ব্রেশট
রাজনৈতিক নাট্যকার এবং নির্দেশক ব্রেশট
শেষ পর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২০
মহাকাব্যিক নাট্যরীতির আলোচনায় ব্রেশটের পাশাপাশি য়্যারিস্টটল প্রসঙ্গ অপরিহার্য ভাবে এসে পড়ে। ব্রেশটের নাট্যরীতির প্রধান পরিচয় সে য়্যারিস্টটল এর নিয়ম বিধির বিরোধী। বলা হয়ে থাকে নাট্যতত্ত্বের উপর য়্যারিস্টটলের “কাব্যতত্ত্ব” রচনার পর, ব্রেশট পুনরায় নতুন নাট্যতত্ত্ব দেন নাটকের উপর। য়্যারিস্টটলের পর নাট্যচিন্তা নিয়ে এতবেশি আলোড়ন বিশ্বে আর হয়নি, যা ব্রেশটের নাট্যচিন্তা নিয়ে হয়েছিল। ব্রেশটের নাট্যচিন্তা নিয়ে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্পষ্ট করে বলেন, ব্রেশট সচেতনভাবে কাব্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে বা অ-য়্যারিস্তোতলীয়। য়্যারিস্টটল নাট্যশালার নিয়মবিধি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে শাসকশ্রেণীর মতামতই গ্রহণ করেছিলেন। কাব্যতত্ত্বের আলোচনায় তিনি বলেছিলেন শোকগাথার নায়কের চিন্তা হবে উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত, স্বভাবতই ব্রেশট যার বিরোধী। য়্যারিস্টটল বলছেন নায়ক হবে নীতিবান, যার থাকবে ন্যায়বোধ, জ্ঞান, সাহস, সংযম ইত্যাদি। অথচ মার্কসবাদের বিচারে সর্বাঙ্গ সুন্দর কোনো মানুষ নেই, মার্কসবাদ তাই য়্যারিস্টটলের এই চিন্তারও বিরুদ্ধে। য়্যারিস্টটল এক আদর্শবান চরিত্রের কথা বলছেন অথচ মার্কসবাদে কোনো অনড় আদর্শ বলে কিছু নেই। সব আদর্শই যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। য়্যারিস্টটল যে শুধু উচ্চ আদর্শের কথা বলেছেন তাই নয়, তিনি বলেছেন নায়কের থাকবে চরিত্রের একটিমাত্র দোষ, সেই দোষেই ট্র্যাজিডি বা শোকগাথা নাটকে ঘটবে তার সর্বনাশ। সেই দোষগুণ মাপবার মাপকাঠি হবে ‘সংবিধান’ ‘রাষ্ট্রের আইন’ এগুলি। যেহেতু নায়কের দোষগুণ বিচার হবে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির নিরিখে, সেহেতু দর্শকদের রাজনৈতিক অপরাধ প্রবণতাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। য়্যারিস্টটল শুধু অভিজাতদেরকে নায়ক হিসাবে দেখতে চেয়েছেন এবং নায়ক সম্পর্কে বদ্ধমূল একটি ধারণায় এসেছিলেন। যদিও তিনি সরাসরি ‘নায়ক’ কথাটি ব্যবহার করেননি। নাটকের প্রধান চরিত্র নিয়ে য়্যারিস্টটলের এ বক্তব্য।
সামাজিক আচরণ বিধি লঙ্ঘন করতে পারে এমন সব প্রবণতা দর্শকদের মন থেকে দূর করাই ছিল য়্যারিস্টটলের লক্ষ্য। নাট্যশালা ছিল সেখানে নীতিকথা প্রচারের পাশাপাশি ভীতি প্রদর্শনের, দমননীতির সহায়ক, বলপ্রয়োগের বিকল্প। দেখাই যাচ্ছে, য়্যারিস্টটলের নাট্যরীতির মূল প্রেরণা হচ্ছে দর্শকদের শিক্ষাদান যেখানে নাটক হবে বক্তব্য প্রধান। ব্রেশ্টের সাথে এখানে তাঁর মিল থাকলেও রয়েছে চরম অমিল। শিক্ষা বলতে ব্রেশ্ট নীতি শিক্ষা বা ধর্ম শিক্ষার মতো কোনো শিক্ষা বোঝাননি। তিনি শিক্ষা বলতে বোঝাতে চান ভাবতে শেখা, জানতে শেখা, বিচার করতে শেখা; দর্শককে সমস্যার মুখোমুখি, বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানো। ব্রেশ্ট দেখান সমস্যাকে, সমাধানের ভার দেন দর্শকদের ওপর। য়্যারিস্টটল চেয়েছেন দর্শকরা নাটকের নায়কের সাথে একাত্ম হবে, নায়কের পক্ষ নেবে, নায়কের প্রতি তার সহমর্মিতা সৃষ্টি হবে, নায়কের উচ্চ আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে; আবার নায়ক যখন নিজের দোষক্রটি বুঝে নিয়ে পরিশুদ্ধ হবে, দর্শকও তার সাথে সাথে পরিশুদ্ধ হবে। কিন্তু ব্রেশ্ট মনে করতেন যে, দর্শককে একাত্ম বা সহমর্মী করে তোলার চেয়ে তাদের ক্রিয়াশীল করে তুলতে হবে, চরিত্র ও ঘটনাকে বিশ্লেষণের সুযোগ দিতে হবে এবং তাদেরকে একটি সিদ্ধান্তে আসার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। দর্শক কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে স্বাধীনভাবে, নাটকে বর্ণিত ঘটনা বা তথ্যের ভিত্তিতে। ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির আলোকে, শাসকদের তৈরি করা মাপকাঠির বিচারে নয়।
