এরউইন পিসকাটর

এরউইন পিসকাটর

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পথিকৃত পিসকাটর

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২০

নাটকের ইতিহাসে ‘পলিটিক্যাল থিয়েটার’ বা ‘রাজনৈতিক নাট্য’ শব্দটি জার্মান পরিচালক এরউইন পিসকাটর উদ্ভাবন করেছিলেন বিশ শতকের বিশের দশকে। তিনি মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী ছিলেন। নাটকে তিনিই সচেতনভাবে রাজনীতি টেনে আনেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা আমাদের কর্মসূচী থেকে শিল্প কথাটি নিষিদ্ধ করলাম; আমাদের নাটকগুলি হোলো ফতোয়া; যার মাধ্যমে আমরা সমসাময়িক ঘটনায় ‘রাজনৈতিক’ দিক থেকে অংশগ্রহণ করতে চাই। আমাদের সমস্ত শিল্প-সৃষ্টি বিপ্লবী লক্ষ্যের অধীন; শ্রেণীসংগ্রামের প্রচারই আমাদের শিল্প সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।’ তিনি শুরু থেকেই নাট্যপ্রযোজনাকে রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার রূপে চিন্তা করেছিলেন ও সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাঁর সমস্ত নাট্যকর্ম পরিচালিত করেছিলেন। নাটকের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। সবকিছুর ঊর্দ্ধে দেখতে গেলে নাটক হচ্ছে তাঁর কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। তিনি মনে করতেন, নাট্যশালা হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার যা প্রকৃত এবং সত্য ঘটনা প্রবাহ নিয়েই কাজ করবে। নাট্য কর্মসূচীর কর্তব্য হলো জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বোধিত করা। তিনি বললেন এমন নাটকের কথা যা দর্শককে রাজনীতিতে শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করে তুলবে। এ কারণেই তাঁকে রাজনৈতিক নাটকের পথিকৃতরূপে নাট্যবিদগণ চিহ্নিত ও সম্মানিত করেছেন। পিসকাটরের পূর্বে সচেতনভাবে রাজনীতিকে নাটকে ব্যবহার করার উদাহরণ দেখা যায় না। বিশেষ করে নাটকে মার্কসবাদের প্রয়োগ তিনিই শুরু করেন। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর জার্মানীর নাট্যজগতে তাঁর চিন্তাভাবনার আবির্ভাব। কিন্তু যুদ্ধের পূর্বেই নাট্যশিল্পে তাঁর অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে যুদ্ধপূর্ব মিউনিখের রাজকীয় নাট্যশালার অভিনেতারূপে, পরে সৈন্য বিভাগে থাকাকালীন সৈনিক নাট্যদলে অভিনয় করে।

পিসকাটর-এর জন্ম আঠারশো তিরানব্বই সালে এক যাজক পরিবারে। তাঁর পরিবারের সবচেয়ে বড় কথা ছিল খ্রীষ্টধর্ম অবলম্বন করে থাকা এবং খ্রীষ্টধর্মের মূলনীতি মেনে চলা। বাবা ছিলেন দেশপ্রেমিক জাত জার্মান। পিসকাটরকেও দেশাত্ববোধের প্রেরণায় বড় করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে বিশ বছর বয়সেই তিনি হলেন কাইজার বিরোধী এবং পরে মার্কসবাদী। উনিশশো তেরো সালে তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ই তিনি দর্শন, শিল্প এবং নাট্যচর্চার ইতিহাস পাঠ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই পেশাদার নাট্যশালায় ঢুকবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নিজের পরিবারের ভিতর থেকেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পিসকাটর নিজেই লিখছেন, প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতা সহ সে সময়ে দাদার মুখে শুনতে হয়েছিল, ‘নাট্যকে পেশা করার চিন্তা মাথায় এনো না, বিষয়টা শুধু কঠিনই নয়, ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে এর মাধ্যমে কিছু হওয়া সম্ভব নয়। বিশাল প্রতিভার অধিকারীদেরও এই পেশায় চূড়ান্তভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে। নাট্যশালা হলো ইর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ও দুর্নীতির আখড়া।’

যখন শিল্পভাবনায় অন্ধকারে পথ হাতড়ে ফিরছিলেন তিনি, ঠিক সেই সময় রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল তাঁকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লব ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল পিসকাটরের ওপর। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনের প্রতি যখন বীতশ্রদ্ধ আমরা, বিশ্বের মুক্তির বার্তা পেলাম; দেখলাম এবং বুঝলাম কীভাবে কোন পথে আসবে সমগ্র মানুষের মুক্তি। নিশ্চিত হলাম সর্বহারার সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের ভিতর দিয়েই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটবে। এই বোধ যখন গভীর থেকে গভীরতর হলো, আমরা তখন আমাদের শিল্পের ধ্বজায় খোদাই করে নিলাম একটি কথা “সংগ্রাম”।’ প্রথম মাহাযুদ্ধের ধ্বংস ও হত্যা দেখে পিসকাটরের মানবিক অনুভূতিতে পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তিনি লিখছেন, ‘দীর্ঘদিন শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে আমার যে উপলদ্ধি ছিল, যুদ্ধ সেই উপলদ্ধিকে নয় ছয় করে দিয়েছিল।’ রাশিয়ার জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্তকরণ, কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ঘটনা যে-কোনো এক সময় পিসকাটরকে বিপ্লবী করে তুলেছিল। তিনি নাটক-শিল্পকে বিপ্লবের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবলেন।

নতুন শিল্প সৃষ্টির পথে এগিয়ে গেলেন পিসকাটর। বিপ্লবী চিন্তাই তাঁকে সেই পথ দেখিয়েছিল। তিনি লিখছেন, ‘জীবনকে প্রকাশ করার মধ্যেই খুঁজে পেলাম শিল্পকে। এবার আর জীবন থেকে দূরে সরে গিয়ে শিল্পচর্চা নয়, এবার আমি গ্রহণ করলাম জীবনকে; অভিজ্ঞতার আলো থেকে উৎসারিত বাস্তবকে। বাধ্য হয়েই আমাকে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল।’ পিসকাটরকে এমনি এক প্রতিকুল পরিবেশেই নিজস্ব চিন্তার নতুন নাট্যধারা নির্মাণে হাত দিতে হয়েছে, যা খুব সহজসাধ্য ছিল না। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে পিসকাটর কিছুদিন শিল্পকলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে দ্বিধান্বিত থাকলেও জনগণের প্রতি শিল্পকলার দায়িত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন না। সেজন্যই উনিশশো উনিশ সালের শেষে, শীতকালে তিনি নিজেই ক্যোনিগসবার্গে একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষ্য করবার বিষয় নাট্যশালাটি পরিচিত হয়েছিল ‘ট্রিব্যুনাল’ নামে। ঠিক এর সামান্য আগে উনিশশো উনিশ সালের গোড়ায় শারলোট্রেনবার্গের ক্লিয়েতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য ট্রিবিউন’। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এই নাট্যশালা তার আদর্শগত দিক হারিয়ে বাণিজ্যিক ধারায় পরিণত হয়। পিসকাটর ঠিক করলেন ট্রিব্যুনালে প্রথম মঞ্চস্থ করবেন টলারের রচনা “ট্রান্সফিগুরেশন”।

ট্রান্সফিগুরেশন এক দেশপ্রেমিক তরুণ যোদ্ধার আদর্শবাদী আইনজীবী হয়ে ওঠার কাহিনী; যে কথা বলে মানুষের জন্য, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের জন্য। বার্লিনে এটিই প্রথম পুরোপুরি প্রকাশবাদী নাটক যা কার্ল হাইনৎজ মার্টিন পরিচালনা করেছিলেন। পিসকাটর ঠিক করলেন, বার্লিনের ট্রান্সফিগুরেশন প্রযোজনার সাথে তাঁর নির্দেশনার বিস্তর ফারাক থাকবে। তিনি ঠিক করলেন মঞ্চ নির্মাণ করবেন যতদূর সম্ভব বাস্তবভিত্তিক, যুদ্ধের যে-বাস্তব চেহারা তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি টলারের ভাষাশৈলীকেও ঢেলে সাজিয়েছিলেন। টলারের রচনায় কবিই প্রধান হয়ে ওঠে। তিনি তথ্য বর্ণনা করেন না, যুক্তি প্রদর্শন করেন। বলেন বিবর্তন ও বিমূর্ত নৈতিকতার কথা; আর এসব বলেন কাব্যিক মেজাজে। পিসকাটরের বিচারে ফলে তার রচনা কালের ভেরি হয়ে ওঠে না এবং শুদ্ধ শিল্প হিসেবে এগুলির কোনো চিরন্তন মূল্য তৈরি হয় না। পিসকাটর ট্রান্সফিগুরেশন নাটকটিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চাইলেন। তিনি সাড়ম্বরে ‘ট্রিব্যুনাল’ নাট্যশালার পরবর্তী প্রযোজনাগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করলেন। সে তালিকায় স্ট্রীণ্ডবার্গ, শ, মলিয়ের ও মেটেরলিংকয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নামও ছিল।

