রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা: নানা বিভ্রান্তি

পর্ব ৪

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০২০

গণনাট্য সংঘ: দ্বিতীয় পর্ব
গণনাট্য সংঘ সৃষ্টির পেছনে প্রধান কারণ ছিল ‘প্রগতি লেখক সংঘ বা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক সংঘের কার্যক্রম। প্রথমদিকে মুসোলিনীর ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রঁম্যা রলাঁর সঙ্গে যখন ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়, রলাঁ তখন মুসোলিনী এবং ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি খুলে দিয়েছিলেন। রলাঁর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের পর ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ জোরালো সমর্থন দেন। ভারতীয় তরুণরা তার দ্বারা উদ্দীপ্ত হন। বিলাতের সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ ও প্রগতিশীল তরুণ লেখকরা তখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। ঘটনাটা ভারতীয় ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুন্সি প্রেমচাঁদের নেতৃত্বে ১৯৩৬ সালে লখনউ শহরে সর্বভারতীয় লেখকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জন্ম নেয় প্রগতি লেখক সংঘ। ইতিমধ্যে হিটলারের উত্থান ঘটে, সুভাষ চন্দ্রের সঙ্গে তার সখ্যতা নিয়ে সাম্যবাদীদের সঙ্গে সুভাষ চন্দ্রের দলের বিরোধ আরম্ভ হয়। বিরাট ভুল বুঝাবুঝির ভিতর দিয়ে সাম্যবাদী দলের তরুণ লেখক সোমেন চন্দ উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় সুভাষ চন্দ্রের সমর্থক পঞ্চম বাহিনীর হাতে ছুরিকাঘাতে মারা গেলে শিল্প-সাহিত্যের জগত নাড়া খায়। প্রগতি লেখক সংঘ তখন “ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিল্পী সংঘ” নাম নিয়ে পঞ্চম বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রচার করাই তখন সংঘের মূল নীতি হয়ে দাঁড়ালো। পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আস্থা স্থাপন করা হলো। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক সংঘের গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। পরবর্তীতে অবশ্য পঞ্চম বাহিনীর সঙ্গে সাম্যবাদীদের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ভারতীয় গণনাট্যের কাজের প্রধান দুটি ধারার একটি ছিল নাটক আর অপরটি গণসঙ্গীত।

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অধীনে উনিশশো তেতাল্লিশ সালে পশ্চিমবঙ্গে যে নাট্যধারা আরম্ভ হয়েছিল তা পরবর্তীকালে সারা পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক আকার নিয়েছিল। চল্লিশের দশকে এবং তারপরেও যেখানেই সাধারণ মানুষ অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, সেখানেই গণনাট্য জনগণের সংগ্রামের পাশে ছিল। বাংলার কৃষক যখন তেভাগার দাবিতে ধানের মঞ্জুরী হাতে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, গণনাট্য তখন গেয়েছে তেভাগার গান। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিতে গণনাট্য হাহাকার করে কেঁদেছে, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা জাগাবার উদ্দেশ্যে মঞ্চের প্রতিটি আঙ্গিককে যুদ্ধযাত্রায় প্রস্তুত করেছে। আবার সাতচল্লিশ সালের পর স্বাধীন ভারতের বুকে শোষণ যখন নূতন রূপ পরিগ্রহ করেছে, তখন বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলার গণনাট্য নির্ভীকভাবে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বৃহত্তর ক্ষেত্রে জনগণের জন্য সংস্কৃতির এই বিরাট দায়িত্ব গণনাট্য গ্রহণ করেছিল বলেই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাম-মফঃস্বল শহর, রাজধানী সর্বত্রই এই মঞ্চকে মানুষ গ্রহণ করলো সাদরে। জনগণ সম্পৃক্ত হলো গণনাট্যের উদ্যোগের সাথে। মঞ্চান্দোলনে সাধারণ মানুষের যোগদান; এ ছিল সে যুগের এক অভূতপূর্ব দিক। শহর বা শহরতলীর শুধুমাত্র কিছু বোদ্ধা দর্শক নয়, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে সাধারণ জনগণের উৎসাহ ও উদ্দীপনা এর সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। যদিও প্রথম পর্বে মধ্যবিত্ত ও কৃষক আন্দোলন নিয়ে যতো নাটক রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে সে তুলনায় শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন নিয়ে রচিত ও মঞ্চায়িত নাটকের সংখ্যা ছিল কম। গণনাট্য কর্মীদের জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই। ভারত কৃষিপ্রধান দেশ, সুতরাং কৃষক আন্দোলনের ওপর রচিত নাটক ও তার প্রযোজনার সংখ্যা প্রথম পর্বে বেশিই হবে। সে কারণে গণনাট্য সংঘে প্রথম দিকে কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা নাটকগুলোই খুব সহজে সকলের নজর কেড়ে নেয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটি দুর্ভিক্ষের উপর রচিত হলেও সেখানে গ্রাম্য কৃষক জীবনই প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও জোতদারদের সাথে কৃষকদের বিরোধ নাটকের মূল দ্বন্দ্ব নয়।