ম্যাকসিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অবলম্বনে ব্রেশট উনিশশো বত্রিশ সালে মঞ্চস্থ করলেন মা, টুয়ারের বিপ্লবী পেলাগেয়া ভলাসোভার জীবন নাটকটি। নাটকটি “মা” নামেই সর্বাধিক পরিচিত। তিনি ইতিমধ্যেই একটি দর্শক চক্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, সে দর্শক হলো সর্বহারা শ্রেণী। যে শ্রমিকশ্রেণীর কাছে তিনি শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেছিলেন সেই শ্রমিকশ্রেণীর জন্যই তিনি নাটক লিখতে আরম্ভ করেন। তিনি রীতিমতো উৎসাহ বোধ করতেন যখন দেখতেন যে শ্রমিকরাও তাঁকে নাটকের উদ্দেশ্য ও উপযোগিতা সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করছে। তিনি শ্রমিকদের সমালোচনাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। সর্বহারার এই নতুন জগত ব্রেশটের জীবন ও কর্মক্ষেত্রকে খুবই প্রভাবিত করেছিল ‘মা’ নাটকের মধ্য দিয়ে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করে বুর্জোয়া পত্রিকাগুলি খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। মা নাটক সম্পর্কে ক্ষেপে গিয়ে ‘গেরামানিয়া’ পত্রিকায় লেখা হলো, ব্রেশটের সাহিত্যসৃষ্টির পিছনে নিজস্ব চিন্তা বলে কিছু নেই; যা রয়েছে তা সাম্যবাদী মতাদর্শ। এই মতাদর্শ ছিল পিসকাটরের নাট্যশিল্পে, রয়েছে ব্রেশটের নাট্যচিন্তায়। সুতরাং তাঁকে আর স্বাধীন সাহিত্যসেবী হিসেবে গণ্য করা চলে না, বরং কট্টর রাজনীতিজ্ঞ হিসেবে মনে করাই যুক্তিযুক্ত। ব্রেশট সম্পর্কে এই রকম ছিল গেরামানিয়া পত্রিকার মন্তব্য।
মা নাটকের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। বিপ্লবী এক মহিলাকে মধ্যমণি করে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিপরীতে তাকে শ্রেণীসংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলেন নাট্যকার। মা শ্রমিকশ্রেণীর ভাগ্য পাল্টাবার জন্য বিপ্লবের ডাক দেয়। ফলে জার্মানীর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এটাকে সহজভাবে নিতে পারে না। নাটকটি সম্পর্কে ‘ডেঅর ইয়ুঙ্গে ডয়েট্শে’ সংবাদপত্রটি “নাট্যশালা; গৃহযুদ্ধের শিক্ষণ কেন্দ্র” শিরোনামে রচিত একটি নিবন্ধে মন্তব্য করলো, শহরের বুকে অত্যন্ত উন্নত, সুদৃঢ় পুলিশী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও খোলাখুলি এ ধরনের গৃহযুদ্ধের ডাক দেওয়া সম্ভব হলো কী করে! শিল্পসৃষ্টির নামে যে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচার চলছে, পুলিশের প্রহরাকে উপেক্ষা করে যে নাশকতামূলক কার্যক্রম চলছে তাতে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ। মা নাটক সম্পর্কে ‘কাতোলিশেষ কিরশেনব্লাট’ পত্রিকার সমালোচনায় বলা হলো, শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, দেশের আইন শৃঙ্খলা বিলুপ্ত প্রায়। যথাশীঘ্র ঐ নাটক বে-আইনী বলে ঘোষণা করা দরকার। নচেৎ সর্বনাশ। গেরামানিয়া পত্রিকায় পুনরায় লেখা হয়, পুলিশ কর্তৃপক্ষকে চিন্তা করতে অনুরোধ করি যে, এই শহরের একটি নাট্যশালায় কয়েক সপ্তাহ ধরে সাম্যবাদী প্রচার মূলক মা নাটকের অভিনয় চলছে। এই শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী নাটক পুলিশ বিভাগের কর্তব্যকেই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ আর কতোকাল শহরের বুকে এই তাণ্ডবলীরা চলতে দেবে? মা নাটক প্রযোজনার পূর্ব পর্যন্ত ব্রেশট ছিলেন একজন স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন নাট্যকার; তখন পর্যন্ত তিনি শুধু সাম্যবাদী দলের সহমর্মী হিসেবে মূল্যায়িত হতেন। মা নাটক মঞ্চায়নের পর তিনি বিপ্লবীদের প্রথম সারিতে এসে দাঁড়ালেন।
