রাজীব আশরাফের গল্প ‘ঝোপের আড়ালে’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২২, ২০২০

ভোরবেলা। ফজরের আজান হচ্ছে।
পাখির ডাক ছাপিয়ে মাইকে আজানের সুর বেশ খানিকটা দূরেই চলে যাচ্ছিল গ্রামের ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে। মাঠের পাশেই ঝোপঝাড় ঘেরা ফাঁকা মতো একটা যায়গা। পরিত্যক্ত। দেখলেই বোঝা যায়, সেখানে মানুষের যাতায়াত কম। কিন্তু ঝোপের উল্টো দিকের দু’চারটে ঘরের বাসিন্দারা প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে এই প্রাকৃতিক ঝোপকেই ব্যবহার করে।

হঠাৎ ঝোপ থেকে পাশের গ্রামের যুবক রেদোয়ানকে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে পিছের রাস্তা ধরে দূরে চলে যেতে দেখা যায়। তার একটু পরেই রোকসানাকে বের হয়ে আসতে দেখা যায় আলুথালু হয়ে থাকা জামাকাপড় ঠিক করতে করতে। ঠোঁটে একটু রক্ত লেগেছিল, সেটাও ধুলো মাখা ওড়না দিয়ে মুছে ফেলে। ঝোপের পাশেই মুত্রত্যাগরত মহসিন প্রথমে রেদোয়ান তারপর রোকসানাকে বের হতে দেখে বেশ অবাক হলো। প্রকৃতির ডাক একপ্রকার গলা চেপে অর্ধসমাপ্ত রেখে উঠে দৌড়ে গিয়ে রোকসানাকে আটকায়।

মহসিনের এই হঠাৎ আগমনে অন্যমনস্ক থাকা রোকসানা চমকে যায়। মহসিন রোকসানাকে জিজ্ঞেস করে, কিরে রোকসানা তোর এই অবস্থা ক্যান? আর রেদোয়ানরে দৌড়াইয়া যাইতে দেখলাম। কি হৈছে?
রোকসানা কিছু বলে না। ঠায় দাড়িয়ে থাকে মূর্তির মতো।
মহসিন আবার জিজ্ঞেস করে, আমি রেদোয়ানরে ভালো মতোই চিনি। ওর মতো লুইচ্চা দুইটা নাই আশপাশের দশ গ্রামে। সত্যি কইরা ক রেদোয়ান তোরে কিছু করছে?

রোকসানা মনে হয় আগের চেয়েও বেশি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। তাই পাখির ডাক আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাখির ডাক উপচে মহসিনের গলা শোনা যায়, এই রোকসানা আমার দিকে তাকা। আমি তোর বড় ভাইয়ের বন্ধু না? বড় ভাইয়ের বন্ধু আর বড় ভাইয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ নাই। আজকে তোর ভাই বাঁইচা থাকলে তারে তুই কইতি না?

এবার নৈঃশব্দ্য ভাঙে রোকসানার চোখের কোণ বেয়ে নেমে পড়া এক ফোঁটা চোখের জল। আর কান্না দেখেই নিশ্চিত হয় মহসিন যে কিছু একটা ঘটেছে। সে রোকসানার আরো কাছে গিয়ে বলে, তোর ইচ্ছা হইতাছে না রেদোয়ানরে মাইরা কাইট্টা নদীতে ভাসায় দিতে? তোর বড় ভাই বাঁইচা থাকলে এইডাই করতো। আমারে ক। আমি কসম কাটলাম আমি কাওরে কমু না শুধু রেদোয়ান শুয়োরের বাচ্চারে মাইরা পাগল বানায় দিমু। তুই আমারে ঠিক কইরা ক কি ঘটছে।

রোকসানার কান্না এবার ধ্বনি খুঁজে পায়। আবারো নৈঃশব্দ্যতার জামা ছিঁড়ে রোকসানার ডুকরে কেঁদে ওঠার ধ্বনি পাখি হয়ে আকাশের দিকে যেতে থাকে। আর মহসিন সেই পাখিদের খাঁচার দরজা আটকে দেয় যেন আপাতত কোনো পাখি বের হতে না পারে। তারপর মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, রেদোয়ান কি তোরে রেপ করছে?

রোকসানা মনে হয়, ক্ষণিকের জন্য মহসিনের চেহারায় নিজের মৃত বড় ভাইয়ের মুখ দেখতে পায়। এবং হয়তো তার বড় ভাইয়ের বিভ্রমে ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে সে আলতো ভাবে মাথা ঝাকায়। মুখটা নড়ে উঠাতে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রোকসানার চোখের জল হীরার মতো চিকচিক করে ওঠে।

মহসিন রোকসানার মাথা নাড়া দেখে বুঝে যায় সে যা ভেবেছে আসলে তাই ঠিক। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিঞ্চিত হাসি মুখে সে এদিক ওদিক তাকায়। কেউ নেই দেখে রোকসানার খুব কাছে গিয়ে প্রায় কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, ঠিক আছে আমি কাউরে কমু না। কিন্তু আমারে একবার দিতে হইবো। যা হবার তাতো হইয়াই গেছে। একবার হওয়া যা দশবার হওয়াও তা। কিন্তু আমারে যদি না দেস কালকেই সারা গ্রামে রাষ্ট্র কইরা দিমু তুই মাইয়া ভালো না। রেদোয়ান তোর লগে কি করছে সেইডাও কইয়া দিমু।

রোকসানাকে এই বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে বিস্মিত হবার সুযোগ পর্যন্ত দেয় না মহসিন। রোকসানার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় ঝোপের দিকেই।