ভারতবর্ষের কৃষক আন্দোলনের কয়েকটি স্মরণযোগ্য নাম তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ, সোনারপুর ও নকশালবাড়ি। বাংলাদেশের অন্তর্গত ময়মনসিংহের হাজং অঞ্চলে, রাজশাহীর নাচোলে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেইসব দীর্ঘকালীন কৃষক বিদ্রোহে শুধু জমিদার-জোতদার নয়, শাসকগোষ্ঠীরও ঘুম ছুটে গিয়েছিল। কৃষকদের তেভাগার সংগ্রামে প্রথম সারিতে এসে দাঁড়িয়েছিল ময়মনসিংহের হাজং চাষীরা এবং মালদহ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি জেলা আর দক্ষিণ বাংলার কাকদ্বীপ সোনারপুর ও ভাঙড়ের লক্ষলক্ষ বর্গাচাষী-ক্ষেতমজুররা। দক্ষিণ বাংলায় ভাগচাষী-ক্ষেতমজুরদের অভূতপূর্ব সংগ্রাম চলেছিল। গোটা চাষী সমাজই এই সংগ্রামে সামিল হয়েছিল। অধিকার রক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অবলীলাক্রমে রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়েছিল যদিও সরকারি শক্তির সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত তারা জয় লাভ করতে পারেনি। সেইসব আন্দোলনের কোনোটাই গণনাট্য সংঘের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সেইসব বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে ‘উদয়াস্ত’, ‘ডাক’, ‘তরঙ্গ’, ‘ঢেউ’, ‘এই মাটিতে’, ‘গায়েন’, ‘বাঘের খেলা’ নাটকগুলো। কৃষক বিদ্রোহের ওপর আর একটি স্মরণীয় নাটক ‘বিদ্রোহী বীর তিতুমীর’। কাকদ্বীপ, বুড়ুল, ভাঙড়, সোনারপুর, বড়-কমলাপুর, কোচবিহার তথা পশ্চিম বাংলার কৃষক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত হলো আরো বেশ কিছু নাটক। যেমন ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’, ‘নয়নপুর’, ‘আমার মাটি’, ‘আবাদ’, ‘দেবী গর্জন’ ইত্যাদি। উনিশশো বত্রিশ সালে মালদহ দিনাজপুরের সাঁওতাল কৃষকরা জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে তাদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম করে। সেই প্রেক্ষাপটে রচিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ।