জার্মান প্রোলেতারীয় নাট্যশালায় পিসকাটর নাটকের জন্য যে-সূত্র খাড়া করলেন তার মূল কথাই হচ্ছে নাটক হবে জনগণের জন্য, যার বিচার্য হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়। নিজের নাট্যকর্ম সম্পর্কে পিসকাটর লিখেছেন, ‘শিল্প সৃষ্টি করতে আমি আসিনি, ব্যবসা করতেও নয়। নাট্যশালায় যে-নাট্য নির্দেশনার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করবো, সে প্রযোজনা হবে বৈপ্লবিক অথবা কিছুই নয়’। জার্মান সাম্যবাদী দলের মুখপত্র ‘লালনিশান’ কিন্তু সমালোচনা করতে ছাড়লো না পিসকাটরকে। মন্তব্য করা হলো, ‘সর্বহারার নাট্য সম্পর্কে কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু ‘নাটকগুলো শিল্প নয়, প্রচার’ এ কথা বলার যৌক্তিকতা কোথায়। শিল্পই যদি না থাকবে তাহলে নাট্যশালা বলার মানে কী? নাট্যশালা বলামাত্র সেখানে শৈল্পিক দায়িত্ব এসে পড়েই, যদি সেটা সর্বহারার নাট্যশালাও হয়। শিল্প এমনই এক বস্তু যে প্রচারের জগাখিচুড়িকে সে-নামে অভিহিত করা যায় না।’ পিসকাটর যে সর্বহারার নাট্যশালা থেকে সত্যিসত্যি শিল্পকে বিদায় দিয়েছিলেন ব্যাপারটা তা নয় কিন্তু প্রথম বয়সে তাঁর ঘোষণার মধ্যে অতিবিপ্লবীদের মতো এমন একটা বাড়াবাড়ি ছিল যে, সাম্যবাদী দলের মুখপত্র লালনিশান সেটাকে সঠিক মনে করেনি। লালনিশান সঠিক সমালোচনা করেছিল পিসকাটরের বক্তব্যের। বিপ্লবী শিল্প মানেই শুধু উগ্র প্রচার হবে, শিল্প থাকবে না; কিছুতেই সেটা বিপ্লবী হতে পারে না। পুরোনো নাট্যচিন্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী পিসকাটরের বলার স্বরে বাড়াবাড়ি বা উগ্রতা থাকলেও, তিনি কিন্তু নাট্যমঞ্চায়নের নান্দনিক দিকটাকে সামান্য বাদ দেননি বরং নান্দনিকতা বাড়িয়ে তুলেছিলেন।

পিসকাটর লিখছেন, ‘বহুজন মনে করতে পারে কতোই না বিপ্লবী চিন্তার অধিকারী ছিলাম আমরা। ব্যাপারটা তা নয়। বিরাট সঙ্কটের মাঝখানে ছিলাম, চিন্তা তখনও স্থিরতা পায়নি। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার কী বিপুল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে, কী আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি এবং তুলনায় কতো কম সাফল্য পেয়েছি।’ পিসকাটরের এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায় শিল্পকলা সম্পর্কে কোনো একটি চিন্তা সঠিক রূপ পেতে, সুসংগঠিত বা সুসংবদ্ধ হতে কতোটা সময় নেয়। পিসকাটর বাইশ সাল থেকে কাজ করতে থাকেন বার্লিনের কেন্দ্রীয় নাট্যশালার সাথে। বাইশ সালের উনত্রিশে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় নাট্যশালায় প্রথম মঞ্চস্থ করেন ম্যাক্সিম গোর্কীর “ফিলিস্তিন”। দ্বিতীয় নাটক রঁমা রল্যাঁর “সুদিন আসবে” যা বাইশ সালের নভেম্বর মাসে মঞ্চস্থ করা হয়। কেন্দ্রীয় নাট্যশালার পরের প্রযোজনা লিও টলস্টয়ের “অপশক্তির ক্ষমতা” মঞ্চস্থ হয় উনিশশো তেইশ সালের জানুয়ারি মাসে। পিসকাটরের নাটক এসময় পর্যন্ত সাম্যবাদী দলে মনোযোগ আর্কষণ করতে পারেনি। দর্শকদের কাছে নাটকগুলো সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। প্রলেতারিয়েতদের পক্ষে বিপ্লবী কর্মসূচীকে নাট্যশালায় প্রয়োগ করতে গিয়ে পিসকাটর দেখলেন, শ্রমিক সংগঠনগুলো নাটক বা নাট্যকলার শক্তি সম্পর্কে উদাসীন। সাম্যবাদীদের সমর্থনটা পর্যন্ত পেলেন না পিসকাটর। খুব নিঃসঙ্গভাবেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন। বুর্জোয়া সমাজের অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলি, তারা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে বুর্জোয়াদের চিন্তাকে ব্যবহার করছে অথচ নাট্যশালাকেও যে প্রচারের মারাত্মক হাতিয়ার বানানো যায় সে ব্যাপারটা জার্মানীর সাম্যবাদী দল বা অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনগুলো সহজে বুঝতে চায়নি। বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে বিপ্লবী বিষয়বস্তুর সন্ধান কিংবা তা উপস্থাপনের জন্য বিপ্লবী রীতির কথা কেউ ভাবেনি।

নিজের রচনায় পিসকাটর স্বীকার করেছেন সেসব দিনের কথা। তিনি দেখাচ্ছেন, উনিশ শতকের শেষের দিকে জার্মান সমাজতন্ত্রীরা এক বিশেষ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও খুব দুর্বল কণ্ঠে তাঁরা আবেদন রেখেছিলেন, ‘শিল্প জনগণের সেবায় নিয়োজিত হোক’। সমাজতন্ত্রীদের মুখে ‘জনগণের জন্যে শিল্প’ এই কথাটা শুনতে খুব প্রগতিশীল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা অন্তঃসার শূন্য ছিল। নিজেরাই তাঁরা জানতেন না ‘জনগণের জন্য শিল্প’ কীভাবে তৈরি করা সম্ভব। পিসকাটর লিখছেন, উনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে শিল্পগত ব্যাপারে প্রলেতারিয়েতের অবস্থান ছিল বুর্জোয়া ভাবনার পরিবৃত্তের মধ্যেই; সাধারণ মানুষ নাট্যশালাকে দেখত “শিল্পদেবীর” মন্দির হিসেবে। মনে করা হতো, নাট্যশালায় আত্মা ও অনুভবের ব্যাপারটা থাকবে সবার উপরে। মানুষের যাপিত দৈনন্দিন জীবন থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে সত্য, সৌন্দর্য এবং মহানুভতার এক বিশেষ স্বপ্ন গড়ে তোলার জায়গা ছিল নাট্যশালা। শ্রমিকদের কাছে এই নাট্যশালায় প্রবেশ সামর্থের মধ্যে ছিল না। বার্লিনের নাট্যশালাগুলিতে প্রবেশের জন্য যে-মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তা দেওয়া সম্ভব ছিল শুধুমাত্র সঙ্গতিসম্পন্নদের। ফলে উনিশ শতকের শেষের দিকে “জনগণের জন্য শিল্প” এই শ্লোগানকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল নতুন এক নাট্যশালা ‘ফ্রাইয়ে ফলক্সব্যুহনে’ বা ‘মুক্ত গণমঞ্চ’। পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল, দলটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কম পয়সায় উচ্চমানের নাট্য প্রযোজনার ব্যবস্থা করা; সেই সঙ্গে সংস্কৃতিকে উন্নত করা। নাটকের ইতিহাসে মুক্ত গণমঞ্চের বিরাট ভূমিকা ছিল। কিন্তু সত্যিকারভাবে দেখলে এই নাট্যশালা ছিল ভাববাদী চিন্তার ধারক। নানা রকম ইতিবাচক আর নেতিবাচক চিন্তার সংমিশ্রণে নাটকের বিভিন্নধারাগুলি এভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে।

