রাজীব জবরজংয়ের স্মৃতিগদ্য ‘জয়নাল’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২১, ২০২৪
সম্ভবত ৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের কিছুদিন পর আমরা বুশের বাড়ির স্মৃতি সমেত ফেনী শহরে চলে এলাম। ফেনী শহরে আসার অল্প ক’দিনের মধ্যেই আমাদের একাধিকবার বাসা বদল করতে হলো আমার ভাইবোন ও আমার স্কুলের দূরত্ব বিবেচনায়। আমার ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ৬ বছরের। তার প্রতি আমার ভাতৃত্ববোধের চেয়ে হিংসাই বেশি কাজ করতো। কারণ পড়ার টেবিলে তার একটি ব্যক্তিগত ড্রয়ার ছিল। ড্রয়ারটিতে সার্বক্ষণিক তালা ঝুলতো।
দুনিয়ার একমাত্র বিষয় ছিল ওই ড্রয়ার, যার ভেতর আমার জগতের সকল কৌতূহল। তার ড্রয়ারে নানা রকমের জিনিসপত্র। লোহা কাটার করাত, স্ক্রু ড্রাইভার, নানা রকমের কালি না থাকা কলম, র্যাপিং পেপার আরও কত কী। আমি কৌতূহলের চূড়ান্তে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললাম, কী করে ড্রয়ারের তালা না খুলে ড্রয়ারে জিনিসপত্র দেখা যায়। টেবিলের নিচ দিয়ে একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গা দিয়ে অনায়াসেই আমার হাত ড্রয়ারের ভেতর পৌঁছে যেত।
আমি সুযোগ পেলেই ড্রয়ারের জিনিসপত্র বের করে দেখতাম। একদিন আবিষ্কার করলাম ড্রয়ারের ভেতর খুব সুন্দর একটা লাটিম। লাটিমটা দেখার পর আমার আর সেটা ড্রয়ারে রাখতে ইচ্ছা করলো না। গোপনে সরিয়ে ফেললাম। আমি এর আগে কোনো দিন জানতামই না কীভাবে লাটিম ঘুরাতে হয়। টানা কয়েক দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আমি লাটিম ঘুরানো শিখে গেলাম।
বাসার সামনে কতগুলো ছেলে লাটিম খেলে সারাক্ষণ। তাদের দেখলে আমার নিজেকে জেলখানার কয়েদি মনে হতো। তাদের সাথে আমার মেশা বারণ। তাও একদিন সুযোগ বুঝে চলে গেলাম আমার ভাইজানের লাটিম হাতে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাকেও ওরা খেলায় নিল। আমি তো মহাখুশি লাটিম খেলার সুযোগ পেয়ে। কিন্তু হায়, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার লাটিম ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তাদের লাটিমের ছুঁচোলো ফলায়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি, কী জবাব দেব আমি ভাইজানকে ?
ভেবেই ভয়ে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যাই হোক, বাসায় গেলাম চূড়ান্ত ভয় নিয়ে। বাসায় গিয়ে মনে হলো, লাটিমের যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুই ড্রয়ারে রেখে দেয়াই বিবেকবানের কাজ। ক্ষতবিক্ষত লাটিমটাই গোপনে ড্রয়ারে রাখলাম। সন্ধ্যা নাগাদ যথারীতি ধরা খেলাম ভাইজানের কাছে।
মারতে গিয়েও কী মনে করে মারলো না। কিন্তু আমার ভেতর কেমন জানি একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম এদের সাথে আর মেশা যাবে না। মিশলেই বিপদে পড়বো।
এর মাঝে দু’দিন পার হলো। বাসা থেকে বের হলাম। দেখি লাটিম খেলা ছেলেদের একজন আমাকে ডাকছে। এই ছেলেটাই মূলত আমার লাটিমটাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। নাম জয়নাল। এলাকায় তার বেশ নামডাক বখাটে হিসেবে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে সিক্সে বা সেভেনের পর।
জয়নাল আমাকে বললো, চল স্টেডিয়ামে যাই।
আমি যেতে রাজি হলাম না। তবুও তার জোরাজুরিতে গেলাম। স্টেডিয়ামের ভেতর ঢুকে একটা মাঠে গেলাম। ওখানে বড়রা ফুটবল প্র্যাকটিস করছে। আমরা তাদের প্র্যাকটিস দেখছি। সন্ধ্যা হবার আগেই বাসায় ফেরার জন্য স্টেডিয়াম থেকে রওয়ানা হবো যখন, ঠিক তখন জয়নাল তার পকেট থেকে একটা খুব সুন্দর লাটিম বের করে আমাকে দিল। তখনকার সময়ের দামি লাটিম। দাম তিন টাকা। কী সুন্দর বেগুনি রঙের লাটিম। আমার তখন জয়নালকে খুব আপন মনে হতে শুরু করলো। জয়নাল আমার বন্ধু হয়ে গেল খুব অল্প সময়ে।