নিজের নাট্যরূপ দেয়া মা নাটক সম্পর্কে ব্রেশট লিখেছিলেন, নাটকটি শিক্ষামূলক লেখার ধরনে লেখা; নাটকটি ভাববাদ বিরোধী, বস্তুবাদী এবং অ-য়্যারিস্টটলীয় নাটক। এ নাটক কখনই য়্যারিস্টটলীয় নাটকের মতো দর্শকের নিষ্ক্রিয় একাত্মতার সাহায্য নেয় না। ভাগ্যকে অপ্রতিরোধ্য মনে করে এ নাটক যেমন তার নায়ককে পৃথিবীর কাছে সঁপে দেয় না, তেমনি দর্শককে নাটকীয় অভিজ্ঞতার কাছে সম্পূর্ণ সঁপে দেবার কথাও ভাবতে পারে না। পৃথিবীকে বদলানোর উদ্দেশ্যে যে বিশেষ বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন দর্শককে তাই শেখানোর জন্য এ নাটকের প্রচেষ্টা। ব্রেশট বলেন যে, য়্যারিস্টটলের নাট্যশাস্ত্রে বা কাব্যতত্ত্বে ভয় ও করুণা উদ্রেক করার মতো ঘটনা মানেই হলো দর্শকদের মনের মধ্যে কতক আবেগের সঞ্চার করা, দর্শক যেন কোনো বিচার বিবেচনা না করতে পারেন তারই ব্যবস্থা পাকা করা। সেজন্য য়্যারিস্টটলের চিন্তার বিরুদ্ধে একটি পুরাতন প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে ব্রেশ্টের মহাকাব্যিক নাট্যরীতির তত্ত্বে। আর তাহলো বিপ্লবী নাট্যকার দর্শকের আবেগে ঘা দেবেন, না বুদ্ধির কাছে আবেদন রাখবেন। সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি সবচেয়ে রক্তাক্ত বিরোধকেও বুঝতে বা সামাল দিতে পারে মানুষের যুক্তি কিংবা বুদ্ধি। যুক্তির কাছে আবেদন রাখাটাই তাই ব্রেশ্টের কাছে প্রধান ব্যাপার। নাটক ধাক্কা মারবে দর্শকদের বিচার বুদ্ধির দরজায়। সেজন্য তাঁর নাটকে আবেগের রাশ টেনে রাখা হয়। সব মিলিয়ে আবেগও হয়ে ওঠে যুক্তির মতোই। দর্শকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেয়ার জন্যই তা করা হয়ে থাকে।
দর্শকদের কাছে তিনি যা চেয়েছিলেন তারা হবে সাংসদের মতো, নাটক দেখতে দেখতেই বিষয়বস্তুর ঠিক ভুল বিচার করবে। য়্যারিস্টটল যেখানে একাত্ম হবার কথা বলেছেন, ব্রেশট সেখানে বলেছেন বিচ্ছিন্নতার কথা। নাটকের ঘটনাকে দর্শক দেখবে বিচারকের ভঙ্গিতে, কোনো পক্ষের সাথেই একাত্ম হয়ে নয়। নাটক দেখতে দেখতে দর্শক ঠিক ভুল নির্বাচন করবে। সেটাই ব্রেশ্টের বিখ্যাত বিয়োজন বা দূরত্বস্থাপন তত্ত্ব। তাঁর দূরত্বস্থাপন তত্ত্বের মূল লক্ষ্য ছিল দর্শক নাটক দেখতে এসে যেন নিষ্ক্রিয় না হয়ে পড়ে এবং সে যেন সচেতন থাকে যে সে নাটকই দেখছে, কোনো সত্য ঘটনা নয়। সমালোচকের মতো তার বিচার বুদ্ধিকে যেন সেক্ষেত্রে সে কাজে লাগাতে পারে। দর্শক যাতে কোনো ভাবেই একাত্ম না হতে পারে সেজন্য চমক সৃষ্টি করতেন তিনি নাটকে, যাতে দর্শক একাত্মতা ভেঙে বের হয়ে আসতে পারে। দূরত্ব স্থাপন ও চমক; এসবই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সৃষ্ট। চমক, দূরত্ব স্থাপন বা বিয়োজন; সবকিছুরই পেছনের উদ্দেশ্যটা দর্শককে বিচার বিশ্লেষণ করতে শেখানো। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে সাহায্য করা।
নন্দনতত্ত্বের এক অপরিহার্য অংশ হলো নান্দনিক বস্তুর বস্তুনিষ্ট বিচার; যে বস্তু মানবচিত্তে সাড়া জাগায় সেই বস্তুটির স্বরূপ বিশ্লেষণ। আরেকটি অপরিহার্য অংশ হলো মানবিক অনুভূতির বিজ্ঞান। নন্দনতত্ত্বর ভূমিকা ঘুম পাড়ানো হতে পারে না। নিজের জীবনীর এক জায়গায় ব্রেশ্ট গির্জা সম্পর্কে লিখেছিলেন, গির্জার ইচ্ছাকৃত আলো আঁধারের মায়াজাল তৈরি এবং মিটমিটে মোমবাতির রহস্যময় আলো; সেই সাথে ধূপের ধোঁয়া আর তীব্র গন্ধ; এইসব মিলে ভক্তদের ইন্দ্রিয়গুলিকে ঘুম পাড়ায় এবং সেই দুর্বল মুহূর্তে গির্জার প্রচারণা ফলপ্রসু হয়। সেই কারণে ব্রেশট মনে করছেন নাট্যমঞ্চ থেকে সকল রকমের আলো আঁধারের মায়াজাল বিস্তার বন্ধ করতে হবে। নাটকের শক্তিশালী বিষয়বস্তু এবং বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়ই নাটককে দর্শকের কাছে উপভোগ্য করে তুলতে পারে। মায়াজাল বিস্তারের কোনো প্রযোজন নেই। নাট্যাভিনেতা বা অভিনেত্রী নিজেকে চরিত্রের মধ্যে অবলুপ্ত করে ফেলবে না, সম্পূর্ণ সজাগ থাকবে। সে শুধু কোনো চরিত্র উপস্থাপন করবে না, চরিত্রটি সম্পর্কে নিজস্ব মতামতও জানিয়ে দেবে। দরকার হলে নাট্যাভিনেতা অভিনেত্রী দর্শকের সাথে সরাসরি কথা বলবে।
