রাদ আহমদের গদ্য ‘কবিতা বোঝাবুঝির কিছু নাই’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২৪

তোমার কবিতা বুঝতে পারতেছি না— এই অভিযোগ অনেক লেখককেই শুনতে হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত সুন্দরভাবে এই কথার উত্তর দিতে হয়েছিল কারো কারো উদ্দেশ্যে। সঠিক বাক্যগুলা অনেকেরই জানা আছে। আমি স্মৃতি থেকে বলি, উনি অনেকটা এরকম বলতেছিলেন যে, একটা সুন্দর ঘ্রাণযুক্ত ফুলের গন্ধ নিয়ে কেউ যদি বলে, `বুঝি নাই`— তাইলে তাকে আর কী উত্তর দেয়া যেতে পারে! সুঘ্রাণ এপ্রেশিয়েট করতে হবে। এখানে বোঝাবুঝির কিছু নাই।

আজকে পুনরায় এই রকমের অভিযোগ। আর মজার বিষয়গুলা হলো, অভিযোগগুলা মাঝে মধ্যেই ভায়োলেন্ট ধরনের হয়। আর সেটা প্রমাণ করে যে, সেই পাঠক এরই মধ্যে কম এফোর্ট দেন নাই সেই কবিতাগুলি বোঝার জন্যে। অনেক কষ্ট আর শ্রম দেবার পরেও যখন কবিতাটি সে বুঝতে পারে না, তখন তার মন্তব্যে ভায়োলেন্সের প্রকাশ ঘটতেই পারে। আমি দোষ দেই না। বরং এই ভায়োলেন্স প্রমাণ করে যে, সেই ব্যক্তি এনালাইটিকাল মনের অধিকারী। সে বুদ্ধিমান। অলস নয়।

আজকে এরকম অভিযোগের প্রেক্ষিতে কিছু লিখতে লিখতে দুটা জিনিস মনে পড়ল। বিষয়গুলা একেবারে প্রাথমিক। তারপরেও `চিন্তা কপচানোর স্বার্থে` সেগুলি নিয়ে সামান্য বিস্তারিত করা যায়।

কবিতা বুঝি না— এমন কথার প্রেক্ষিতে প্রথমেই উত্তর চলে আসে যে, আচ্ছা ঠিক আছে, তাইলে সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই শিশুতোষ কবিতা বা ছড়া বুঝবে? এর একটু পরেই মনে হলো যে, না, শিশুতোষ ছড়াগুলিও কিন্তু আমরা (বা সেই ব্যক্তি) অন্য একজনের (শিক্ষকের) হেল্প ছাড়া ছোটোকালে বুঝে উঠতে পারি নাই। এক ধরনের একটা ‘পূর্বজ্ঞান’ আমাদের মনে সঞ্চালন করেছেন শিক্ষক সেই কালে, আর সেই পূর্বজ্ঞানের আলোকে ছড়াগুলি আমাদের বুঝতে হয়েছে। অর্থাৎ, পূর্বজ্ঞান ছাড়া শিশুতোষ ছড়া বা কবিতাও বোঝা সম্ভব নয়।

কিভাবে?
মৌমাছি, মৌমাছি,
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।
          ওই ফুল ফোটে বনে,
          যাই মধু আহরণে
          দাঁড়াবার সময় তো নাই।

নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের এই বিখ্যাত ছড়ায় যে মৌমাছি, পিপীলিকা আর ছোটো পাখি এসেছিল— তাদের মাধ্যমে কী বোঝানো হচ্ছিল? এই লেখাটা চার মাত্রার মাত্রাবৃত্তের ছন্দের দোলায় খুব মধুর একটা দোলা তৈরি করছে বটে, শিশুমনে নাড়া দিচ্ছে, তারপরেও, প্রকৃতির তিনটি প্রাণীর কর্মব্যস্ততার বিষয়টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো এখানে— আপ্রেশিয়েট করানো হলো।

এ দুনিয়ায় কর্মব্যস্ততা এপ্রেশিয়েট করা যায় বা করা উচিত, অন্য প্রাণীরা করে, তাই আমাদেরও কর্মব্যস্ত থাকা উচিত, প্রকৃতিতেও দেখো, অলসতার স্থান নেই— ইত্যাদি ইত্যাদি প্রচলিত জ্ঞান বা পূর্বজ্ঞানের আলোকে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাদের এই কবিতাটা বুঝিয়ে দিছিলেন ঐ সময়।

এগুলি না বোঝালে তো পুরাপুরি অবান্তর একটা জিনিস মনে হবে কবিতাটা। একটা ক্লাস টু বা থ্রির বাচ্চা হঠাৎ করে পিপীলিকা, মৌমাছি, ছোটো পাখি— ইত্যাদির সাথে কথোপকথন দিয়ে কী করবে? ঠিক আছে, মৌমাছি যাচ্ছে, পিপীলিকা যাচ্ছে, তো আমার কী?

কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি’— এখানেও `সবার আগে জেগে ওঠা`র মাহাত্ম্য বা প্রবণতা বা অস্থিরতা (সদর্থে)— এসব পূর্বজ্ঞান আরোপ করে। যতদূর মনে পড়ে, শিক্ষকেরা শিশুদের কবিতাটি বোঝাতেন। সবাই ঘুমিয়ে থাকলেও আমি জাগবই। এই এক ধরনের সৎ প্রবণতা শিশুদের সেখানো হয়। পূর্বজ্ঞান লব্ধ এই ধারণাকে আরোপ করে কবিতাটাকে এপ্রেশিয়েট করানো হয়।

অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কবিতাদুটি বোঝার জন্য ‘পূর্বজ্ঞান বা ‘প্রতিষ্ঠিতি ধারণা’র দরকার পড়েছে— যেগুলি শিক্ষকেরা শিশুদের মধ্যে সঞ্চালন করেছেন। আর তারপর শিশুরা সেই কবিতা বুঝতে পেরেছে। এই পূর্বজ্ঞান দর্শন, সামাজিক প্রজ্ঞা, মানবিক অভিজ্ঞতা নানা দিক থেকে উৎপন্ন হতে পারে। ফলে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে, কবিতা বোঝার জন্য কিছু ‘পূর্বজ্ঞান’ দরকার পড়বেই।

এই বিষয়টাকেই দশকে দশকে কবিরা আরও টেনে নিয়ে নিয়ে বড় করে গেছেন। এই `পূর্বজ্ঞান` ব্যাপারটা যেটা আশা করা হতেছে পাঠকের মধ্যে থাকবে। কতভাবে পাঠক নিজের পূর্বজ্ঞান কবিতাটার মধ্যে আরোপ করবেন, এই নিয়ে যেন নানা এক্সপেরিমেন্ট করে গেছেন কবিরা। কবিতার অন্যান্য এলিমেন্ট তো থাকেই। যেমন: সুর, লয়, তাল, অভিঘাত, দৃশ্যকল্প, বিষয়বস্তু প্রকাশে স্বকীয়তা নতুনত্ব ইত্যাদি । সেইসব দিকে যাচ্ছি না। আপাতত শুধু পূর্বজ্ঞান নিয়ে আলাপ।

পাঠক একটা কবিতা পড়ার আগে নিজের কল্পনা শক্তির সব আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলবেন। কবিতার ক্ষেত্রে সবই সম্ভব। মানুষ যেভাবে `সকাল বেলার পাখি` হতে চাইতে পারে, অথবা, মৌমাছিদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার সাথে কথা বলতে পারে। ফলে প্রথমেই কল্পনার আড়ষ্টতা বা বাস্তবের জ্ঞান শিথিল করতে হবে।

দ্বিতীয়, নিজের নানারকম পূর্বজ্ঞান বারবার আরোপ করে দেখতে হবে কবিতাটার ওপর। যুদ্ধকে ভালোবাসা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাওয়া একটা ভালো জিনিস। একটা বর্তমানে (পঞ্চাশের দশকে) বিশ্বময় উন্নত একটি আন্দোলন— এই পূর্বজ্ঞান যার থাকবে তার পক্ষে শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটা এপ্রেশিয়েট করা সম্ভব। সেই পূর্বজ্ঞান না থাকলে এই কবিতার কোনো যথাযথ মিনিং কেউ খুঁজে পাবেন না। সৌন্দর্যটা ধরতে পারবেন না।

ওপরের এটা খুব সরল উদাহরণ দিলাম। সেই সময় থেকেই বা তার আগে পরে থেকে, এই পূর্বজ্ঞানের বিষয়টা অনেক টেনে হিঁচড়ে অনেক দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কবিতা এপ্রেসিয়েশনের ক্ষেত্রে। এই কারণেই বলি, যে ব্যক্তিপাঠক কবিতার বিকাশের সাথে সাথে কবিতার প্রতি ভালোবাসা রেখে এই ধরনের পরিবর্তনগুলি অবজার্ভ করেছেন, তার পক্ষেই বর্তমান কালের মূলধারার কবিতা বোঝা কিছুটা সম্ভব।

প্রতিষ্ঠিত/প্রচলিত জ্ঞানগুলি মিলিয়ে দেখতে আগ্রহী না, কোন কবি কিভাবে এই জিনিসগুলি কবিতায় নিয়ে এসেছেন আগে, কিংবা এখন আনছেন— সেগুলি দেখে আনন্দ পান না, এই বিষয়গুলিতে যাদের আগ্রহ নেই তাদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই এখনকার অনেক কবিতা বোঝা সম্ভব হবে না। এখানে পাঠককে দোষ দেওয়াও যায় না। প্রত্যেক মানুষের `কবিতা` নিয়ে আগ্রহ থাকবে, সেটাও নয়।

লেখক: কবি