মহাযুদ্ধের পর উনিশশো বিশ সালে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে দুই নাট্যশালা পুনরায় মিলিত হলো, যার নাম হলো ‘ফোলক্সব্যুহনে’ বা ‘গণমঞ্চ’। পুনর্গঠিত হবার পর তাদের মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় আশি হাজার। এই নাট্যশালাতেই রাইনহার্টের নির্দেশনায় শেক্সপিয়ার ও শিলারের নাটক অভিনীত হতো। শ্রমিকরা হলো অশিক্ষিত উচ্ছৃঙ্খল জনতা; শাসকদের এই ধারণা বা মতামত সত্ত্বে ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষ যে শিল্প-সংস্কৃতিকে কীভাবে গ্রহণ এবং আত্মস্থ করেছিল এই ঘটনা তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। দর্শক সংখ্যা আশি হাজার চারটিখানি কথা নয়। দুটি নাট্যধারা মিলে যখন ফোলক্সব্যুহনে প্রতিষ্ঠিত হয়, পিসকাটর এই নাট্যশালায় নির্দেশক হিসেবে যোগ দেন এবং বিপ্লবী নাট্য প্রযোজনার সূত্রপাত করেন। মহাযুদ্ধের পাঁচ বছর পরের কথা সেটা। কিন্তু পূর্বেই দেখা গেছে, তার আগে পিসকাটর নিজেই দু-দুটো নাট্যশালা গড়ে তোলেন। কিন্তু সেখানে সেভাবে সাফল্য পাননি। সাফল্য পেলেন অনেক পরে। বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, রুশ বিপ্লব সম্পর্কে সচেতনতা তাঁকে মার্কসবাদের প্রতি আস্থাশীল করে তোলে এবং নতুন উপলব্ধি ও বিশ্বাসের জগতে পৌঁছে দেয়। তিনি শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ বেছে নিলেন তাঁর নাটক মঞ্চায়নের জন্য। কিন্তু নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝাতে পারলেন না প্রথম এমনকি সাম্যবাদীদেরকে পর্যন্ত।

পিসকাটর উনিশশো চব্বিশ সালে অতিথি পরিচালক হিসেবে যোগদেন ফোলক্সব্যুহন-এ, যে নাট্যশালায় গণমুখি নাটকের আর নামমাত্র চর্চাও ছিল না। নাট্যশালাটি পূর্বের সকল ঐতিহ্য হারিয়ে নগ্নভাবে হয়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক। পিসকাটর এখানে চব্বিশ সালের ছাব্বিশে মে প্রথম পরিচালনা করেন আলফোঁস পাকের ‘ফাহনেন’ বা পতাকা নাটকটি। পিসকাটর এই প্রযোজনায় যন্ত্রের ব্যাপক প্রয়োগ শুরু করেন। পুতুল নাচ, স্থিরচিত্র, চলচ্চিত্র কিছুই বাদ যায় না। পিসকাটর বলেছিলেন, স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্রের ব্যবহার যেমন নাট্য নির্মাণে সহায়ক তেমনই তা শিক্ষামূলক এবং নাট্যকারের যে-কোনো মন্তব্য করার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। নাটকের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্রে যে মন্তব্যমূলক অংশ বা পরিসংখ্যান থাকতো তা সাধারণত লম্বা পর্দায় প্রতিফলিত হতো। এর সাহায্যে সরাসরি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রতি। পিসকাটর নির্দেশিত পতাকার অভিনয় থেকে মহাকাব্যিক নাট্যকর্মের শুরু। নাটকটির বিষয় ছিল শিকাগোর শ্রমিকদের ভুবন বিখ্যাত আটঘণ্টার কর্মদিবসের জন্য সংগ্রাম এবং তৎসংক্রান্ত নিষ্পেষণ, মিথ্যা মামলা ও মৃত্যুদণ্ড। কুড়িটি পরপর আপাত যোগাযোগবর্জিত দৃশ্যের সমাবেশে মহাকাব্যিক পদ্ধতিতে শিকাগোর ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

পিসকাটরের ‘পতাকা’ নাটকের প্রযোজনা দেখার পর সাম্যবাদীরা বুঝতে পারলো রাজনৈতিক নাটক মানুষের মনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। পিসকাটরই জার্মানীর সাম্যবাদী ও প্রগতিশীলদের পথ দেখালেন কী করে নাটককে বিপ্লবের পক্ষে এবং জনগণের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। শিল্পকলা হিসেবে ‘রেভ্যু’ পদ্ধতি ছিল বার্লিনের এক ঐতিহ্য। নৃত্য-গীতের ফাঁকে ফাঁকে বার্লিনের নৈশ ক্লাবগুলোতে ছোট ছোট হাসি তামাশার দৃশ্য অভিনীত হতো, সেগুলোকে রেভ্যু বলা হয়; যার প্রধান একটা দিক ছিল রাজনৈতিক ব্যঙ্গ। পরবর্তীকালে ‘রেভ্যু’ আঙ্গিকটিই পিসকাটারের হাতে ‘মহাকাব্যিক নাট্য পদ্ধতি’ নামে পূর্ণ বিকশিত হলো। মহাকাব্যিক নাট্য পদ্ধতির মূল চিন্তাটা হলো, কোনো একটি বিষয়কে নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা। পিসকাটর পরিচালনা করেন “রেড রেভ্যু” যার সামগ্রিক বিষয় ছিল জার্মানীর শ্রেণীসংগ্রাম। পুঁজিবাদী ও শোষণের চেহারা এ নাটকে স্পষ্ট করা হলো। শেষ দৃশ্যে বিশ্ববিপ্লবের অনিবার্যতা ঘোষণা করা হয়। রেড রেভ্যু অভিনীত হতে থাকলো শ্রমিক অঞ্চলগুলিতে, লক্ষলক্ষ শ্রমিক সে নাটক দেখলেন। পিসকাটর নাট্যচর্চা থেকে নাট্য আন্দোলনে পা রাখলেন। পিসকাটর সেই যে “রেড রেভ্যু” নাটকের শেষ দৃশ্যে বিপ্লবের অনিবার্যতা দেখালেন রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে, পরবর্তীতে রাজনৈতিক নাট্যরচনায় বা মঞ্চায়নে প্রায়ই সেটা মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছিল।

পিসকাটর পরিচালিত প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নাটকের মধ্যে সব চাইতে স্মরণযোগ্য হলো গাসবারা রচিত “ট্টট্ৎস আলডেম” বা সবকিছু সত্ত্বেও। সাম্যবাদী দলের প্রত্যক্ষ প্রযোজনায় এই নাটক পরিচালনা করলেন তিনি, নাটকটির প্রতিটি ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক দলিল নির্ভর। বিষয়বস্তু আঠারশো আঠারো সালের বিপ্লব। জার্মানীতে বিপ্লবীদের পরজয় এবং লিয়েবনেখট ও লুক্সেমবার্গের হত্যা ছিল এ নাটকের প্রধান দিক। দর্শক হিসাবে সেখানে উপস্থিত ছিল শ্রমিকশ্রেণী। পৃথিবীতে এটাই প্রথম নাটক, যার প্রতিটি দৃশ্য, প্রায় প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি ঘটনা ঐতিহাসিক দলিল নির্ভর। লিয়েবনেখ্টের বক্তৃতা এক সময় পিসকাটরকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল; লিয়েবনেখ্ট বক্তৃতায় সবসময় চলতি ঘটনার চমৎকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতেন। পিসকাটরের রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে মতবিরোধ থাকলেও এটা এখন অত্যন্ত সত্য যে, জনগণকে জাগিয়ে তুলতে বা উত্তেজিত করতে তাঁর পদ্ধতিই সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতির একটি। সেইজন্যই তাঁর বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থীদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল তাহলো, ‘নাট্য প্রযোজনাকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক করে তোলা’। তিনি এ অভিযোগ খণ্ডন করতেন না, বরং তিনি মনে করতেন সত্যিকার অর্থে যে-কোনো মার্কসবাদীর সেটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। রাজনীতি প্রচারের জায়গায় তিনি তাঁর সকল পূর্বসূরীর চেয়ে আলাদা ছিলেন। রাজনৈতিক বিষয়বস্তুই পিসকাটরের পক্ষে যথেষ্ট ছিলো না; তিনি আধুনিক পরিস্থিতিকে প্রকাশের জন্য নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।