স্বাভাবিকবাদী নাটকের চতুর্থ দেওয়াল তৈরির বিরুদ্ধে ব্রেশ্টের ছিল বিদ্রোহ। চতুর্থ যে দেওয়াল তা যুক্তিবাদীরাই খানিকটা বাদ দিয়েছিল। ব্রেশ্ট চতুর্থ দেওয়াল শুধু বাদই দিলেন না, নিষিদ্ধ করে দিলেন। তিনি সদম্ভেই বললেন মঞ্চ ও দর্শকের মধ্যে কোনো কাল্পনিক দেওয়াল থাকতেই পারবে না। নাটকের পাত্র পাত্রীদের জনান্তিকে কথা বলার মধ্যে কোনো চতুর্থ দেওয়াল থাকে না। যখন কোনো অভিনেতা অপর কোনো অভিনেতার উদ্দেশ্যে কিছু বলে তখন সে আসলে মিলনায়তনে বসে থাকা দর্শকের উদ্দেশ্যেই কথা বলে। সেটা কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষভাবে। যখন সে সরাসরি দর্শকের উদ্দেশ্যে কথা বলে তখন সে যুক্তিনির্ভরভাবে কিছুটা তার চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসে। সন্দেহ নেই তাতে তথাকথিত স্বাভাবিকতা ক্ষুন্ন হয়। কিন্তু নাট্যাভিনয়ে কেন এরকম প্রথার আবিষ্কার বা কেন এই প্রথার আবির্ভাব ঘটেছে? জনান্তিকে বা দর্শকের উদ্দেশ্যে সংলাপ বলার পেছনের মূল লক্ষ্যটি হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যখন অভিনেতা-অভিনেত্রী দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলে তার মানে সে দর্শকদের প্ররোচিত করতে চায়। নাট্যাভিনয়ের এই দীর্ঘদিনের রীতি স্বাভাবিকবাদীরা এমন কি বাস্তববাদীরা বাতিল করতে চাইলেন, ব্রেশট তা বাতিল করলেন না। কারণ ব্রেশ্টের নাটকের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে দর্শককে প্ররোচিত করা।
জনান্তিকের চিরন্তন এই প্রথাটিকে ব্রেশট বাতিল না করে নতুনভাবে তাকে কাজে লাগালেন। চরিত্রকে, নাট্য ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব নিলো জনান্তিকে সংলাপ বলার পদ্ধতি। ব্রেশট তার সাথে যোগ করলেন বিয়োজন বা দুরত্বস্থাপন তত্ত্বটি। দুরত্বস্থাপন তত্ত্বটিও নতুন কিছু নয়। বহুকাল ধরেই তা নাট্যাভিনয়ে চলে আসছিল। নাট্যাভিনেতার ছল করে দর্শকের সাথে কথা বলাটাও এক ধরনের দুরত্বস্থাপন বা নিজের চরিত্রের সাথে বিয়োজন ঘটানো; মঞ্চের নাট্যমুহূর্তে খানিকটা ইচ্ছাকৃত বাধার সৃষ্টি করা। চরিত্রের ভিতরের অনেক কথা বাইরে বের করে আনা। সরাসরি দর্শককে চরিত্রের ভিতরের অনেক কথা জানিয়ে দেওয়া। ব্রেশ্ট বললেন একজন অভিনেতা চরিত্রকে যতোটা উপস্থাপন করবেন, ততোটা অভিনয় করবেন না। তিনি উপস্থাপন বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? তিনি বোঝাতে চান নিরন্তর জনান্তিকের ব্যবহার বা দর্শকের সাথে সংযোগ গড়ে তোলা। দর্শকদের সাথে নিরন্তর কথা বলে যাওয়া। দর্শকদের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে মঞ্চে যা ঘটে চলেছে, সেই ঘটে চলার মধ্যে অভিনেতা অভিনেত্রীরা নিজেই নিজের কাজে বাধা দিয়ে যাবে। নাট্যমুহূর্ত সৃষ্টি এবং তাতে বাধা দান দুটোই চলবে যুগপৎভাবে।
নাট্যমুহূর্তে বাধার সৃষ্টি ব্যাপারটা আসলে কী? সামান্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মঞ্চে নাটক চলছে, নাটকীয় মুহূর্ত তুঙ্গে; হঠাৎ সে সময়ে একটা কুকুর কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়লো মঞ্চে। শুধু ঢুকে পড়াই নয়, মঞ্চে ঢুকে ঘেউ ঘেউ শব্দ করে হৈ চৈ ফেলে দিলো। ফলে মঞ্চের নাট্য মুহূর্তে একটা বাধার সৃষ্টি হলো। যাই হোক, খানিকক্ষণ নাটক থামিয়ে লোকজন এসে কুকুরটাকে মঞ্চের বাইরে নিয়ে গেল। ফের নাটক আরম্ভ হলো। দর্শক পুনরায় নাট্যাভিনয়ে মনোযোগ দিলো। কুকুরের ঢুকে পড়াটা এখানে আকস্মিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু ব্রেশট সুচিন্তিতভাবে এমনই কিছু একটা ঘটাতে চান নাটকের মধ্যে, নাট্যমুহূর্তকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙে দেবার জন্য। দর্শককে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতে চান তিনি। নাটক দেখতে দেখতে হয়তো দর্শক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, নাটকের ঘটনার সাথে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিল, হয়তো ভুলতে বসেছিল সে নাট্যালয়ে বসে আছে, মনে করছিল যা দেখছে তা বাস্তব সত্যি। ব্রেশ্ট নাটকের মধ্যে বারবার দর্শকের এই একাত্ম হওয়াকে বাধা দিতে চান। দর্শক নাটকের আবেগে ভেসে গিয়ে বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলুক এটা ব্রেশট চান না। ব্রেশট চান, দর্শক যেন প্রতিমুহূর্তে মাথায় রাখে সে নাটকই দেখছে এবং নাট্য ঘটনার ভিতর দিয়ে শুধুমাত্র বাস্তবের প্রতিফলন দেখছে। সার্কাস দেখতে গিয়ে দর্শক যেমন ভুলে যায় না সে সার্কাসই দেখছে, নাটকেও ব্রেশট তাই চান। তিনি চান দর্শক সার্কাস দেখার মতো সচেতনভাবে নাটক উপভোগ করুক। খেলার মাঠে দর্শক যেমন সচেতনভাবে জয়পরাজয় হিসেব করে, তিনিও চান নাটকের দর্শক তেমনই হোক। বাস্তববাদী নাট্য পরিচালকরা দর্শকের উপর যে মায়াজাল বিস্তার করতে চায়, ব্রেশট তা চান না। দর্শককে কখনো তিনি বশীভূত করতে চান না। সচেতন করে তুলতে চান।
