রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা: নানা বিভ্রান্তি
পর্ব ৩
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২০
গণনাট্য সংঘ: প্রথম পর্ব
বিশের দশকে যে রাজনৈতিক নাট্যধারা জন্ম নিতে দেখি জার্মানী ও সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং ত্রিশের দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে , সেই একই রাজনৈতিক নাট্যধারা চল্লিশের দশকে জন্ম নেয় ভারতে। ভারতে এই নাট্যধারা পরিচিত ছিল গণনাট্য হিসাবে। গণনাট্য প্রথম থেকেই মনে করতো থিয়েটারের কাজটা আপাদমস্তক মতাদর্শগত। যুক্তরাষ্ট্রে ত্রিশের দশকে যেভাবে দুর্ভিক্ষ বা অর্থনৈতিক মন্দা ও ফ্যাসিবাদের উত্থানকে ঘিরে স্বাধীন থিয়েটারগুলি এবং ‘গ্রুপ থিয়েটার’ জন্ম নেয়, ভারতে তেমনি সেই একইভাবে চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা ও দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয় গণনাট্য সংঘ। দুটো আন্দোলন গড়ে উঠবার প্রাথমিক কারণ বা প্রেক্ষাপট প্রায় একই ছিল, তা সত্ত্বেও দুটোর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন থিয়েটারগুলো মূলত গড়ে উঠেছিল সে সময়কার পেশাদার বাণিজ্যিক থিয়েটারের বিকল্প হিসাবে। বিশেষ করে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ গঠনে মূল লক্ষ্য ছিল পেশাদার মঞ্চের স্টার সিস্টেমের বা তারকা প্রথার বিকল্প ধারা তৈরি করা। গ্রুপ থিয়েটার সহ স্বাধীন থিয়েটারগুলোও ছিল পেশাদার দল। কিছু শ্রমিক সংগঠনের ছিল প্রচারমুখী-অপেশাদার নাট্যদল। শুধু পূর্বের পেশাদার দলগুলো থেকে তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উন্নত ও ভিন্ন। ভারতের গণনাট্য সংঘ কোনো পেশাদার নাট্যদল ছিল না। ছিল মার্কসবাদী দলের সাংস্কৃতিক সংগঠন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ যেহেতু মার্কসবাদী দলের সংগঠন, মার্কসবাদের লক্ষ্য যেহেতু সমাজ পরিবর্তন, সেহেতু সমাজ পরিবর্তন না ঘটা পর্যন্ত কিংবা সমাজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদে না পৌঁছানো পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলন থেমে যেতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মার্কসবাদী শ্রমিকশ্রেণীর নাটকের নানান ত্রুটি গণনাট্য সংঘেও ঠিক একইভাবে ধরা পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্তের জঙ্গী থিয়েটারের পাশাপাশি ছিল শ্রমিকশ্রেণীর নাট্য দলগুলি। সেখানে নাটক নিয়ে যতোটা হৈ চৈ হয়েছে, নাটককে যতোটা যুদ্ধংদেহী করা হয়েছে, নান্দনিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। নাটকগুলি নাটক না হয়ে, দলের পক্ষে সমাজতন্ত্রের পক্ষে প্রচারণা আর শ্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গণনাট্য সংঘের নাটকের ক্ষেত্রে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটিই কমবেশি ধরা পড়বে।
গণনাট্য সংঘ যখন জন্ম নেয় সে সময়টা ছিল ভারতের রাজনীতির এক বিশেষ পর্ব। বিশেষ করে বাংলার জন্য বিশ শতকের চল্লিশের দশক সত্যিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একেবারে ঢুকে পড়লো ভারতের ঘরের ভিতর। যুদ্ধে মদমত্ত সৈনিকদের সবুট পদের আস্ফালনে ভারতের ভূমি কম্পমান। যুদ্ধের রসদ যোগাতে গিয়ে ব্রিটিশ ভারতের শস্যভাণ্ডার শেষ। যুদ্ধকে ঘিরে ব্রিটিশ শাসকদের বিভিন্ন ভূমিকা এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিল। বিবেকশূন্য মুনাফাখোর, মজুতদার, চোরাকারবারিরা ব্রিটিশ সরকারের বাহিনীকে খাদ্য জোগাতে সাহায্য করে টাকার পাহাড় বানালো আর সাধারণ মানুষের জন্য বয়ে আনলো দুর্ভিক্ষ-অভাব-অনটন। মানুষের সৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষ যা পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে চিহ্নিত, সেই মন্বন্তরে বাংলাদেশের পনের লক্ষ দরিদ্র নর-নারী সর্বনাশের সম্মুখীন হয়েছিল। বাংলার পেশাদার নাট্যমঞ্চে এর কোনো চিত্রই ধরা পড়েনি। বাংলার পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা পড়ছে মন্বন্তরে। সে ব্যাপারে পেশাদার নাট্যশালা ছিল সম্পূর্ণ নীরব। পেশাদার নাট্যশালায় তার কোনো প্রতিধ্বনি নেই। পেশাদার থিয়েটার তখনও গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পুরানো চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছুতেই সে চক্র ভেঙে বের হয়ে আসতে পারছে না। মিলনায়তনের বাইরের জগতটাকে যেন সে দেখতেই চাইছে না, পুরানো চিন্তার মধ্যেই বুঁদ হয়ে আছে।
ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে কলকাতার পেশাদার নাট্যশালার সঙ্গে জীবন ও সমাজের বাস্তব কোনো সম্পর্ক ছিল না। সস্তা ভাববিলাসী নাটক কিংবা ধর্মাশ্রিত নাটক রচনা ও মঞ্চায়নে তখনও তারা ব্যস্ত। সারা দেশের সংগ্রামের ঘটনা মঞ্চে আনার আগ্রহ কারোরই ছিল না। শ্রেণীসংগ্রাম বা সমাজতন্ত্র কিংবা ফ্যাসিবাদ এসব প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহা, স্বাধীনতার জন্য জনগণের লড়াই; এসব ঘটনা থেকেও নাটক তখন মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। যখন বহুজন বলেন, ‘নাটক পেশাদার হলেই নাটকের মান বাড়বে’ সেটা যে কতো বড় ভুল ধারণা সেটা প্রমাণ করে কলকাতার পেশাদার মঞ্চ। ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার মঞ্চে সেই একইরকম ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। ফলে পুরানো পেশাদার থিয়েটারের বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছিল নতুন ধরনের থিয়েটার। কলকাতার ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছিল। কলকাতায় পেশাদার থিয়েটারে দর্শক তখন কমে গেছে, দর্শকদের টেনে আনবার জন্য দলগুলো কোনো চিন্তা উদ্ভাবন করতে পারছে না। যেন নতুন এক থিয়েটারকে জায়গা করে দেবার জন্য ইতিহাস এ অনিবার্যতাকে সৃষ্টি করেছে। ফলে চুয়াল্লিশ সালে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের জড়তা, পৌনঃপুনিকতা আর স্থূলতাকে ভাঙার জন্য গণনাট্যের জন্ম। গতানুগতিক পেশাদার মঞ্চের আওতার মধ্যে থেকেই তার সংস্কারের প্রচেষ্টায় গণনাট্যের উদ্ভব নয়, তার উদ্ভব হয়েছে সমাজ মানুষের এক রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘকে কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠী ভাবলে ভুল করা হবে। চল্লিশের দশকে এটা গড়ে ওঠে এক সর্বভারতীয় নয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন রূপে। আসমুদ্র হিমাচল এতে আলোড়িত হয়। এর ব্যাপ্তি ছিল কাশ্মীর থেকে কন্যা কুমারিকা, গুজরাট থেকে মনিপুর পর্যন্ত। যদিও বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে ব্যাপকতা লাভ করেছিল এ আন্দোলন। চল্লিশোত্তর গণনাট্য আন্দোলন গড়ে উঠবার কালে বলা হয়েছিল বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারকে চার দেয়ালে আবদ্ধ রাখা হবে না। গণমানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে নাট্যশিল্প কিংবা সকল ধরনের শিল্পচর্চাকে। নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যেও স্থান পেল কৃষক-শ্রমিক কিংবা মেহনতী মানুষের জীবন ও সংগ্রাম। গণনাট্যের বিষয়বস্তু সংক্রান্ত নির্দেশগুলি থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল গণনাট্যের মূল দর্শক হবে শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য মেহনতী শ্রেণীগুলি। লক্ষ-কোটি মেহনতী মানুষের উম্মুক্ত অঙ্গনে নাট্যকর্ম ছড়িয়ে দেওয়াই হবে এর আদর্শ। স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী যুগে গণনাট্যই হলো সেই ধারা, যা কলকাতা শহরে আটকে থাকতে চায়নি। গণনাট্যকে ঘিরে বাংলা থিয়েটারে আবার হলো পালাবদল। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের গণ্ডি ভেঙে গণনাট্য আন্দোলনের দর্শক হলেন লক্ষলক্ষ শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী।