স্বাধীনতা লাভের পর শাসক বদল হলেও কৃষক-সামন্ত প্রভু, কৃষক-পুলিশ, পুলিশ-সামন্তপ্রভু; এই সব সম্পর্ক আগের মতোই রয়ে গেল। জোড়া ডাঙ্গার কৃষকরা যখন তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে লড়াই আরম্ভ করলো পুলিশ তখন সামন্ত প্রভুদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলো। কৃষকরা তাতে বাধা দিয়েছিল এবং মানুষ নিহত হলো বহু সংখ্যায়। সেই ঘটনা নিয়ে অনিল ঘোষের নয়নপুর নাটক। জমির জন্য কৃষকদের লড়াইকে ভিত্তি করে লেখা হয় এই নাটক। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত বীরভূম জেলার পটভূমিতে আদিবাসী ও সাঁওতাল চাষীদের আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে দেবী গর্জন। উনিশশো পঞ্চাশ সালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করা হয়। অথচ দেখা গেল আইনের ফাঁক গলিয়ে জোতদার-জমিদাররাই কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। জমির জন্য কৃষকদের সেই সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে মনোরঞ্জন বিশ্বাসের ‘আমার মাটি’। গোবিন্দ চক্রবর্তীর ‘আবাদ’ নাটকেও জোতদারদের বিরুদ্ধে চাষী সম্প্রদায়ের সংগ্রাম বিবৃত হয়েছে। বাংলার এ সময়কার কৃষক বিদ্রোহের ওপর আরো প্রচুর নাটক লেখা হয় যার মধ্যে রয়েছে ‘মেঘ কাটার পালা’, ‘খাদ্যচোর’, ‘ফেরার’, ‘পাকা ধানের বাস’, ‘শঙ্খচূড়’ ইত্যাদি। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশত্যাগী উদ্বাস্তু জীবনের ওপর রচিত হয়, ‘বাস্তুভিটা’, ‘নতুন ইহুদি’, ‘দলিল’, ‘গোত্রান্তর’, ‘আজকাল’, ‘ভাঙ্গাবন্দর’ নাটকগুলি।

পরবর্তীকালে মূলত জোরটা বেশি দেখা যায় শ্রমিক আন্দোলনের দিকেই। শ্রমিক চরিত্র এবং শ্রমিকদের জীবন নিয়ে নাটক লেখা বৃদ্ধি পায় স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতার পূর্বে ভারতের জনগণের সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বটাই ছিল প্রধান। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শ্রমিকশ্রেণী ও বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। এই সময় থেকেই শ্রমিকশ্রেণী এবং শ্রমজীবী জনগণের উপর বুর্জোয়াদের চাপিয়ে দেওয়া নির্মম শোষণের দিকে বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি পড়ে। নাট্যকাররা শ্রমিকদের নিয়ে বেশি বেশি নাটক লিখতে আরম্ভ করেন। ছাঁটাই বিরোধী ধর্মঘট, মালিকের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিয়ে ধর্মঘট যেমন নাট্যরচনা ও প্রযোজনায় প্রাধান্য পেল, তেমনি মালিকদের শ্রেণীচরিত্রকে নগ্ন করে তোলা হলো যাতে তাদের বিরুদ্ধে দর্শকের শ্রেণীঘৃণা জাগ্রত করা যায়। শ্রমিকশ্রেণীকে নিয়ে অমর গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন ‘দ্বান্দ্বিক’ এবং মমতাজ আহমেদ খাঁ ও রণেন ঘোষ দস্তিদার রচনা করেন ‘ইস্পাত’। ধর্মঘট চলার সময় শ্রমিকদের দুরবস্থা এবং তার জন্য তাদের হতাশা, অন্নের জন্য হাহাকার ইস্পাত নাটকে এবং কিছুটা দ্বান্দ্বিক নাটকেও প্রধান হয়ে উঠেছে। ধর্মঘট হলে শ্রমিকরা দাঁতে দাঁত দিয়ে কী কষ্টের ভিতর লড়াই করে তাই এ নাটক দুটিতে ফুটে উঠেছে।