নিশ্চয় ব্রেশ্টের নাট্যচিন্তার গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মার্কসবাদের প্রয়োগ। সদাসর্বদা বিয়োজন রীতি নাটকে ব্যবহার করলেও এটা ব্রেশ্টের আবিষ্কার নয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পূর্বেকার নাট্যরীতি থেকে। তিনি সেটা স্বীকারও করেছেন। জনান্তিকে সংলাপ বলা বা নাটককে বিযুক্তকরণের প্রখ্যাত অভিনেতা ছিলেন সিরিয়া। ষোড়শ শতকের এই অভিনেতা একটি বোলতার মাধ্যমে নাটকে বিয়োজন রীতির প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি যখন অভিনয় করতেন মাঝে মাঝে এমনভাব করতেন যেন একটি বোলতা তাঁকে খুব বিরক্ত করছে। বোলতার বোঁ ধ্বনি তৈরি করতে তিনি ছিলেন খুব পারদর্শী। কিছুক্ষণ পরপর একটি বোলতা যেন মঞ্চে আবির্ভূত হতো এবং সিরিয়ার চারদিকে প্রদক্ষিণ করতো। নাটকের গল্প যখন এগিয়ে চলছে সিরিয়া তখন দর্শকদের এইরকম অদ্ভুত পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে ফেলতেন। সিরিয়া ছিলেন রুজাতের সমসাময়িক। রুজাতে নাট্যাভিনয়কালে সরাসরি দর্শকের সঙ্গে কথা বলতেন। সেটা শুধু শৈল্পিকমান উন্নয়নের জন্য নয়, তিনি চাইতেন দর্শকরা যেন মঞ্চের ঘটনার সাথে পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করে। মঞ্চের ঘটনাগুলো যে কাল্পনিক বা কল্পবস্তু সে সম্পর্কে তিনি প্রতিনিয়ত দর্শকদের সজাগ রাখতে চাইতেন। ঠিক এই ব্যাপারটাতেই মিউনিখের নাট্য জগতের দিকপাল ভেডেকিন্ড ব্রেশ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তিনি দেখলেন ভেডেকিন্ডের নাট্যশালায় দর্শকের অভাব নেই। তিনি বিশেষ মনোযোগের সাথে খেয়াল করলেন যে, ভেডেকিন্ড দর্শকদের ভুলতে দিতেন না তারা নাট্যশালায় বসে আছে। দর্শকদের তিনি গুরুত্ব দিতেন এবং দর্শকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি সজাগ থাকতেন। ভেডেকিন্ডের নাটকের সবচেয়ে নতুনত্ব ছিল তাঁর ভঙ্গিতে নয় বরং নাটকের সহজ সরল সংলাপে এবং ঘটনায় এবং নীচুতলার মানুষদের জীবনযাত্রার তীব্র দ্বন্দ্বের মধ্যে। ব্রেশট সেই ধরনের নাট্যরীতিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তাঁর নাট্য প্রযোজনায়।
ত্রিশের দশকের একেবারে শেষে এবং চল্লিশের দশকের শুরুতে ব্রেশট স্টকহোমের নাট্যকলার ছাত্রদের কাছে বক্তব্য রাখলেন, যা তিনি দুই যুগ ধরেই বলে আসছিলেন। নাট্যশালার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্রেশ্টের বিশ্লেষণে দুই ধারায় প্রবাহমান, সে দুই ধারা কখনো মিলবার নয়। যার একদিকে রয়েছে ভাখতানগভ, মায়ারহোল্ড, মাক্স রাইনহার্ট, তখলোপখভ, স্তানিস্লাভস্কি এবং জেসনার;ড় যাঁরা বিনোদনের ক্ষমতাকে বর্ধন করার চেষ্টা করে গেছেন। ঠিক অন্যদিকে নাটকের শিক্ষনীয়তা বাড়ানোর পরীক্ষামূলক সৃজনে রত থেকেছেন ইবসেন, টলস্টয়, স্ট্রিন্ডবার্গ, গোর্কি, চেকভ, হাউপ্টমান, বার্নার্ড শ, কাইজার এবং ও’নীল। ব্যক্তিগতভাবে সবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেও কাউকেই এককভাবে গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। সকলে কাছ থেকেই কিছু না কিছু গ্রহণ করতে চেষ্টা করেছিলেন। সকলের চিন্তা থেকে, পদ্ধতি থেকে তিনি প্রয়োজন মতো গ্রহণ করেছেন নিজের নাট্যরীতি নির্মাণের জন্য। কিন্তু নাট্যকর্মের প্রথম দিকে যে-ধরনের বক্তব্য রাখতেন, তাতে মনে হতো তিনি তাঁদের সকলকেই বর্জন করতে চান। নাট্যচর্চার প্রথম জীবনে ব্রেশট প্রাচীন গ্রীক নাট্যকলা, শেক্সপিয়ার ও অন্যদের সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন তাঁদের সম্পর্কে গভীরভাবে না বুঝেই। পরে তিনি সে দৃষ্টিভঙ্গি শুধরে নেন। পুরানো নাট্যরীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি প্রথম দিকে বহুসময় বাগাড়ম্বর করে ফেলেছেন, পুরানো সবকিছু সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। নাট্য রচনায় ব্রেশট তাঁর পূর্বেকার ভাববিলাসীধারাকে ভীষণভাবে বিদ্রুপ করেছেন। শিলারের ভাববিলাসী ধারা এবং জার্মান প্রকাশবাদ দুই ছিল তাঁর কাছে অসহ্য। মার্কসবাদীরা তাঁর এসকল কট্টর মন্তব্যের সাথে কখনো একমত হননি। ব্রেশটও পরবর্তীতে তাঁর চিন্তার ত্রুটিগুলো-অপূর্ণতাগুলো ধরতে পেরেছিলেন।