চল্লিশের দশকের গোড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন চলছিল। সেই সময় দেশ রক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল গণনাট্য আন্দোলন। গণনাট্য মানেই প্রগতিশীল নাটক। বিষয়বস্তুর মধ্যে শ্রমিক-ধর্মঘট, কৃষকের ভূমি ও ফসলের লড়াই, পঞ্চায়েত নির্বাচন, গণ সাক্ষরতা, নারীর অধিকারের সংগ্রাম, শ্রমিক কর্মচারীদের সংগ্রাম এ সবই ছিল। মতাদর্শগত সংঘাত সংগ্রামের কথাও থাকতো, পশ্চাদপদতার বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরও দেখা মিলতো। গ্রাম নগরের নয় কোটি দর্শকদের হৃদয় জয় করতেই গণনাট্য আন্দোলন। শুধু হৃদয় জয় করাটাই মুখ্য নয়, গণনাট্য আন্দোলনে পূর্ববর্তী যুগের সামন্তসমাজের বিরোধিতা, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা প্রভৃতি প্রগতিশীল সারবস্তু আরো তীক্ষ্ণ আরো তাৎপর্যময় হয়ে দেখা দিয়েছিল। গণনাট্য সংঘ ফ্যাসিবাদ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, স্বদেশি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও মন্বন্তর বিরোধী নাট্য অভিযান শুরু করে। যেমন, ব্যক্তিগত মানুষের স্থানে শ্রেণীগত মানুষের অবতারণা, বঞ্চিত, বুভুক্ষু, শ্রীহীন মানুষকে নিয়েই নাটক রচনা, সংঘবদ্ধ মানুষের প্রতিরোধ, সংগ্রামী মানুষের অন্তিম জয়, যেগুলির মধ্যে প্রগতিবাদী, মানবমুক্তিকামী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আছে।
গণনাট্য সংঘ কখনই সমকালীন সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করেনি। গণনাট্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাবলী জনগণের সামনে উপস্থাপন করে দেশবাসীর ব্রিটিশ বিরোধী, ফ্যাসিবিরোধী মানসিকতাকে জাগরূক করে দিতে বদ্ধপরিকর হলো। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, অত্যাচারীর মুখোশ খুলে ধরা, মুনাফাখোর, মজুতদারের বদমায়েসি প্রকাশ করা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক অবক্ষয়ের পরিণাম এবং এর সঙ্গে মুক্তিকামী মানুষের জীবন সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও বাঁচার লড়াইকে সামনে এনে মানুষের মুক্তি ও শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের উপস্থিত সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তোলা; এই ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সকল সাংস্কৃতিক কাজের অনুপ্রেরণা। কৃষক জীবন, শ্রমিক জীবন, অবহেলিত শোষিত সাধারণ মানবজীবন ও মধ্যবিত্ত ও নিুমধ্যবিত্ত সমাজ; এগুলিই তার সব বঞ্চনা ও শোষণ নিয়ে মঞ্চে হাজির হলো। চল্লিশ দশকে এবং তারপরেও যেখানেই সাধারণ মানুষ অত্যাচার আর অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, সেখানেই গণনাট্য জনগণের সংগ্রামের পাশে থেকেছে। গণনাট্যের মাধ্যমেই মার্কসবাদের প্রসার ও প্রচার শুরু হলো গ্রামে গঞ্জে খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আবির্ভাব শ্রমজীবী মানুষের মুক্তিকে লক্ষ্যে রেখেই সংগঠিত হয়েছিল, যা রাজনৈতিক নাটকের গণমুখীনতার দিকটিকে বাস্তবায়িত করলো নানা ধরনের নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা যেমন শুরু হলো নাট্যরচনা ও প্রযোজনায়, তেমনি দেশের সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাদপদতা, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের, শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের সংগ্রামী জীবন চেতনাকে উন্নীত করে তোলা হলো। শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য সংহতি তার শ্রেণীশক্রকে চিহ্নিত করতে শুরু করলো।