মার্কসীয় বিশ্বাসে শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত সংগ্রাম ক্রমশই রাজনৈতিক সংগ্রামের চেহারা নেয়, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয়। শ্রমিকশ্রেণীর এই বৈশিষ্ট্যসূচক দিক নিয়ে বাংলার গণনাট্য যে কয়টি নাটক মঞ্চস্থ করেছে তার মধ্যে বাসুদেব বসুর ‘মুক্তির অন্তরালে’ একটি। মুক্তির অন্তরালে নাটকে শ্রমিকশ্রেণীর সচেতন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অতি উচ্চ গুণমানে প্রকাশিত হয়েছে। নাটকটির বিষয়বস্তু কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট সরকারকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক শ্রমিক-গণ আন্দোলন। উনিশশো পঁয়ষট্টি-ছিষট্টি সালে দুর্গাপুরে শ্রমিকশ্রেণী খাদ্য, বন্দীমুক্তি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে বিরাট আন্দোলন করে দিলীপ ঘোষালের ‘আগুন রাঙ্গা ইস্পাত’ নাটকে তারই এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনায় ইস্পাত কারখানার কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও প্রশাসন একযোগে শ্রমিকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চলে গ্রেপ্তার, গুলি, ঘোষিত হয় কারফিউ, চারদিকে নেমে আসে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এই লৌহ কঠিন বেড়াজালের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী গোপনে ও প্রকাশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলে। শাসকশ্রেণী সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করে জয়ী হয়। শ্রমিকদের পরাজয় সত্ত্বেও তাদের উদ্দীপক কার্যকলাপ ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি এ নাটকে মূর্ত হয়েছে।

বীরু মুখোপাধ্যায়ের ‘আঁতাত’ নাটকে দেখানো হয়েছে শ্রমিক আন্দোলনের চেহারা। নাটকে ফুটে উঠেছে ধনিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বহারাশ্রেণীর সংগ্রাম। শ্রমিকশ্রেণীকে নিয়ে লেখা অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘কিমলিস’, ‘আলোয় ফেরা’, ‘লেবার অফিসার’, ‘ফুলের রঙ লাল’, ‘ছাঁটাই’ ইত্যাদি নাটক। বস্তি জীবনের লাঞ্ছনা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সেই সাথে বস্তি উচ্ছেদের চক্রান্তের প্রতিরোধের ওপর রচিত নাটক ‘পূর্ণগ্রাস’, ‘ভাঙাগড়ার খেলা’। বিচারের নামে প্রহসনের নাটক ‘বিচার’। তন্তুবায় বিদ্রোহের নাটক ‘চন্দনডাঙার হাট’। ব্যবসায়িক প্রলোভনের ঊর্দ্ধে ওঠার ডাক রয়েছে ‘নাট্যকার’-এ। জীবন যন্ত্রণা, পিছুটান, অন্ধ সংস্কার, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ মাড়িয়ে সুস্থ সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী নাটক ‘গাঙ্গুলী মশাই’, ‘নবজন্ম’, ‘ইংগিত’, ‘কিম্বদন্তী’, ‘নাটক নয়’, ‘পান্থশালা’, ‘নীলদরিয়া’ প্রভৃতি। ফ্যাসীবাদী সন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্রের স্বরূপ উদঘাটনের নাটক ‘পাগলাঘণ্টা’, ‘রক্তে ধোয়া দিন’, ‘পথ’, ‘সমুদ্র মন্থন’। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘মড়া’, ‘নয়াবসতে’ ইত্যাদি। ফ্যাসিস্তদের হাতে নিহত চেক নেতার অমর কাহিনী ‘জুলিয়াস ফুচিক’, আইসেন হওয়ারের নির্দেশে ইলেকট্রিক চেয়ারে নিহত আমেরিকার বৈজ্ঞানিক দম্পতি জুলিয়াস ও এথেল রোজেনবার্গের শেষ জীবন নিয়ে লেখা ‘বিশে জুন’। লেনিন ও স্তালিনকে নিয়ে লেখা হয়েছে ‘মহানায়ক কমরেড লেনিন’, ‘জোসেফ স্তালিন’, ‘ইস্পাতের ফলা’। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ওপর ‘অক্টোবর বিপ্লব’, ‘আহ্বান’, ‘বিপ্লব’। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সম্পর্কিত একটি উৎকৃষ্ট নাটক ‘পাণ্ডুলিপি’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালো মানুষদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও তথাকথিত মুক্ত গণতন্ত্রের প্রহসনকে আখ্যান করে মঞ্চায়িত হয় ‘পশ্চিম স্বর্গ’ ও ‘মৃত্যুহীন’। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ‘ভিয়েতনাম’, ‘ভিয়েতনাম ক্যাম্পেসিনো’। এভাবেই গণনাট্য গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত তার কর্মধারা ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল নাটকের একমাত্র লক্ষ্য। উদ্দেশ্যহীন নাটক তারা করেনি। সরাসরি কৃষক শ্রমিকের পক্ষে এবং সমাজতন্ত্র প্রচারের জন্য নাটক করেছে অর্থাৎ মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রচার করেছে নাটকের মধ্য দিয়ে।