সত্যিকার অর্থে ব্রেশট যখন নাট্যাঙ্গনে পা রাখেন, সমকালীন বেশিরভাগ নাট্য প্রযোজনাগুলো ছিলো স্থূল; বিষয়বস্তু ও মঞ্চায়নগত দিক থেকে। সেজন্যই ব্রেশট অনেক বেশি জোরালোভাবে পুরানো নাট্যরীতির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছিলেন; সেই নাট্যরীতির সবটা ধরতে না পেরেই। বড় কথা হলো, অন্য অনেক ব্যাপারে য়্যারিস্টটল-এর বিরোধী হলেও অন্তত একটি ব্যাপারে ব্রেশট তাঁর সঙ্গে একমত। চরিত্র নয়, আখ্যানই নাটকের প্রাণ। নাটকের মূল কথাটি গেঁথে দিতে হবে দর্শকের মনে। কিন্তু নাটকের প্রতিটি চরিত্রও উপস্থাপিত হতে হবে সম্পূর্ণ সামাজিক দ্বন্দ্বসমেত। ব্রেশট সবসময় চেষ্টা করেছেন দর্শক প্রতিক্রিয়া যেন তাঁর উদ্দেশ্যের সঙ্গে মেলে। দশজন দর্শক দশরকম বুঝবে এমন সম্ভাবনা তিনি রাখতে চাননি। নাট্যকারের চাওয়াটাই ব্রেশ্টের কাছে সবচেয়ে বড় কথা। তার মানে এ নয় যে, তিনি তাঁর চিন্তাকে চাপিয়ে দিতে চাইছেন দর্শকদের ওপর। ব্রেশট যা করতে চাইছেন, দর্শক যেন তা উপলব্ধি করতে পারে সেটাতেই তিনি জোর দিয়েছিলেন। বক্তব্য পরিষ্কার না বুঝতে পারলে দর্শক তাকে গ্রহণ বা বর্জন করবে কিসের ভিত্তিতে। নাট্যকারের বক্তব্যই যদি দর্শক সঠিকভাবে বুঝতে না পারে সমাজের সাথে তাকে মিলিয়ে দেখবে কীভাবে। ব্রেশট তাই কোনো দুর্বোধ্যতার পথ ধরেননি। সর্বদাই সহজ সরল পথ ধরে এগিয়েছেন। সকল রকম দুর্বোধ্যতার বিরুদ্ধেও ছিল তাঁর লড়াই।
রাজনৈতিক নাট্যকারদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সফল ব্যক্তি। তিনি সফল ছিলেন দুভাবে। প্রথমত তিনি মার্কসবাদকে যথাযথভাবে নাটকে প্রয়োগ করেন যা এর আগে আর কেউ পারেননি। ব্রেশ্টের দ্বিতীয় সাফল্য ছিল, বুর্জোয়া নাটক যখন দর্শক হারিয়ে ফেলছিল তাঁর নাটক আবার শূন্য মিলনায়তন দর্শক সমাগমে পূর্ণ করলো। মার্কসবাদের প্রতি আস্থাশীল ব্রেশ্টের নাট্যকর্ম চেয়েছিল পুঁজিবাদী সমাজের নগ্ন স্বরূপ তুলে ধরতে, সে সাথে নাট্যজগতের আর একটি প্রশ্নকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সে প্রশ্নটি হচ্ছে নাট্যশালার দর্শকের প্রশ্ন। মার্কসবাদী রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি যার আনুগত্য সদম্ভে ঘোষিত হয়েছিল, নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে তার বিবেচনায় প্রধান স্থান পেয়েছিল দর্শকরা। তিনি নাট্য রচনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল কিছুর আগে মাথায় রাখতেন দর্শকদের। তাঁর কাছে কোনো ভঙ্গিই সার্থক নয় যদি না তা দর্শককে আকৃষ্ট করে, উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দর্শককে বাদ দিয়ে নাট্য প্রযোজনায় কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে না। সর্বাগ্রে দর্শককে মিলনায়তনে নিয়ে আসতে হবে। তাঁর নাট্যচিন্তার এটাই আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নাটকের দর্শকরা যেন সুখী বা তৃপ্ত হয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে যায়।
পল রিলা ব্রেশ্টের নাট্য পরিচালনা সম্পর্কে বলেন, দর্শকের চোখকে আনন্দদানের জন্য ব্রেশ্টের মঞ্চে সবই সুন্দর হওয়া চাই। পেলাগয়া ভলাসোভার দরিদ্র ঘরটি সুন্দর হবে, সুন্দর হবে শ্রমিকদের কারখানা-প্রাঙ্গণ, সুন্দর হবে পুতুলের দোকানের মধ্যবিত্ত মেয়েদের পোষাকের রং। স্বাভাবিকবাদীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ব্রেশট বস্তুর প্রাণবন্ততা ও সৌন্দর্যে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। এর সবকিছু প্রথমেই চোখে পড়ে না। ব্রেশট নাটক মঞ্চস্থ করেন এমনভাবে যাতে দশমবারেও নতুন কিছু চোখে পড়বে। এমন কি নাটকটা ভালো করে জানা থাকলেও ব্যবস্থাপনা, ভঙ্গি, রং ইত্যাদি থেকে নতুন আনন্দ পাওয়া যাবে। তিনি সবসময় বলতে চেয়েছেন, নাটক ও রঙ্গমঞ্চকে বিনোদনের স্থান হিসেবেই ধরে নেয়া উত্তম। নাট্যকর্মের মহত্তম ভূমিকা হবে আনন্দ দান কিন্তু তার ভেতর দিয়েই দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে নাট্যকারের বার্তা। দর্শককে আনন্দদানের ক্ষেত্রে তিনি একথাও বলেছেন, শিল্প যে একরকম বাণিজ্য সেটা লোকে ভুলে যায়। কথাটার অর্থ শিল্পকে তো টিকে থাকতে হবে, দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে যা সম্ভব নয়। লোকসান এড়াতে হলে মিলনায়তন শূন্য থাকলে হবে না। দর্শককে টেনে আনতে হবে বিভিন্ন কৌশলে, বিভিন্ন রকম নান্দনিকতার দ্বারা। দর্শককে আনন্দ না জোগালে সে মিলনায়তনে আসবে কেন।