দর্শকের কাছে নাটকের সব বক্তব্যকে সুন্দরভাবে পৌঁছে দেয়ার জন্য যে নাট্যাঙ্গিক ব্যবহার করা হবে তাকে কী বলা যাবে? পিসকাটর বলছেন, মহাকাব্যিক। কারণ নাটকীয় ঘটনার সাথে এটা অবশ্যই হবে একটি প্রতিবেদন। নাটক করার সময় বিশেষ করে ঐতিহাসিক নাটক করার সময়ে মনে রাখতে হবে, যে-বিষয় নিয়ে নাটক করা হচ্ছে তা বিপুল এবং বিচিত্র। বিভিন্ন যোগ্যতার, বিভিন্ন মানসিকতার দর্শক থাকবে; সকলের চাওয়া এবং বোঝার মাত্রা এক হবে না। নাট্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়েই নাট্যকর্ম শেষ হলে চলবে না। নাটক যেন দর্শকের উপলদ্ধি তৈরি করে, নিজেকে চিনতে শেখায়। তিনি তাঁর নাট্য আঙ্গিকের নামকরণ করেছিলেন মহাকাব্যিক এ কারণে যে সেখানে সমাজ নিরপেক্ষ, রাজনীতি নিরপেক্ষ কোনো ঘটনা বা চরিত্রের সন্ধান মিলতো না। পিসকাটর চাইছেন অখণ্ড-আস্ত বিশ্বচিত্র, মূল থেকে বিস্তার পর্যন্ত। পিসকাটর শুধু তথ্য চাইছেন না, চাইছেন সত্য। যে-সত্য নিরপেক্ষ নয় এবং শ্রেণীর ঊর্ধ্বে নয়। তিনি মনে করেন পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত, সংগ্রামী শ্রেণীগুলির পক্ষাবলম্বন না করা পর্যন্ত সত্যে উপনীত হওয়া যায় না। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণীর সত্যই বর্তমানে একমাত্র সত্য এবং সে-সত্য বৈপ্লবিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে ধ্বংস না করা গেলে সবকিছুই হয়ে উঠবে কেনাবেচার বস্তু। ধনীকদের বা ধনিকতন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা, এর জন্য এমন কিছু নেই যা করতে সে পিছপা হবে। বিশ্বযুদ্ধ ঘটাবার সকল দায় মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। ধনিকতন্ত্র নিজের মুনাফার স্বার্থে বিশ্বকে বারবার রক্তাক্ত করতে সামান্য দ্বিধান্বিত হয়নি।

পিসকাটরের “গটল্যাণ্ডের ঝড়” নাটকে বিপ্লবের পক্ষে এমন জোরালোভাবে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হলো যে, প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্রগুলি বললো; ‘বলশেভিক প্রচার চলছে নাটকের মাধমে’। পিসকাটরকে বলা হলো রুশ গুপ্তচর এবং ঐসব পত্রিকায় আরো বলা হয়, শিল্পের নামে সোভিয়েত গুপ্তচররা বিপ্লবের উস্কানি দিচ্ছে। পিসকাটরকে কেন বিপ্লব প্রচারের দায়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে না ঐ দাবিও তোলে কিছু পত্রিকা। নাট্যশালার কর্তৃপক্ষ স্বভাবতই প্রযোজনাটির প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন এবং রাজনৈতিক সংবেদশীল অংশ কেটে দেয়া হয়। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন বহু গুণী ব্যক্তি, প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করেন তাঁরা নাটকটিকে অবিকল মঞ্চস্থ হবার জন্য। পিসকাটরকে ঘিরেই জার্মান বুদ্ধিজীবীরা সেদিন দুটো গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েন; চলতে থাকে দুপক্ষের জোরালো বাদ-প্রতিবাদ। বহুদিনের ঝিমিয়ে পড়া নাট্যশালায় পিসকাটর বয়ে আনলেন নতুন বিতর্ক এবং প্রাণপ্রাচুর্য। কিন্তু নাট্যশালার কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়ে গেল। পিসকাটর তখন ঐ নাট্যশালা ছেড়ে এসে নিজস্ব নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় এবার মাঠে নামলেন। পিসকাটর নাট্য পরিচালনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার জন্য নলেনডর্ফপ্লাটস-এ একটি রঙ্গমঞ্চ ভাড়া নিয়ে নিজের দল পিসকাটর ব্যুহনে বা পিসকাটর মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি নিজেই ছিলেন এই দলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নলেনডর্ফপ্লাটস-এর রঙ্গমঞ্চটিকে ভেঙেচুরে যথাসম্ভব যন্ত্রপাতি স্থাপন করলেন পিসকাটর। তিনি লিখেছেন, নাট্যশালার স্থাপত্য বিশেষ এক সময়ের নাটকের রূপরীতির সঙ্গে যুক্ত। দুটি পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। পিসকাটরের নলেনডর্ফপ্লাটস-এ প্রথমবারের মতো বিশ্ব রাজনৈতিক নাট্যশালার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলি একের পর এক জনসমক্ষে আবির্ভূত হলো।

সংক্ষেপে মহাকাব্যিক নাট্য হচ্ছে নাট্যক্রিয়াসমূহের প্রসারণ এবং যে প্রেক্ষাপটে এই ক্রিয়াগুলি সংঘটিত হচ্ছে তার ব্যাখ্যা। ব্রেশটের দৃঢ় অভিমত ছিল যে, পিসকাটর যা পর্যবেক্ষণ করতেন তার থেকে এগিয়ে ছিলেন কিন্তু ঘাটতি ছিল চিন্তার ক্ষেত্রে। কারণ তিনি অভিনয়ের ক্ষেত্রে সংঘাতের প্রশ্রয় দিতেন কিন্তু স্বচ্ছ ধারণার অভাব ছিল। পিসকাটর কীভাবে অভিনেতাদের তৈরি করতেন তা সম্পর্কে ব্রেশ্ট বলেছিলেন টলারের হোপলা ভির লেবেন নাটক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে। প্রত্যেক অভিনেতাকে সচেতন থাকতে হতো যে তিনি একটি সামাজিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। মহড়ায় অনেকটা সময় ব্যয় করতেন প্রত্যেকটি চরিত্রের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝানোর জন্য। যখন অভিনেতা তাঁর ভূমিকার গুরুত্ব বুঝতে পারতেন তখনই তিনি তার সার্থকরূপ দিতে পারতেন। তাঁর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে অভিনেতাদের বোধের ক্ষেত্রটিকে ধারালো করতো কিন্তু নতুন নাট্যশৈলী উদ্ভাবনে ততোটা সাহায্য করতো না যতোটা করতো গুরুত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে। হোপলা নাটকটিতে প্রলেতারীয় চরিত্রগুলোকে অতিরিক্ত মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। বিপরীত দিকে ভাইমার প্রতিষ্ঠানকে নগ্ন করা হয়েছে হাস্যোদ্দীপক উপাদান ব্যবহার করে। বিষয়বস্তু জোরালো হলেও, সমাজ বিশ্লেষণের ততটা গভীরে প্রকাশ করতে পারেনি। কিন্তু পিসকাটরের নির্দেশনার ক্ষেত্রে ব্রেশট স্বীকার করে নেন, এ হলো এক নতুন ধরনের নাট্যশালা যেখানে নির্দেশনার ক্ষেত্রে নানা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