গণনাট্যের আলোচিত এই নাট্য আন্দোলন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে শ্লোগানধর্মী। সেখানে রাজনীতি থাকলেও নাটকীয় উপাদানের অভাব ছিল। গণনাট্যের এ নাটকগুলো মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও তার মধ্যে সমাজ বিশ্লেষণ ছিল খুবই কম। গণনাট্য আন্দোলনের প্রচুর দুর্বলতা ছিল। গণনাট্য সংঘে সৃজনশীল প্রতিভার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। ক্রমে গণনাট্য সংঘের অধিকাংশ অনুষ্ঠান রূপরীতিহীন বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে থাকে। গণনাট্য আন্দোলনের গোড়ার দিকের নাটকে প্রগতিশীল কথাবার্তা থাকলেও বৈপ্লবিক দিক থেকে নাটকগুলি ছিল নিম্নমানের। গণনাট্যের নাটক সম্পর্কে তাই অনিল দে বিতর্ক তুলেছেন, ‘এ নিয়ে কখনও আমরা প্রশ্ন তুলিনি যে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের কৌশল বা দলিলের আংশিক প্রকাশ থাকলেই সেটিকে প্রগতিশীল নাটক বলা যাবে কি না।’ তিনি বলেন, আর এই দ্বিধাই আমাদের থিয়েটারে রাজনৈতিক নাটকের সংজ্ঞা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে অক্ষম হয়েছে। তিনি আরো লিখছেন, ‘গণনাট্য সংঘ ষাটের দশকে কিংবা পরবর্তীকালে এমন কোনো প্রযোজনা দর্শকের সামনে উপস্থিত করতে পারেনি; যা প্রগতিশীল হলেও দর্শকের বিপুল অনুমোদন লাভ করেনি।’ তিনি বলছেন, এর কারণ সম্ভবত ‘রাজনৈতিক নাটক’ নামে যে নাটকগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো যথার্থ অর্থে রাজনৈতিক নাটক ছিল না, সেগুলো ছিল প্রচারমূলক এক ধরনের সংকীর্ণ নাট্যভঙ্গি।