নাট্যকার হিসাবে তিনি জানতেন, দর্শকরা বিনোদন লাভের জন্য নাট্যশালায় আসে। তিনি তাঁদের খাটো করে দেখতেন না। তাঁর নাট্যচিন্তা নিয়ে যে সব দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে, ‘নাট্য আঙ্গিকের খোঁজে ব্রেশ্ট পিকিং অপেরার কাছে গেছেন, কাবুকি বুঝতে চেয়েছেন, প্রাচীন সংস্কৃত নাটক পড়েছেন, মার্কস অধ্যয়ন করেছেন’; এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল দর্শক চিত্তকে জয় করা। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন না যে, শুধুমাত্র হৃদয় বৃত্তির জন্যই দর্শক নাটক দেখতে চায়। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, শিক্ষাদান ও আনন্দদান দুটোই নাট্য প্রযোজনার কর্তব্য এবং দর্শকদের সম্মান করতে গেলে তাঁরা যে নাটক বুঝবার মতো উচ্চ বুদ্ধি রাখে, একথা মনে রাখা উত্তম এবং উচিৎ। দর্শকদের চিত্তকে জয় করবার জন্য তিনি নাটকে বিনোদন বা আমোদের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন যে, যদি আনন্দদানের আয়োজন না থাকে তাহলে নাট্যকর্ম সামগ্রিকভাবে ‘শিক্ষা’ দানে সফল হবে না। তাঁর কাছে যে প্রশ্নটি প্রাধান্য পেয়েছিল তা হলো শিল্প-সংস্কৃতি কার জন্য? কয়েকজন রুচিবান দর্শকদের জন্য, না ব্যাপক জনগণের জন্য? তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন নাট্যকর্মের লক্ষ্য হবে মুষ্টিমেয় দর্শক নয়, পুরো সমাজ। নাটকের মধ্য দিয়ে বিশাল দর্শকগোষ্ঠীকে যেমন আলোকিত করতে হবে, ঠিক তেমনি শিল্পসম্মত বিনোদন দিতে হবে।
জার্মান নাট্যশালার তখন করুণ চিত্রই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো। সেখানে নাট্যশালা থাকলেও নাট্যশালায় দর্শক ছিল না। জার্মান পেশাদার নাট্যশালাগুলো তখন রাজনীতি থেকে পালিয়ে ভঙ্গিসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দু-চারজন যাঁরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তব্য রাখতে চেষ্টা করছিলেন, সেগুলোও ছিল বিভ্রান্তিকর। নাট্যকর্ম সম্পর্কে সঠিক চিন্তাই যেন তখন কারো মধ্যে ছিল না। নাট্যের নানারকম উপাদান মঞ্চ নাটকে ব্যবহার করা বা বিষয়বস্তু উপস্থাপনার সত্যিকারের পদ্ধতি খুব অল্পই এইসব প্রযোজনায় দেখা যেতো। দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে এ সময় ব্রেশট নিজেও পেশাদার নাট্যশালার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তিনি নাট্যশিল্পের ক্ষমতা সম্পর্কে আস্থা হারাননি। তিনি বুঝতে চাইছিলেন কী করে নাট্যশিল্পকে পুঁজিবাদ তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়, কীভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তব্য দর্শকদের মধ্যে পৌঁছে দেয়া যায়। দর্শকরা যখন নাট্যশালা ছেড়ে চলে গেল, তিনি মনে করেননি যে, দর্শকরা নাটক বোঝে না। তিনি উপলব্ধি করলেন দর্শকরা যে নাটক দেখে বিরক্ত হয় সে ব্যর্থতা নাট্যকার ও পরিচালকদের। তাঁরা তাঁদের নাটক বা নাট্যকর্ম দর্শকদের ভালো লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বললেন, যে নাট্যশালার সাথে জনগণের সম্পর্ক নেই সে নাট্যশার্লা অর্থহীন। সে নাট্যশালা জানেই না জনগণ তার কাছ থেকে কী চায়। তাঁর নাট্য সাধনার তাই আর এক মূল লক্ষ্য ছিল জনগণ নাট্যশালার কাছে কী চায়, কী আশা করে সেটা গভীরভাবে অনুধাবন করা। দর্শকের অন্তরকে বোঝা, তার চিন্তার জগতের সাথে পরিচিত হওয়া। সেজন্য প্রাচীন কাল থেকে দেশে-বিদেশে যে নাট্যকর্ম জনগণের মন জয় করে এসেছে, সে-ধরনের নাট্যকর্মকে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করতে চেয়েছেন, সে সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছেন। কোনো শিল্প সম্পর্কে তাঁর শুচিবাই ছিল না। তিনি চ্যাপমানের ব্যালাড থেকে চীনের নাট্যকলা, সর্বক্ষেত্র থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন। কিন্তু প্রয়োগের ব্যাপারে তিনি সবসময় মগজে রাখতেন যে বিষয়গতভাবে দর্শক যেন কোনো বিভ্রান্তির সম্মুখিন না হয়।