গণনাট্যের প্রথম পর্বের তিনটি নাট্য ‘আগুন’,‘ ল্যাবরেটরী’, ‘জবানবন্দী’; এই নাট্যত্রয়ীতে চালের সঙ্কট, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা ও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রশ্নটি গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কথাও বলা হয়েছিল। জবানবন্দীর সাথে একই দিনে মঞ্চস্থ হয় ‘হোমিওপ্যাথি’ নাটকটি। উনিশশো উনচল্লিশ সাল থেকে ছিচল্লিশ সাল পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জীবনে খাদ্যের অভাব এবং ক্ষুধার জ্বালা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং নৈরাজ্যবাদের মধ্যে অবস্থিত আত্মার ক্রন্দন, দিগন্ত থেকে দিগন্তে ব্যাপ্ত মানবতার অপমান; গণনাটকের প্রথমপর্ব যেন তাকেই অবলম্বন করে আগাতে চাইলো। গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ বিজন ভট্টাচার্য লিখলেন আগুন নাটকটি; দুর্ভিক্ষের উপর নকসা জাতীয় নাটক। বিনয় ঘোষ লিখলেন ল্যাবরেটরী, মহর্ষি মনোরঞ্জন লিখলেন হোমিওপ্যাথি। তিনটিই ছিল ক্ষুদ্র, নাটক না বলে নাটিকা বলাই ভালো। দিগিন্দ্র চন্দ্র লিখেছেন, জবানবন্দী নাটকটি সবিশেষ প্রশংসিত হয় এবং এই জবানবন্দী থেকেই নাটক লেখার হাত খোলে বিজনের। বাস্তববাদী নাটকের যাত্রা শুরু বিজনের এই নাটিকা থেকেই। এই নাটিকার অভিনয়ই বাংলার নাট্যধারাকে নতুন পথে চলার ইঙ্গিত দেয়। গঙ্গাপদ বসু, সুধী প্রধান, জলদ চট্টোপাধ্যায়, রানী চক্রবর্তী, তৃপ্তি ভদিুড়ী এই নাটকটিতে অভিনয় করেন। জবানবন্দী নাটিকার পূর্ণাঙ্গ রূপ নবান্ন, জবানবন্দীর প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই ‘নবান্ন’ লিখলেন বিজন ভট্টাচার্য। নবান্নে আর ইঙ্গিত নয়, বাংলা নাটক কোন পথ ধরে আগাবে, প্রকৃতপক্ষে তারই সূচনা ঘটলো এ নাটকে।
বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে জবানবন্দী নাটকের বিষয়বস্তুকে মূল্যায়ন করা কঠিন হবে। মনে হবে এরকম বিষয়বস্তু তো হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু না, আগুন এবং জবানবন্দী নাটক থেকেই এই ধরনের বিষয়বস্তুর বাংলা নাটকে আবির্ভাব ঘটে। স্বাভাবিকবাদী কিংবা বাস্তববাদী নাট্য রচনার শুরু হলো বাংলা নাটকে। বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নবান্ন নাটকের প্রকাশ এবং অভিনয় একটি যুগান্তকারী ঘটনা। নবান্ন নাটকের সৃষ্টির প্রেরণা ও অভিনয়ের উদ্যোগের মধ্যেই রয়েছে নতুন ভাবনা। ধনী বাঙালীর সখের প্রয়োজনে নাটক এসেছে বাংলায়। পরবর্তীকালে জনপ্রিয় এই মনোরঞ্জন পদ্ধতিটি মুনাফা লাভের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বহুদিন পর্যন্ত বাংলায় নাটক লেখা অভিনয় করা; দুটোই এক বিশেষ নাটকীয় ঢঙের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথই সেখানে স্বতন্ত্র ছিলেন। কিন্তু নবান্ন লেখা ও প্রযোজনার উৎসমূলে দেখা গেল পুরানো নাটকীয় ঢংটি কাজ করেনি। একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নাটকটি রচিত ও অভিনীত হয়েছে, বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এরকম ঘটনা আগে ঘটেনি। ব্যক্তিগত মালিকানা নয়, ব্যবসায়িক পদ্ধতিতেও নয়; নবান্ন নাটকটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এলো। ফলে