সন্দেহ নেই গণনাট্য সংঘের নাটক একসময় পশ্চিমবাংলার গ্রাম-গঞ্জ মাতিয়ে তুলেছিল। বিরাট সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু তলিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সংঘের নাটকে কিছুটা বৈচিত্র্যের অভাব ছিলই। মানুষের প্রাণের কথা বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু মানুষের ‘প্রাণের কথা’র জগৎটা অনেক বড়, তার সবটা সংঘের রাজনৈতিক নাট্যে প্রতিফলিত হয়নি। যেটুকু প্রতিফলিত হয়েছে সেটুকুও নিতান্ত প্রয়োজনীয় একটি অংশ মাত্র। গণনাট্যের নাটকে সবসময়ই ঐশ্বর্যের অভাব ছিল। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, প্রাত্যহিক প্রয়োজনের স্থূলতার মধ্যে যে বোধবুদ্ধি সীমাবদ্ধ তার ভূমিকা সংকীর্ণ। এই বৈচিত্র্যহীন সংকীর্ণতা গণনাট্যের রাজনৈতিক নাটকে সর্বদাই ছিল, বিচার করে দেখলে সে সত্য সকলের চোখেই ধরা পড়বে। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংগ্রামটা যে-সকল মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ, সেই সকল মানুষরা বৈচিত্র্যমণ্ডিত হয়ে সামগ্রিকভাবে গণনাট্যের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রতিফলিত হয়নি। গণনাট্যের নাটকের বৈচিত্র্যহীনতার প্রশ্নে হীরেন ভট্টাচার্য চমৎকার একটি প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘খেটে খাওয়া মানুষের বাস্তব লড়াইয়ের পাশে নাটককে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন বহু নাট্যকার কলম ধরেছেন এবং সংগ্রামী ঘটনা-ভিত্তিক প্রচুর নাটক যথাসাধ্য লিখে গেছেন, তখন তাঁদের নাটকের বৈচিত্র্যহীনতার জন্য আক্ষেপ করা যেতে পারে কিন্তু ঐ অবস্থায় নাটক না লিখে এবং সর্বহারার সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করাটা কি সঠিক হতো?’ কথাটা একদিকে সমর্থন করা গেলেও, পরবর্তীকালে হীরেন ভট্টাচার্য নিজে সেসব দুর্বলতা নিয়ে বই লিখেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, শেষ বিচারে নাটক যদি নাটক না হয়ে উঠতে পারে, জনমনে সেরকম দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারে না।

ইতিহাসে ভুরি ভুরি চিরায়ত নাটক লেখা কখনই কোনো সমাজে সম্ভব হয়নি এবং গণনাট্যের নাট্যকারের মেধা না থাকলে কী করা যাবে! কিন্তু জনগণের-সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম থেকে তাঁরা তো দূরে সরে থাকেননি। গণনাট্যের বাইরে বহু প্রতিভাবান নাট্যকারই তা করেছেন, নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে সর্বহারার সংগ্রাম থেকে দূরে সরে ছিলেন। গণনাট্যের শত ত্রুটি সত্ত্বেও বলতে হয়, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিল্প বা নাট্যধারা তৈরি করাও একটা বিরাট রাজনৈতিক সংগ্রাম; সে বিচারে গণনাট্য সংঘের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। গণনাট্য আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের ভিত্তি স্বরূপ। গণনাট্যের রাজনৈতিক নাটকগুলি তার শত ত্রুটি সত্ত্বেও, শোষিত মানুষের আকাঙ্ক্ষিত প্রাণের কথাটি মঞ্চে তুলে ধরতে পেরেছে। কাজেই রাজনৈতিক নাটকগুলি বহুদিন ধরে একই কথা বলে গেলেও সে নাটক দেখার জন্য মানুষের ভীড় কখনও কমেনি। ‘মানুষের প্রাণের কথা’ ব্যাপারটা এমন যে তা কখনও বৈচিত্র্য হারায় না। প্রাণের কথা, তা সে ব্যক্তিগত বা সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক যাই হোক না কেন বৈচিত্র্যহীন হয়েও তা গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে তা খুব কার্যকরী নয় বারবার সেটা প্রমাণিত হয়েছে। গণনাট্য সংঘের নাটকের মূল দুর্বলতা, সৃজনশীলতা সেখানে ছিল না।