নাট্যকলার ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, চলতি নাট্যকর্মে ‘আমোদ’ জিনিসটির খুব অভাব। তিনি তৎকালীন নাট্যকর্ম সম্পর্কে লিখেছিলেন, নাট্য প্রযোজনায় দর্শকদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো যে সেখানে আনন্দ জিনিসটাই নেই। তিনি বলতেন, নাট্যকর্মের এক বিশেষ কর্তব্য রয়েছে দর্শকদের প্রতি এবং সেটা হলো আনন্দদান। গণনাট্য সম্পর্কে রঁম্যা রলাঁ ঠিক একথাই বলেছিলেন। গণনাট্য রচনা ও মঞ্চায়নে সবার আগে অবশ্যই যা প্রয়োজন বা যা প্রাথমিক শর্ত তা হলো, এই নাট্যকলাকে অবশ্যই বিনোদন দিতে হবে। বিনোদন বা আমোদ বলতে ব্রেশট কখনই সস্তা জনপ্রিয়তার কথা বোঝাননি। তিনি মনে করতেন কেবলমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য এবং চিন্তাদীপ্ত মানসিকতার দ্বারাই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন প্রাণবন্ত আমোদের সৃষ্টি করা সম্ভব। চিন্তার কেন্দ্র ‘গুরু মস্তিস্ক’কে যা নাড়া দিতে পারে, তাই হলো সফল বিনোদন। তাঁর ধারণায় নাট্যকর্মে আমোদ জিনিসটি যুক্ত করতে উপরি পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনায় যে বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সেটাই হবে নাট্যকর্মে আমোদের উৎস। মানুষকে যে কখনই পুরোপুরি চেনা যায় না, চূড়ান্তভাবে চেনা যায় না, সে যে এতো সহজে নিঃশেষ হওয়ার নয়, তার মধ্যে যে এতো বিচিত্র সম্ভাবনার বৈভব লুকিয়ে আছে এটা জানা পরম আনন্দের ব্যাপার। পরিবেশ মানুষকে বদলাতে পারে, মানুষ নিজেও পারে পরিবেশকে বদলাতে, এই বোধ বড় আনন্দের। সেজন্য মানুষের মনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দরকার। সেই বিশ্লেষণে নাট্যকার যদি দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, নাট্যকর্ম তার মধ্য দিয়েই হয়ে উঠতে পারে হৃদয়গ্রাহী। সেজন্য কিছু শেখাও ব্রেশ্টের কাছে একটা বড় বিনোদন।
মার্কসবাদ চর্চা ও নাটক সম্পর্কে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়ে ব্রেশ্ট বুঝলেন, আনন্দদানের জন্য বিষয়বস্তুই হবে প্রধান, ভঙ্গি শুধু তার পিছু নেবে বিষয়বস্তুকে সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করার জন্য। তিনি এটাও উপলব্ধি করলেন, দর্শকদের আনন্দ লাগার মতো শ্রেণী-সচেতন নাটক লিখতে হলে আগে ইতিহাসকে গভীরভাবে বুঝতে হবে এবং যে অর্থনৈতিক বন্ধনের মধ্যে মানুষ বাঁধা পড়ে থাকে সেটা বুঝতে না পারলে মানুষের আসল সত্তাই আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। সেজন্য বৈপ্লবিক নাটকের কাজ হবে মানুষকে তার আসল পরিচয়ের মুখোমুখি দাঁড় করানো। মার্কসবাদ অধ্যয়নের মধ্য দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, মানুষ নিজেকে জানতে চায়, সে অন্য মানুষকেও বুঝতে চায়। মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক কী এবং সমাজের সাথে তার বন্ধন কোথায়, কীভাবে; তা আবিষ্কার করতে পারার মধ্যেও আছে এক ধরনের আনন্দ। ব্রেশ্ট আনন্দকে এভাবেই দেখেছিলেন। তাঁর মতে জটিল সময়কে সহজভাবে উপস্থাপন করাই নাট্যকারের সবচেয়ে বড় দক্ষতা। দর্শককে আমোদ দানের জন্যই নাট্যরচনায় গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলতে হবে এমনভাবে যেন তা হয় অতি সহজ সরল। নাট্যরচনাকে শুধু গালভরা বুলি দিয়ে ভরিয়ে তুললে হবে না। বারনার্ড গুলেমিনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু লেখক আছেন যাঁরা আসলে ঘটনার ছবি আঁকেন। আমি তাঁদের মধ্যে একজন। তত্ত্ব উপস্থিত করে আমি কাউকে কিছু বোঝানো পছন্দ করি না। বরং একটা ঘটনা দিয়ে অনেক কিছু ভাববার অবকাশ করে দেওয়া যায়’। তিনি নাটকের আখ্যান বা গল্পের ভিতর দিয়ে দর্শকের কাছে বক্তব্যকে তুলে ধরতে চাইতেন।