পিসকাটর ব্যুহনের দ্বিতীয় প্রযোজনা ছিল লিও টলস্টয়ের “রাসপুটিন”। নাটকটির নাট্যরূপ দেন পিসকাটর, গাসবারা, লানিয়া ও ব্রেশট মিলে এবং পরিচালক পিসকাটর স্বয়ং। মঞ্চজুড়ে এক বিশাল ভূগোলক, সেটা ঘুরে যাচ্ছে আর তার একেকটি দেয়াল খুলে গিয়ে ভিতরে দৃশ্যমান হচ্ছে নানা মঞ্চস্থাপত্য; জারের প্রাসাদের নানা কক্ষ, লেনিনের সদর দপ্তর, সম্রাজ্ঞীর শয়নকক্ষ, কাইজারের কার্যালয়। ভূগোলকটি যখন স্থির, তখন অভিনয় হচ্ছে তার চূড়ায়। জার দাঁড়িয়ে আছেন যেন পৃথিবীকে পায়ের তলায় চেপে, কিন্তু তিনি জানেন না তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বহুগুণ বৃহৎ রাসপুটিনের ছায়া। নাটকের শুরু চলচ্চিত্রে জারদের ইতিবৃত্ত দেখিয়ে। প্রায় প্রত্যেক জারের ছবি দেখিয়েই সংক্ষিপ্ত লেখা; ‘অপঘাতে মৃত্যু’ বা ‘আততায়ীর হাতে নিহত’। চলচ্চিত্রের সব চমকপ্রদ ব্যবহার রয়েছে নাটকের মাঝে। মঞ্চে জার ও জারিনা নিভৃতে আলাপ করছেন কী করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা যায়; পেছনে পর্দায় একই সঙ্গে ভবিষ্যতের এক ঘটনা ঘটে চলেছে, একতেরিনবুর্গ শহরে লালফৌজ জারকে সপরিবারে গুলি করে মারছে। চতুর্দশ দৃশ্যে জারিনা বলছেন, বিপ্লবীদের দমন করো। পাশাপাশি পেছনের পর্দায় দেখা যাচ্ছে দ্বাররুদ্ধ একটি ট্রেন রুশিয়ার সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে, যে-ট্রেনে লেনিন ফিরে আসছেন পেত্রোগ্রাদে। চরিত্ররা নিজেদের ক্ষুদ্র সমস্যায় ডুবে আছে কিন্তু নাটক তাদের ছাড়িয়ে, নাট্যক্রিয়াকে অতিক্রম করে আস্ত ইতিহাস উপস্থিত করে দিচ্ছে দর্শকের সামনে। পিসকাটর মনে করতেন, যুগের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করাও ঐতিহাসিক নাটকের অবশ্য দায়িত্ব কারণ তাহলেই দর্শক ভবিষ্যত সমাজের গড়ন সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। রাজনৈতিক নাট্য প্রযোজনার প্রথম দিন থেকেই পিসকাটর এই নীতিতে অবিচল ছিলেন।

রাসপুটিন নাটকটিও ছিল প্রামাণ্য দলিলের মতো, রাসপুটিনকে তিনি দেখেছেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। রাসপুটিন নাটকের আঙ্গিক রচনা করেছিলেন পিসকাটর সেন্ট পিটার্সবুর্গের ফরাসী রাষ্ট্রদূত মরি পাইলের স্মৃতিকথা পাঠ করে। পিসকাটর বলছেন, রাজনৈতিক নাট্য তৈরির জন্য একটি ঐতিহাসিক নাটকের সমগ্র যুগের বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে হবে এবং মঞ্চে তাকে জীবন্ত হয়ে উঠতে হবে। তিনি দেখিয়েছেন যে, রাসপুটিন যে-সমস্ত ছোটখাট রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছিল তার কোনোটাকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না দার্দালেনেসে প্রযুক্ত ইংরেজ কূটনীতির প্রেক্ষাপট বা পশ্চিম সীমান্তে সামরিক অভিযানের ঘটনাকে উল্লেখ না করে। জনপ্রতিনিধিরা যা বলছেন তার সবই প্রমাণ নির্ভর। পিসকাটরের বিরুদ্ধে প্রাক্তন কাইজার একটি আইনি অভিযোগ এনেছিলেন, যে অভিযোগে বলা হয়; পিসকাটর মঞ্চে কাইজারের মুখ দিয়ে যেসব সংলাপ বলিয়েছেন তার সবই বাস্তবজীবনে কাইজার উচ্চারণ করেছেন।

টলস্টয়ের মূল গল্পটি অক্ষত থাকছে কিন্তু শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা দেখানোর জন্য নতুন দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, মঞ্চে ঘটনাসমূহের যে মার্কসবাদী ব্যাখ্যা তিনি করেছেন তা কোনো নতুন ব্যাখ্যা নয়, সত্যের সুনির্দিষ্ট প্রকাশ। নাটক চলতো চারঘণ্টা ধরে এবং দর্শকদের টানটান করে রাখতো। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে মূল নাটকটি উপস্থাপিত হতো। প্রত্যেকটি সংলাপের সঙ্গে থাকতো উপযুক্ত মন্তব্য এবং প্রায়ই শব্দহীন চলচ্চিত্রের সাহায্যে বৈপরীত্য সৃষ্টি করা হতো। ঐতিহাসিক নাটক কোনো নায়কের ব্যক্তিগত দুঃখের কাহিনী নয়, এটা হচ্ছে একটি যুগের রাজনৈতিক দলিল। ঐতিহাসিক নাটক শুধুমাত্র একটি শিক্ষামূলক অনুমান নয়, এটা হচ্ছে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন এবং একই সঙ্গে সেই শক্তিসমূহের প্রকাশ যা বর্তমানকে এবং আশু ভবিষ্যতকে নির্মাণ করার সামর্থ রাখে। নাটকের এই দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক নাটকের সূত্রকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। নাট্য গঠনশৈলীর ব্যাপারটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্ব হচ্ছে সমগ্র যুগকে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় তুলে ধরায় ক্ষমতা, একবারে মূল থেকে শাখা সমেত। নাটক দর্শকের কাছে তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন তা সঠিক প্রমাণ এবং তথ্যের দ্বারা সমর্থিত। চলচ্চিত্র এবং টুকরো ছবির সাহায্যে বাইরের ঘটনাসমূহকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এই প্রয়াস আরো গভীরতা পেয়ে যায়। দুটি দৃশ্যের মাঝখানে এই টুকরো চলমান ছবির ব্যবহার যেন তীক্ষ্ণ-আলোর মতো ইতিহাসের নিকষ অন্ধকার অংশকেও আলোকিত উদ্ভাসে পূর্ণ করে।

নাট্য প্রযোজনায় পিসকাটর নানান আঙ্গিকগত কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সত্যি বলতে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল রীতিমত ব্যয় সাপেক্ষ। তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে মূল কারণ ছিল শ্রমিকদের কাছে নাটককে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। শ্রমিকরা যেখানে মানসিক পক্ষাঘাতে পঙ্গু সেখানে শ্রমিকের নাট্যশালাকে শক্ত বিষয়বস্তুর পাশাপাশি চমকের উপরেও নির্ভর করতে হয়। নাহলে শ্রমিকের বিয়োজিত বিচ্ছিন্ন ক্লান্ত দেহমন তা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। তিনি শুধু নাট্যপ্রযোজনা করা নয়, সে প্রযোজনাকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথাও ভেবেছিলেন। সেজন্য গবেষণা চালিয়েছিলেন। যিনি বিশ শতকের উপযোগী নতুন নাটক ও নাট্যশালা সৃষ্টিতে উদ্যত, তিনি পুরাতন অভ্যস্ত চিন্তার দাসত্ব করতে পারেন না। নতুন চিন্তা তাঁকে আমদানি করতেই হয়। তাঁকে বিদ্রোহ করতেই হয় দর্শক ও অভিনেতার অভ্যাসগুলির বিরুদ্ধে। তিনি একদিকে যেমন যান্ত্রিক সব উপকরণের সাহায্য নিয়েছিলেন অন্যদিকে আবার বিষয়বস্তুর জন্য সাহায্য নিয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের। পিসকাটর লিখেছেন, ‘আমার কাছে কেউ কেউ দাবি করেন, সরল নাটক ও সরল দৃশ্যসজ্জা; এক কথায় পুরানো ঢংয়ের নাটক। না, প্রলেতারীয় নাটককে স্বাভাবিকতাবাদী ঢংয়ে উপস্থিত করা আমাদের কাজ নয়। মঞ্চের বিকাশকে পঞ্চাশ বছর আগের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো না। রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য হচ্ছে বুর্জোয়া নাট্যশালাকে অতিক্রম করে যেতে হবে দর্শনে, নাট্যতত্ত্বে, মঞ্চকৌশলে এবং সর্বোপরি নাটক মঞ্চায়নে।’ তিনি বলেন, রাজনীতিতেই মানুষ সবচেয়ে পরিষ্ফুট, রাজনীতির মধ্যেই মানুষ যথার্থ মানুষ।