মার্কসবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে গণনাট্যের নাটক রীতিমত চর্বিতচর্বণ হয়ে উঠেছিল। বারবার একই ধরনের ঘটনা, গল্প, সংলাপ ও একইরকম বক্তব্য ঘুরেফিরে আসছিল এবং প্রচারটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্লোগনধর্মী আর উচ্চকিত। রাজনৈতিক নাটকের মূল লক্ষ্য মার্কসবাদ প্রচার তা নিয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। সে প্রচারের অর্থ এ নয় নাটকে কতোগুলো শ্লোগান জুড়ে দেয়া, কিংবা মার্কসের তত্ত্বগুলো সব নাটকে আওড়ে যাওয়া। রাজনৈতিক ঘটনাবলী সর্বক্ষেত্রেই ক্ষমতা দখল কিংবা দখলের পর তা অধিকারে রাখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয়। এই ঘটনাবলীকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ না করলে নাট্যকার তার সিদ্ধান্তে একপেশে হয়ে পড়েন, যার ফলশ্রুতিতে সত্যের বিকৃতি ঘটে। বিকৃত সত্য কখনই সমাজের তথা মানুষের কোনো উপকারে আসে না। নাট্যকারকে নিরাসক্তভাবেই সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হয়, তা না হলে প্রায়শই দর্শকদের ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হবার, অন্ধকারে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। মার্কসবাদের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিকশ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হবে।

শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলকে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় গণনাট্য দলগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। গণনাট্য সংঘের স্থানীয় দলগুলি খুব গুরুত্বের সাথেই জনগণকে বোঝাচ্ছিলো প্রচলিত সমাজ কেন ক্ষতিকর, কেন তার বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার। কিন্তু শোষণ ব্যবস্থার সামগ্রিক চেহারাটা সব নাটকে ঠিকভাবে আসছিল না। বেশির ভাগ নাটকেই শোষণের বাইরের রূপটা দেখা যাচ্ছিলো বটে, তার ভেতরের দ্বান্দ্বিক রূপটা ধরা পড়ছিল না। চীনের গণনাট্যে সম্পর্কে মাও সেতুঙ একই মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেন, চীনের নাট্য রচনায় আমি দেখছি রাজনৈতিক দিকটিই এখন অধিকতর সমস্যা। শ্রেণী সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। কিছু কমরেডের প্রাথমিক রাজনৈতিক জ্ঞানেরই অভাব রয়েছে এবং এর ফলেই নাট্যরচনায় নানারকমের ভ্রান্ত ধারণা দেখা দিচ্ছে। খুব পরিষ্কারভাবে সমাজ-ইতিহাসের নানা দ্বন্দ্বগুলি ধরতে না পারলে, বিপ্লবী বা রাজনৈতিক নাটক লেখা সম্ভব নয়।

মাও সেতুঙের মতে ‘শিল্প-সমালোচনা একটি জটিল প্রশ্ন, তার জন্য বিশেষ ধরনের প্রচুর অধ্যয়নের প্রয়োজন’। তিনি লিখছেন, ‘শিল্প-সমালোচনার ক্ষেত্রে বিচারের দুটি মানদণ্ড রয়েছে; একটি রাজনৈতিক মানদণ্ড, অন্যটি হচ্ছে শিল্পগত মানদণ্ড’। মাও বলেন, বিমূর্ত ও একান্ত অপরিবর্তনীয় একটি মানদ- আছে বলে আমি মনে করি না। রাজনৈতিক মানদণ্ড ও শিল্পগত মানদণ্ড; এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা কী? মাও এ সম্পর্কে বলেন, সবসময় রাজনীতি ও শিল্পের মধ্যে একটি ঐক্য তৈরি করা দরকার। বিষয়বস্তু এবং সর্ব্বোচ্চ সম্ভব নিখুঁত শিল্পগত আঙ্গিকের মধ্যকার ঐক্য। যেসব শিল্পগত রচনায় শিল্পগুণের অভাব রয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে যতো প্রগতিশীলই হোক না কেন তা হয়ে পড়ে শক্তিহীন। সুতরাং ভুল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন শিল্প সৃষ্টির প্রবণতার আমরা যেমন বিরোধিতা করি, তেমনি পোস্টার ও শ্লোগানের কায়দায় শিল্পসৃষ্টির প্রবণতা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তাতে শিল্পগত শক্তির অভাব থাকলে আমরা তার বিরোধিতা করি। চলবে