বাংলা নাট্যকর্মে মৌল পরিবর্তন ঘটে গেল। নবান্নের বিষয়বস্তুটাই ছিল অভিনব। বহুকাল বাংলা রঙ্গমঞ্চে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক বা সামাজিক নাটকের সৌখিন বা পেশাদারী অভিনয় চলছিল। গণনাট্য সেখানে নতুন ধারার উদ্বোধন করলো। নাটকের মধ্য দিয়ে শ্রেণীসচেতন সমাজ বিশ্লেষণ এবং প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ঘোষণা গণনাট্য সঙ্ঘ করতে চেয়েছিল। বিজন ভট্টাচার্য তারই ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে নাটক রচনায় কলম ধরলেন। ভাববাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে বস্তুবাদী সমষ্টি চেতনায় উত্তরণই তার নাট্য রচনার মূল প্রেরণা তা তিনি স্বীকার করেছেন। নবান্ন নাটকের চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যুগান্তকারী কাজ হলো, বাংলা নাটক থেকে নায়ক চরিত্রের অপসারণ। নাট্য সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, কোনো একটি বিশেষ চরিত্রের পরিবর্তে সমগ্র জনতাই নায়কের পদে উন্নীত হয়েছে।
নবান্ন নাটক বাংলা নাটক থেকে তারকা পূজা বা শুধুমাত্র নায়কের মাহাত্ম প্রচারকে বিদায় দিয়েছিল। সাজসজ্জা ও রূপসজ্জায় একেবারে জীবন্ত দুর্ভিক্ষের মানুষগুলি মঞ্চে উঠে এসেছিল। পেশাদারী মঞ্চে যে শিশির ভাদুড়ী সাজ ও রূপসজ্জায় বাস্তব নিষ্ঠার পরিচয় দিতেন, তিনিও স্বীকার করেছেন তাঁর কোনো অভিনেতা অভিনেত্রী এমন সাজে মঞ্চে নামতে রাজি হতেন না এবং সর্বোপরি ব্যবসায়িক মঞ্চে এমন সাজ ও রূপসজ্জা চলবেই না। নবান্ন নাটকে সকলেরই অভিনয় ছিল বাস্তবসম্মত এবং সাবলীল। নাটকীয়ধর্মী অভিনয় এবং আবেগের বাড়াবাড়িকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। পেশাদারী মঞ্চে অভিনেত্রী অনেকদিন আগেই গৃহীত হলেও, সেখানে ভদ্রগৃহস্থ ঘরের লেখাপড়া জানা মেয়েরা অভিনয়ে অংশ নেয়নি। উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ এবং অন্য দু-একজন এর আগেই বাড়ির মেয়েদের দিয়েই অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন; কিন্তু পেশাদারী নয়, সৌখিন অভিনয়। গণনাট্য সঙ্ঘই প্রথম লেখাপড়া জানা ঘরোয়া মেয়েদের মঞ্চের অভিনয়ে নিয়ে আসে। পরে অনেকেই সদস্যপদ লাভ করে পূর্ণোদ্যমে অভিনয়ে নিজেদের নিয়োজিত করেন। গণনাট্য সঙ্ঘ নবান্ন নাটকের মাধ্যমে বাংলার অপেশাদারী নাট্য আন্দোলনে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল তার ঢেউ এসে লাগলো পেশাদারী মঞ্চে। পরবর্তীতে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নেতৃত্বে শ্ররঙ্গম মঞ্চে অভিনীত হলো তুলসী লাহিড়ীর ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকটি। এই নাটকের বিষয়বস্তুও ছিল বাংলার মন্বন্তর পীড়িত মানুষ। বাংলা মঞ্চনাটকের প্রথম যুগ থেকে দেব দেবী, রাজা-মহারাজা, নবাব-বাদশাহ এবং তাদের সঙ্গে মহারানী, বেগমসাহেবারা বহুমূল্যবান বস্ত্র ও অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চে জাকজমক সৃষ্টি করেছিলেন। মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু নারী ও পুরুষ চরিত্রও মঞ্চে আসতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু একেবারে কৃষক-কৃষাণী নায়ক নায়িকা সেজে দর্শকের সামনে দাঁড়াবে পেশাদার রঙ্গালয়ের কেউ এটা ভাবতে পারেনি। নবান্ন নাটকের মঞ্চায়ন সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছিল।