পিসকাটরের মার্কসবাদী নাটক দেখার পর প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্রগুলি সবসময় “নন্দনতত্ত্বের” প্রশ্ন তুলে তাঁকে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। পিসকাটরের পূর্বের বা বিগত যুগের শৈল্পিক মাপকাঠিতে সংবাদপত্রগুলি তাঁকে বিচার করতে বসেছিলেন। সাম্যবাদী দলের ভিতরে বহু পাতিবুর্জোয়া থাকে, পিসকাটরকে আক্রমণ করতে তাঁরাও ছাড়েননি। পিসকাটর বারবার এইরকম বিরূপ সমালোচনার মুখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষা এবং তার শৈল্পিক প্রকাশের মধ্যে যে কার্যকারণ সম্পর্ক সেটাই এঁরা বোঝেননি। দুটি অবিচ্ছেদ্য। যদিও যে-কোনো নাটকের আমি একটি চিত্তাকর্ষক প্রযোজনা উপস্থিত করে দিতে পারি, কিন্তু আমার নিজস্ব মঞ্চের যে আঙ্গিক, তার যন্ত্রকৌশল, চলচ্চিত্রের ব্যবহার, বহুতল বিশিষ্ট মঞ্চসজ্জা; এসব সমাজতন্ত্রের প্রতি আমার অনুগত্য ব্যতীত চিন্তা করাই যেতো না।’ পিসকাটর লিখছেন, নতুন আঙ্গিক প্রয়োগের এই দৃষ্টিভঙ্গীর পেছনে রয়েছে মানুষকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা। মানুষ এবং তার আবেগ, তার নানা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্ক, ইশ্বর সম্পর্কে তার মনোভাব বা যে-কোনো মতাদর্শ, তার সংগ্রাম; সবকিছুকে ফুটিয়ে তোলা। পিসকাটরের আঙ্গিক তাঁর সাম্যবাদী রাজনীতি থেকে আগত। পিসকাটর নিজেই লিখেছেন, পিসকাটর-ব্যুহনের প্রত্যেকটি প্রযোজনাই ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অজ্ঞাত প্রান্তরে পা ফেলা। সবই ছিলো পরীক্ষামূলক; দর্শন, নাটক, পরিচালনা এবং যন্ত্রের প্রয়োগ। কিন্তু সর্বোপরি ছিল টিকে থাকার প্রশ্ন; বাণিজ্যিক সাফল্যের পরীক্ষা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে পিসকাটর বার্লিনে আরো পাঁচটি নাটক প্রযোজনা করেছিলেন। উনিশশো উনত্রিশ সালটি বিভিন্ন কারণে তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এই সালেই পিসকাটরের ‘রাজনৈতিক নাটক’ নামে বহুল আলোচিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তিনি এই বছরেই “বার্লিনের ব্যবসায়ী” এবং “দুর্দশাগ্রস্ত রমনী” নামে দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক মঞ্চায়ন করেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নাট্যকার মেহরিংয়ের বার্লিনের ব্যবসায়ী নাটকটি নলেনডর্ফপ্লাটস-এ অভিনীত হয় উনিশশো উনত্রিশ সালের ছয়ই নভেম্বর। উনত্রিশ সালেরই তেইশে নভেম্বর এ্যাপোলো নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয় গর্ভপাতের আইনকে আক্রমণ করে কার্ল ক্রেডের দুর্দশাগ্রস্ত রমনী নাটকটি। পিসকাটরব্যুহনে তৈরির আগে থেকেই যে অভিনেতারা ছিলেন তাঁরাই এই নাটকটিতে অভিনয় করেন এবং এর তিনশোটি অভিনয় হয়েছিল। কিন্তু এই নাটক পিসকাটরকে তৃপ্ত করেনি। পিসকাটর উনিশশো ত্রিশ সালে লেসিং থিয়েটার-এ প্রযোজনা করেন “কাইজারস কুলিস” বা সম্রাটের কুলিরা। পিসকাটর একত্রিশ সালে পরিচালনা করেছিলেন ফ্রিডরিশ ভোলফের “তাই ইয়াংয়ের নিদ্রাভঙ্গ” নাটকটি যখন ব্রেশট পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন তাঁর “মানুষ মানুষই” নাটক নিয়ে।

রাজনৈতিক নাট্য গ্রন্থে পিসকাটরের নাটক সম্পর্কিত বক্তব্য যা তিনি নাটকের সমাজতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসাবে তুলে ধরলেন, তা খুবই সাধারণ ছিল। বরং প্রচলিত অর্থে নাট্যরীতি সম্পর্কে কিছু নির্দেশাত্মক বক্তব্যই তুলে ধরা হয়েছিল সেখানে। পিসকাটরের মত বা তাঁর নতুন দৃষ্টিকোণ মানুষ সম্পর্কে নতুন ধারণা এবং যুদ্ধ ও বিপ্লবকে মঞ্চে তুলে ধরার প্রকরণসমূহ বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে শেষ করে দিয়েছিল এবং ঐতিহাসিক নাটকের ‘চমকপ্রদ নায়ক’-এর ধারণাকে গুড়িয়ে দিলো। বড় বড় সব চিরায়ত নায়কদের জায়গায় যুদ্ধ এবং বিপ্লবের মতো ঘটনাই প্রধান হয়ে দাঁড়ালো; প্রথম মহাযুদ্ধের উৎসাহের অভিমুখ নায়ককে পাল্টে দিলো ব্যক্তি থেকে জনগণে। নাট্যকার হিসাবে ব্রেশ্ট বেশি মগ্ন থাকতেন নাটকের আখ্যানভাগ রচনায় আর পিসকাটরের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল নাটকটার মঞ্চায়ন পদ্ধতি। তিনি প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন একজন পরিচালক। পিসকাটর প্রসঙ্গে ব্রেশ্ট নিজেই বলেছিলেন, নাট্য প্রযোজনায় চলচ্চিত্র প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নাট্যশালাকে শ্রেণীসংগ্রামের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন পরিচালকরাই, নাট্যকাররা নন। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল যে, পিসকাটরের এই পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত কম ক্রিয়াশীল। ব্রেশট মনে করতেন, পিসকাটর যা করেছেন সেটাই হলো বুর্জোয়া স্বাভাবিকবাদ রীতির চূড়ান্ত স্তর।

পিসকাটর নিজে ব্রেশ্টের এই সমালোচনা মেনে নেননি। পরবর্তীকালে পিসকাটরের অনুসারী লিওপোল্ড জেসনারের কয়েকটি প্রযোজনা দেখে ব্রেশ্ট যথাযথ একটি মূল্যায়ন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পিসকাটর শুধু নাটক মঞ্চায়নের আঙ্গিক নিয়েই বেশি ভেবেছেন এটা ঠিক নয়, তিনি নাট্য প্রযোজনায় অনেক নতুন বিষয়বস্তুও এনেছেন। লিওপোল্ড জেসনার সফোক্লিসের “ইডিপাস” মঞ্চস্থ করতে গিয়ে যে অসামান্য নাট্যক্রিয়ার সঙ্গে গল্প বলেছেন সময়ের থেকে তা বহুগুণ এগিয়েছিল। এখান থেকেই ব্রেশ্ট নিজের নাট্যনির্মিতির মৌলিক সূত্র আবিষ্কার করেন। পিসকাটর তাঁর নাটকে যে সমসাময়িক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের অবতারণা করতেন এটা ব্রেশ্ট ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছিলেন। নাটকের ঘটনা নির্বাচনে জটিলতাই পিসকাটরকে উদ্বুদ্ধ করতো। তিনি বিশ্বাস করতেন, নাট্য উপস্থাপনার প্রশ্নে বিভিন্ন দল এবং শ্রেণীগুলির মধ্যকার সংঘর্ষকে তুলে ধরাই হবে আসল কাজ। বৃহদায়তনের ঘটনাবহুল নাটকই তাই পিসকাটরের পছন্দের তালিকায় ছিল। নাট্য ঘটনায় উত্তেজক কিছু থাকলে তাকে বিস্তৃত করা হতো। প্রয়োজনে নতুন চরিত্র তৈরি করে অথবা ঘোষণা বা প্রতিবেদন কিংবা চলচ্চিত্রের টুকরো ইত্যাদি ব্যবহার করে নাট্যকে গতিময় করতেন তিনি। ঘটনাক্রম কখনই তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হতো না এবং ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে তিনি পশ্চাদপট পর্বটিকে যতোটা সম্ভব মূলের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য প্রসারিত করতেন। মঞ্চের সবকিছুই হবে সুনির্দিষ্ট, মূলের সঙ্গে প্রত্যেকটি অংশ থাকবে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।

