং গ্রামে গঞ্জে ভাঁজ করেই সংরক্ষিত আর পরিবহনকৃত হতে দেখা যাবে হয়তো বেশি। বেচার সময় বড় বড় হালকা রোল করে প্রদর্শন করে অবশ্য।

দুই.
মধ্যযুগে রোল করার মতো ম্যাটেরিয়াল সম্ভবত কার্পেট বা গালিচা, যেগুলি শীতপ্রধান বা শুষ্ক এলাকায় বেশি উৎপাদিত/ব্যবহৃত হতো। ইরান, কাশ্মীর (?) ইত্যাদি। এই থেকে একটা হাইপোথিসিসে আসা যায়, নাতিশীতোষ্ণ বা শীতপ্রধান এলাকায় প্রচলিত ভাষাগুলাতে ‘রোল’ শব্দের সুন্দর প্রতিশব্দ থাকবে। বিষুবীয় অথবা গরম-আর্দ্র এলাকায় প্রচলিত ভাষাগুলায় রোল শব্দের ভালো প্রতিশব্দ থাকার সম্ভাবনা কম। এই ধরনের একটা হাইপোথিসিস নিয়ে আগানো যায়।

তবে শেষমেশ সকরুণ প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলায় রোল শব্দের মতো এক অক্ষরে, সহজে উচ্চারণযোগ্য কোনো শব্দ আসল না কেন? নাকি এরই মধ্যে আছে? এই মুহূর্তে মাথায় আসতেছে না? নতুন নতুন বিদেশি উপকরণের সাথে সাথে ‘রোল’ শব্দ আরও বেশি করে আসবে। ‘রিজলা পেপারে সিগারেট রোল করো’।

মুড়াইয়া মুড়াইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া বাইন্ধা দাও।