নবান্ন নাট্য প্রযোজনা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এবং এর অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসা পেলেও ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, নাটক হিসেবে নবান্নকে মোটেই সক্ষম বলা চলে না। গল্পের অখণ্ডতার চেয়ে ঘটনার ব্যাপ্তি এবং নাটকীয় আবেগের একাগ্রতার চেয়ে বৈচিত্র্যই বেশি লক্ষণীয়। পরিচয় পত্রিকায় এই সমালোচনাটি লিখেছিলেন হিরণকুমার সান্যাল। তিনি মন্তব্য করেন, সুদৃঢ় গল্পের ভিত্তিতে নাট্যরসাশ্রিত করে নাটককে যুগান্তকারী করে তোলার জন্য প্রতিভা লাগে। নবান্নে সে প্রতিভার দেখা মেলেনি। হিরণকুমার সান্যাল ভুল বলেননি। নবান্ন যে নাটক হিসেবে চিরকালীন হয়ে উঠতে পারেনি ইতিহাসই তার প্রমাণ। কিন্তু নাট্য রচনার সকল দুর্বলতা সত্ত্বেও নবান্ন বাংলা নাটককে নতুন পথ দেখায়। বাড়াবাড়ি রকমের আবেগাশ্রিত অভিনয়ের জায়গায় যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিনয় বা তারকাদের একক দৌরাত্মের জায়গায় দলীয় অভিনয়কে স্থান দেয়া হয়। বাংলা নাটক পূর্বের খোলনলচে পাল্টে সম্পূর্ণ নতুন পথে হাঁটতে শুরু করে। নবান্ন বাংলা নাটকে নতুন সন্ধিক্ষণের সূচনা করে।
পরিচয় পত্রিকায় নবান্ন নাটকের যে সমালোচনা করেছিল সেটাও ছিল খুব যৌক্তিক। নবান্ন নাটকটি বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, এই নাটকের দুর্বলতা এবং ত্রুটির অংশও কম নয়। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটি দুর্ভিক্ষের উপর রচিত হলেও সেখানে গ্রাম্য কৃষক জীবনই প্রাধান্য পেয়েছে; যদিও জোতদারদের সাথে কৃষকদের বিরোধ নাটকের মূল দ্বন্দ্ব নয়। মন্বন্তরের মূল কারণ ছিল ব্রিটিশের শাসন ও শোষণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইংরেজ এদেশের বড় বড় চাল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যুদ্ধের রসদের জন্য চাল সংগ্রহ করতে লাগলো। সাধারণ মানুষের কাছে চালের আকাল হলো। খাদ্যের দাম রাতারাতি বেড়ে গেল। মজুত চাল চড়াদামে কালোবাজারে বিক্রি হতে থাকলো। মুদ্রাষ্ফিতি, মজুতদারি, কালোবাজারি পরপর তৈরি হলো। ফলে সৃষ্টি হলো কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। লক্ষ লক্ষ লোক মারা পড়লো। মনুষ্য সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ছিল মজুতদার, মুনাফাবাজ, মহাজন, জমির দালাল, জোতদার বিত্তবানদের একাংশ এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ রাজশক্তি। নবান্ন নাটকে সেই মূল শত্রু ব্রিটিশের নামমাত্র নেই।নাট্যকার দুর্ভিক্ষের মূল কারণটি এই নাটকে এড়িয়ে গেছেন। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে ব্রিটিশ রাজশক্তির যে বিরাট ভূমিকা ছিল তার কথা নাটকের কোথাও উল্লেখ নেই। ফলে মনন্তরের কারণটি নাট্যকার চিহ্নিত করতে পারেননি। বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন দিয়ে নাটক শুরু, অথচ নাটকে কখনোই বোঝা যায় না, এই আগস্ট আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে। নাটকের ঘটনা যে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ঘটছে, তা নাটকের কোনো অংশ থেকেই বোঝা যায় না। বিজন ভট্টাচার্য নবান্ন লিখে নতুন ধারার প্রবর্তন করলেন বটে কিন্তু তাঁর নাট্যরচনায় সমাজ-সত্য ছিল না। দুর্ভিক্ষের বাইরের চিত্রটা ছিল, মানুষের মৃত্যু আর হাহাকার স্পষ্ট হলো; দুর্ভিক্ষের কারণ যে শাসকশ্রেণী তাদের কথা ছিল না। পরবর্তীকালেও গণনাট্যের নাট্যরচনায় এই ত্রুটি বারবার লক্ষ্য করা যাবে। সত্যের ভিতরের গভীর সত্যটা তাতে ধরা পড়ছে না। ফলে যে নাটকগুলি রচিত হচ্ছিলো, তা মূলত হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো এক একটা অর্ধসত্য। নাট্য রচনার এই ত্রুটি সর্বত্র লক্ষণীয়। নাটক রচনা তাই খুব সহজ কাজ নয়। নাট্যকলার অন্যান্য দিকের চেয়ে নাটক রচনার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতা ধরা পড়ে। চলবে