বিশের দশকের শুরুতেই তিনি প্রলেতারীয় নাট্য সম্পর্কে তাঁর মত ব্যক্ত করেন এইভাবে যে, বিপ্লবী লক্ষ্যের অধীন থাকবে অন্য সকল শৈল্পিক উপলক্ষ্য সমূহ। সচেতনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে শ্রেণীসংগ্রামের ওপর এবং অনুশীলন চলবে শ্রেণীসংগ্রাম নিয়েই। নাট্যচর্চায় শ্রমিকশ্রেণীর মার্কসীয় দর্শনকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন পিসকাটর এবং ব্রেশ্ট। রাজনৈতিক নাট্যকার হিসাবে সারা বিশ্বে ব্রেশ্ট স্বীকৃত। শত্রুরাও ব্রেশ্টকে এড়িয়ে সুবিধা করে উঠতে পারছে না বলে তাঁর নাটকের বৈপ্লবিক সারপদার্থটা বাদ দিয়ে নাটকটাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছে শাসকদের মনঃপূতভাবে। কিন্তু শত্রুরা হার মানে পিসকাটরের দোরগোড়ায় এসে। পিসকাটর নাটক লেখেননি, প্রযোজনা করেছেন মাত্র। দেশকাল অতিক্রম করে পিসকাটর সারা বিশ্বের রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি তাঁর নির্দেশনা পদ্ধতি সকল পক্ষই গ্রহণ করেছেন নিজেদের প্রয়োজন মতো। পিসকাটর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গণমঞ্চ নয়, সর্বহারার মঞ্চ; নিজের কাজকে তিনি প্রলেতারিয়েতদের পক্ষে ব্যবহার করার কথাই বলেছেন।। পিসকাটর লিখেছেন, ‘আমি পরিচালনার একটা বিশেষ পদ্ধতি বিকশিত করতে সমর্থ হলাম যাকে পরে অন্যেরা ‘মহাকাব্যিক নাটক’ নাম দিয়েছেন। বস্তুটা কী? সংক্ষেপে বলতে গেলে, নাট্যক্রিয়ার সম্প্রসারণ এবং পটভূমিকার বিশ্লেষণ; অর্থাৎ নাটকটি নাট্যকাঠামোর বাইরে বিস্তৃত হবে।’

পিসকাটর যখন বিপ্লবী নাট্যশালা গড়তে শুরু করেন, তখন বাস্তবতার নামে স্বাভাবিকতা ছিল নাট্যআঙ্গিক। মঞ্চে জীবনের হুবহু প্রতিফলন দেখানোর চেষ্টা করা হতো। বলা হতো রঙ্গমঞ্চ সমাজের দর্পণ। পিসকাটর বললেন, ‘রঙ্গমঞ্চ সমাজের দর্পণ নয়, সমাজ পরিবর্তন করার অস্ত্র’। বাস্তববাদ সম্পর্কে তিনি মনে করতেন, নাট্যশালায় তা নিয়ে এলো এমন এক বাস্তবের দাবি যার চেয়ে অবাস্তব আর কিছুই হতে পারে না। বাস্তববাদ হচ্ছে ইতিহাসের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, পরিবর্তনের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্তের গা-বাঁচানো ক্ষুদ্র চিন্তা। তিনি মনে করতেন স্বাভাবিকবাদী আঙ্গিককে চূর্ণ করতে না পারলে মার্কসীয় জীবনদর্শনকে মঞ্চে প্রকাশই করা যাবে না। পিসকাটরের এই চিন্তার সাথে তার কোনো পূর্বসূরীর নাট্যচিন্তার মিল থাকতে পারে না। কিন্তু নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে তাঁর ওপর কারো বিন্দুমাত্র প্রভাব ছিল না, তা সত্যি নয়। পিসকাটর নিজেই স্বীকার করেছেন নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে তিনি কখনো কখনো রাইনহার্টের প্রযোজনার ঢং সামান্য অনুসরণ করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর উপর ভীষণ প্রভাব ছিল আলবার্ট স্টেইনর্যুকের, সেটা প্রতিভাদর অভিনয়ের ক্ষেত্রে।

হিউ রোরিসন পিসকাটরের অভিনয় পদ্ধতি সম্পর্কে লিখছেন, সুক্ষ্মভাবে রচিত কাব্যিক মেজাজের অভিনয় পদ্ধতির সাহায্যে তিনি বিষয়বস্তুকে আক্রমণাত্মক রূপ দিতে চেয়েছিলেন এবং সেইজন্যই তাঁর একটি অভিধার দরকার হয়েছিল যার তিনি নাম দিয়েছিলেন নব্য বাস্তববাদ। এটা ছিল বেশ কঠিন, নির্দ্বিধ, অবিকৃত এবং নির্মেদ। যা তিনি করেছিলেন তার সঙ্গে স্বাভাবিকবাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। নিশ্চিতভাবেই পিসকাটর কোনো পেশাদার স্বাভাবিকতা চাননি। চেয়েছিলেন বুদ্ধির দ্বারা পরিচ্ছন্নভাবে বিশ্লেষিত একটি বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা যা একটি উন্নত স্তরের স্বাভাবিকতার জন্ম দেবে এবং যা হবে দেশকালের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা কারণেই পিসকাটর নতুন নাটক এবং নতুন অভিনয় রীতির প্রয়োজনটা বুঝতেন। পিসকাটরের কাছে নান্দনিকতা বিষয়টিও ছিল রাজনৈতিক বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নান্দনিকতাহীন কোনো নাটক তিনি করেননি। বরং বলা যায় রাজনৈতিক নাটক নান্দনিকতার বিরোধী তো নয়ই, নতুন নান্দনিকতার জন্মদাতা। পিসকাটরব্যুহনের যে স্বল্প কয়েকজন অভিনেতা পরবর্তী সময়েও টিকে ছিলেন তাঁদের অন্যতম গেরহার্ট বিয়েনার্ট, তাঁর কাছে থেকে প্রত্যক্ষ এবং বাস্তববাদী অভিনয় ব্যতীত অন্য কিছু চাওয়া হতো কি না তিনি মনে করতে পারেন না। তিনি এমনকি ব্রেশটের বিয়োজন তত্ত্ব বুঝতে পারতেন না। পিসকাটরের অভিনয় পদ্ধতি কিন্তু বাস্তববাদীই ছিল।