জয়নাল বয়সে আমার চেয়ে বড়, জয়নাল তার বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বড়। জয়নাল ততদিনে জেনে গেছে, কী করে ঘোড়ার পেটে খচ্চর হয়, কি করে মানুষ থেকে মানুষ হয়। জয়নাল জেনে গেছে, ফুলদের ফল ফলাতে গিয়ে তার প্রিয়তম ফুলকে সঁপে দিতে হয় প্রজাপতির কাছে। জয়নাল হয়ে উঠলো আমার একমাত্র প্রাপ্তমনষ্ক বন্ধু। রেললাইন ধরে হেঁটে নিজেকে নিজের চেয়ে বড় করে তোলা, খেলতে গিয়ে খেলার বদলে জগৎ চিনে ফেলার রাস্তা খোঁজা, এমন কত কি যে জয়নালের কাছ থেকে আমি জেনেছিলাম।
এর মাঝেই একদিন জয়নাল প্রস্তাব রাখলো, চল বিলাসী সিনেমা হলে যাই। সিনেমা দেখি। আমি তো ভয় পেলাম শুনেই। আর যাই হোক না কেন, হলে গিয়ে সিনেমা দেখা যাবে না। বাসায় জানতে পারলে পিঠের ছাল আর পিঠে থাকবে না। এরপরও কি মনে করে যেন রাজি হয়ে গেলাম। আমার কাছে টাকা নাই। জয়নালের কাছে আছে। গেলাম বিলাসী সিনেমাহলে। জয়নাল টিকিট কিনলো একটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এক টিকিটে দুজন সিনেমা দেখতে পারে? জয়নাল বললো, না পারে না, খালি জয়নাল পারে।
জয়নাল সিনেমা দেখতে এসে নায়ক হয়ে গেছে। তার কথার ঢঙ, চলাফেরায় এক অদ্ভুত পরিবর্তন হঠাৎ করেই। শো শুরু হতে তখনো মিনিট বিশেক বাকি। জয়নাল আমাকে নিয়ে হলের বাইরে গেল। ৫০ পয়সা অথবা তার কম দামের একটা সিগারেট কিনলো, নাম ফাইভ স্টার, সাথে পঁচিশ পয়সা দামের দুটো চকলেট।
হলের ভেতর দিয়ে একটা জায়গায় গেলাম আমরা। জয়নাল সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমাকে বললো, খাবি?
আমি বললাম, না।
জয়নাল আমাকে একটা চকলেট দিয়ে বললো, আমার জন্য অর্ধেক রাখিস। আমি চকলেটের প্যাকেটের ওপর দিয়ে কামড় বসিয়ে অর্ধেকটা চকটেল জয়নালকে ফেরত দিলাম। জয়নাল সিগারেটের অর্ধেকটা খেয়ে নিভিয়ে পকেটে নিয়ে নিল। আমরা হলের ভেতর ঢুকলাম। আমি ঢুকলাম টিকিটসহ, জয়নাল কীভাবে যেন চেকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে গেছে। ঢুকেই আমার হাতে টিকিটের ছেঁড়া অংশটা নিয়ে দুই ভাগ করে একভাগ তার নিজের কাছে রাখলো।
শো শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। হঠাৎ বেজে উঠলো জাতীয় সঙ্গীত। সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ও জয়নালও। জয়নাল চোখ বন্ধ রেখে খুব শব্দ করে জাতীয় সঙ্গীত গাইলো। আর আমি কেবলই অবাক হচ্ছি। সিনেমা শুরু হয়ে গেল। সিনেমার নাম দুশমনি। মাহমুদ কলি নায়ক, নায়িকা অলিভিয়া।
সিনেমা চলছে মহাসমারোহে। সিনেমার প্রথম গান যখন শুরু হলো, জয়নাল তার পাশের বয়স্ক লোকটার কাছে আগুন নিয়ে পকেটে থাকা আধখাওয়া সিগারেটটা জ্বালিয়ে জগতের সকল নায়কের মুখের দিকে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে নিজেই হয়ে উঠলো নায়ক। সিনেমার শেষদৃশ্যে মাহমুদ কলি গুণ্ডাদের সাথে ফাইট করে তার নায়কজন্ম স্বার্থক করতে গিয়ে অসংখ্য মাটির কলশি লাঠির আঘাতে ভেঙেছিল। আর আমার শৈশবের একমাত্র প্রাপ্তমনষ্ক বন্ধু জয়নাল তাবৎ দুনিয়াটাকে ভেঙে একেকটা টুকরো আমার হাতে এনে দিয়েছিল।
কিছুদিন পর আবার আমাদের বাসা বদলের সময় হয়ে এলো। আমরা জয়নাল থেকে আরেকটু দূরে চলে এলাম। বাসা বদলের পর জয়নালের সাথে আমার আর খুব একটা দেখা হতো না। একদিন জানলাম জয়নাল একটা মেটাল ওয়ার্কশপে কাজ নিয়েছে।
মাঝে মাঝে কালিঝুলি মাখা ময়লা জামা গায়ে জয়নালকে দেখা যেত খুব ক্লান্ত শরীরে হেঁটে যাচ্ছে জীবনকে দুই ঠোঁটের মাঝে ফেলে জগতের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে দিতে দিতে।
তাকে দেখলেই আমার কেবল মনে হতো, জয়নাল বোধহয় এতদিনে জেনে গেছে, বুকের ভেতর কোথাও কোনও অন্তর নেই। কারো কারো অন্তর থাকে চোখে, কারো অন্তর হাতে। কিভাবে কিভাবে যেন জয়নালের অন্তরটা চোখ থেকে বুক হয়ে পেটে নেমে গেছে কেউ টের পায়নি। কেবল জয়নালই টের পেয়েছিল!