রাজনীতির গর্ভে পিসকাটরের যাবতীয় নাট্যচিন্তা নিহিত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তিনি তাঁর সমকালীন নাটক তো বটেই ধ্রুপদী নাটকও পরিবর্তন করে নিতেন। তাঁর মহাকাব্যিক পদ্ধতি অকারণে ভাবাবেগ সৃষ্টির বিরোধী। সেজন্য তিনি নাটকে প্রামাণ্য কায়দায় ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে, ভাবাবেগের পরিবর্তে দর্শককে যুক্তির মুখোমুখি দাঁড় করান। মার্কসবাদই যে দুনিয়াকে বুঝবার একমাত্র পথ এটাকে মঞ্চে প্রকাশ করাই ছিল পিসকাটরের একমাত্র লক্ষ্য। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, পিসকাটর সব নাটকেই জোর করে শ্রেণীসংগ্রাম ঢোকাবার চেষ্টা করতেন। তার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নাটক বাস্তবতা হারিয়ে নির্জলা রাজনৈতিক প্রচারে পরিণত হতো। খুবই সত্য যে, পিসকাটর যে-কোনো নাটককেই দ্বান্দ্বিক বা শ্রেণীসংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। তবে তার প্রকাশ ঘটতো শিল্পসম্মতভাবেই। পিসকাটর মনে করতেন, শিল্প ছাড়া নাটক হতে পারে না এবং নাটক কিছু প্রচার না করেও পারে না। সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে একত্রিশ সালে হিটলারের আক্রমণে দেশ ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সত্যিকার অর্থেই শ্রমজীবীদের সাথে থেকে শ্রমিকদের জন্য কাজ করেছেন। ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংকটে থেকেও তিনি কখনো দর্শককে স্থির থাকতে দেননি, তাদের চারপাশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যাসমূহকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। সেসব মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছেন এবং একের পর এক রাজনৈতিক নাট্য প্রযোজনার মধ্য দিয়ে জার্মান নাট্য ইতিহাসে, এমনকি বিশ্বের নাট্য ইতিহাসের জন্য নতুন ধারার জন্ম দিয়ে গেছেন। সোভিয়েত দেশে প্রথম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও যা তারা পারেনি, সে কাজটিই সম্পন্ন করেছেন জার্মানীতে পিসকাটর। ব্রেশ্ট নিজেই স্টকহোমের এক সেমিনারে যুক্তিসঙ্গতভাবেই একথা বলেন যে, বর্তমানকালের প্রায় সকল নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে সকল প্রচলিত ধারা ভেঙে পিসকাটরের ধারাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। তিনি জার্মানীর রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং তিনি রাশিয়ার গণজাগরণমূলক নাটককে নতুন পথ দেখান। পিসকাটরের চিন্তাই পরবর্তীকালে সমস্ত প্রতিবাদী নাট্য প্রযোজনার রীতি নির্ধারিত করেছে। ফ্রীডরিশ ভোলফ স্বীকার করেন যে, পেশাদার মঞ্চের সমস্ত বামপন্থী নাটক তা সে ভান্গেন হাইমের মাউসেফেলেই হোক কিংবা ব্রেশ্টের মহাকব্যিক বা তাঁর নিজের কোনো নাটকই হোক; পিসকাটর-এর চিন্তা বা শ্রমিকশ্রেণীর নাট্যদলগুলির কাজ ছাড়া এসব নাটকের চিন্তাই সম্ভব ছিল না।

রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে পিসকাটর বলছেন, নাটকে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই হবে না, চাই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা। শিল্পকলায় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বলতে বোঝানো হয়, শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গিকে শিল্প-সাহিত্যে গ্রহণ করা। বুর্জোয়াদের সকল প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প ধারণার গণ্ডিবদ্ধতা থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার জন্ম। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা চায় সমাজের বিকাশ বা বিবর্তনের নিয়মকে আলোয় উদ্ভাসিত করতে। বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ববাদের জায়গায় সমাজ বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠা দিতে। শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামে পক্ষ নিতে। পিসকাটর লিখছেন, ‘সত্য ও পক্ষপাতিত্বের সম্পর্ক কী। এ দুটির মধ্যে কি কোনো বিরোধ আছে? একেবারেই নয়। যে যুগে সত্য হচ্ছে বৈপ্লবিক সে যুগে এ দুটির অঙ্গাঙ্গি মিল। যার অর্থ পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত, সংগ্রামী শ্রেণীগুলির পক্ষ অবলম্বন না করা পর্যন্ত সত্যে উপনীতই হওয়া যাবে না। সকলের জন্য, সকলের পছন্দের সত্য বলে কিছু নেই। পিসকাটরের সঙ্গে একমত হয়ে ব্রেশ্টও বলেন, শ্রমিকশ্রেণী ব্যতীত এখন পর্যন্ত কোনো শ্রেণী নেই যার সত্যের প্রয়োজন আছে। বাকিরা আকণ্ঠ মিথ্যায় ডুবে আছে, নানা মিথ্যা কথা বলে শ্রমিকশ্রেণীর চূড়ান্ত বিজয়ের সত্যটাকে আড়াল করছে। শাসকশ্রেণীর সত্য হলো মিথ্যা, বিশ্বটাকে গ্রাস করার জন্য নানা মিথ্যাকে তারা সত্যি বলে চালাচ্ছে। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণীর সত্যই এখন একমাত্র সত্য এবং সে সত্য বৈপ্লবিক।

রাজনীতি পৌঁছে দিতে হবে জনগণের কাছে, শ্রমিকশ্রেণীর কাছে সেটাই ছিল পিসকাটরের নাট্যকর্মের প্রধান উদ্দেশ্য। নাট্য পরিচালক ও তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর আর একটি বড় অবদান হলো পেশাদার নাট্যশালাকে নতুন দিক নির্দেশনা দেয়া। তিনি মনে করতেন, যদি দ্বন্দ্ববহুল ঘটনাকে নাটকে স্থান দেয়া যায় তাহলে দর্শক সে-নাটক দেখতে আসবেই এবং প্রবেশপত্র বিক্রি হবেই। পিসকাটর লিখেছেন, একসময়ে দেখা দিল দূরহ সমস্যা; সেই নাটক খুঁজে বার করা যা রাজনীতির দিক থেকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অথচ মঞ্চসফল। কিন্তু সতর্ক ছিলাম যেন বাণিজ্যিক নাট্যশালার কাছে আত্মসমর্পণ করতে না হয়। পিসকাটর বলেন, ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে নাটক হয় না; নির্জনে নাট্য সাধনা কথাটা স্ববিরোধী। পিসকাটর নিজের প্রযোজনার ক্ষেত্রে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করে রেখে গেছেন। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহেই তিনি তাঁর বিপ্লবী নাটকগুলো মঞ্চস্থ করেছেন। দর্শক নাটকের বিষয়গুলো যেমন গ্রহণ করেছেন ঠিক তেমনি তার প্রযোজনা পদ্ধতি দেখে চমকিত হয়েছেন। সর্বদাই তিনি সতর্ক ছিলেন আর্থিক সাফল্যের দিকে, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নয়।

পিসকাটর তাঁর নাট্যকর্ম থেকে ‘শিল্প’ শব্দটি বর্জন করার ঘোষণা দিলেও মূলত তিনি তা করেননি। তিনি শিল্প বর্জনের কথাটি বলেছিলেন যাঁরা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ চর্চার শ্লোগান তুলেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধাচারণ করবার জন্য। তিনি মনে করতেন, ক্ষুরধার প্রতিভার দরকার শিল্পের মধ্যে রাজনীতির স্ফুরণ ঘটাতে হলে। যে-কোনো শিল্প মাধ্যম থেকে নান্দনিকতা বিচ্যুত হলেই সেখানেই তার পরিসমাপ্তি। তিনি তাঁর নাটকে যতোই রাজনৈতিক প্রচার চালান না কেন, শিল্পসম্মতভাবেই তা ঘটতো। তাঁর নাট্য প্রযোজনাগুলো সচেতনভাবে এমন উদাহরণ রাখতে চেয়েছিল যা এক নতুন ধরনের নাট্যশালার বাস্তব ভিত্তি স্থাপন করবে। তিনিই প্রথম নাট্য পরিচালক যিনি নাট্যপ্রযোজনায় চলচ্চিত্রের ব্যবহার আনেন এবং দৃশ্যপটটিকেও পর্যন্ত অভিনেতায় পরিণত করেন। উৎপল দত্ত তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, পিসকাটর মঞ্চের সর্ববিধ যন্ত্রকে রাজনৈতিক নাটকের কাজে নিয়োজিত করে শতাব্দীর সবচেয়ে বিশাল প্রযোজনাগুলোর সৃষ্টি করেছিলেন। পাশ্চাত্যের নাট্যবিদরা যে ঘন ঘন ‘টোটাল থিয়েটারের’ কথা বলেন তাও পিসকাটরের সৃষ্টি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এক সময়ে সারা ইউরোপের নাট্যশালাকে পিসকাটর একা সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলেছিলেন। উৎপল দত্ত লিখেছেন, ‘পিসকাটরের পদ্ধতি হচ্ছে ভবিষ্যতের নাট্যরীতির এক অপূর্ব সূত্র। ভুল করবেন না, পিসকাটরের পদ্ধতি সাম্যবাদী দলের নিজস্ব কোনো ব্যাপার নয়। যে-কোনো দল বা সংগঠনই তাঁর উদ্দীপনাকে মঞ্চে রূপ দিতে পারে যদি সে পিসকাটরের পদ্ধতি অনুসরণ করে।’ সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাণিজ্যিক নাট্যশালাগুলিও পিসকাটরের নাট্য পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছে।