প্রতীকী ছবি
রাজনীতিতে শিশুদের ব্যবহার প্রসঙ্গে খুচরো আলাপ
মঈনুল ইসলাম তুহিনপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯
রাজনীতিতে শিশুদের ব্যবহার নিয়া আলাপটা জইমা ওঠে সম্ভবত ২০১৩ সালের দিকেই। `প্রথম আলো` গোষ্ঠীই পয়লা আলাপটা তোলে, পাব্লকলি। `প্রথম আলো`র পয়লা নিশানা ছিল অবশ্য জামাতই। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ, প্রথম আলোর একটা খবরের শিরোনাম ছিল এমন— `গাইবান্ধায় মাদ্রাসার শিশুদের ঢাল হিশেবে ব্যবহার`।
অবশ্য আলাপের সূত্রপাত হয়, ওই বছরই ২২ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হেফাজতের জুমা-পরবর্তী বিক্ষোভ কর্মসূচির পরে। ৬ এপ্রিল হেফাজতের লংমার্চ কর্মসূচির ঠিক একদিন আগে, ৫ এপ্রিল `প্রথম আলো` এই বিষয়ে একটা বিশেষ প্রতিবেদন পাবলিশ করে। শিরোনাম— `শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতায়`। এই প্রতিবেদনে হেফাজতের ২২ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে `মাদ্রাসাপড়ুয়া কয়েকশো শিশু-কিশোর সংঘর্ষে অংশ নেয়` মর্মে দাবি করা হয়।
এই রিপোর্টে অবশ্য, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কীভাবে শিশুদের রাজনীতিতে ব্যবহার করতেছে, তা নিয়াও কিছুটা আলাপ তোলা হয়। তবে গোটা ২০১৩ সালজুড়েই, এই অভিযোগটা প্রথমত ও প্রধানত, জামাত এবং হেফাজতরে কেন্দ্র কইরাই ঘুরপাক খাইতে থাকে। এই ব্যাপারে তখনকার অ্যাক্টিভ বামপন্থী দলগুলার কোনো স্টেটমেন্ট অবশ্য আমার জানা নাই। বোধকরি অফিশিয়ালি কিছু না কইলেও, রিপোর্টগুলা নিয়া তারা মোটের উপর খুশিই ছিলেন।
সম্প্রতি ছাত্রফ্রন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তারা নিজেদের রাজনৈতিক কাজে শিশুদের `ইউজ` করেন। কেউ কেউ বলছেন, `মিসইউজ` করেন। ফ্রন্টের সম্মেলনে আসা কোনো এক শিশু `কেন এখানে আসছে তা জানে না`-মর্মে কিছু একটা বলছেন সম্ভবত, আমি সঠিক জানি না। আমাদের কমরেডদের মধ্যেও এই ইস্যুতে যথারীতি নানারকম ব্লেমগেম আর কৈফিয়তদান কর্মসূচি পালিত হইতেছে। এই প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা বলা দরকার।
প্রথমত, এই অভিযোগটা নিয়া যারা খুব `তীব্র`-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেছেন, তাদের অনেকেই ছাত্রলীগ করেন। সাধারণ শিক্ষার্থী যারা আছেন, তারা কখনোই এই ইস্যুতে ছাত্রলীগের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তুলছেন কী? ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটি ছাত্রলীগের স্কুল ও কলেজ শাখা খুলতে চাইছিলেন, সেই ঘটনা তো খুব পুরাতন না। ঢাকার ম্যাক্সিমাম কলেজেই ছাত্রলীগের কার্যক্রম আছে। সেসব নিয়া আপনাদের আলাপ নাই কেন? থাকা উচিত। প্রসঙ্গক্রমে এই তথ্য দেয়াটা মনে হয় কারুর অনুভূতিতে আঘাত দিবে না যে, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চেও ছাত্রলীগ শিশুদের ভাড়া কইরা নিয়া গেছিল। আশুলিয়া, ভাসানটেক আর কারওয়ান বাজারের অনেক শিশু-কিশোররে তিনবেলা খাবারের লোভ দেখাইয়া নানান কর্মসূচি পালনের জন্য গণজাগরণ মঞ্চে নিয়া আসতো ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা।
সুতরাং, ছাত্রলীগের এইসব আবোলতাবোল কথাবার্তা বলার রাইট নাই। অন্য যারা বলতেছেন, তারা প্লিজ ইকুয়ালি বলেন। কানহাইয়া কুমাররে একজন জিগেশ করছিলেন, কংগ্রেসের দুর্নাম বলে না কেন। উনি বললেন, `কংগ্রেস কে? দুর্বলের দুর্নাম তো সবাই গায়।` তো, দুর্নাম গান, কিন্তু গাইতে সময় প্রায়োরিটি কনসার্নটা ঠিক করেন, এটলিস্ট ইক্যুয়াল তো থাকেন।
এইবার কমরেডদের কথা বলা যাক। হেফাজত-জামাতের `শিশু ব্যবহার`মূলক যে সরল প্রচারণা মিডিয়ায় চালানো হইছে ২০১৩ সালে, আমাদের কমরেডরা তখন কী করছেন জানি না, নিশ্চয়ই ওনারা খুশিই হইছিলেন। যদিও তখন, জাগরণমঞ্চে ছাত্রলীগকর্তৃক শিশুদের মিসইউজের খবর প্রকাশ্যে আসার পরেও, ওনারা কেউ এই ব্যাপারে কিছু বলছেন কিনা আদৌ, জানি না। প্রথম আলো-ও, সেই সময় প্রায় সব দল-মতের লোকেদের `শিশুদের দিয়া রাজনীতি` করার খবর ছাপলেও, কোন বামদলের খবর তারা ছাপেন নাই। কিন্তু না ছাপলে কী আর হবে। আলাপ আজ হউক, কাল হউক, উঠবে তো! উঠছে।
ছাত্র ইউনিয়নের কমরেডদের দেখলাম, ফ্রন্টের শিশুদের সাথে ওনাদের শিশুদের ফারাক বুঝাইতেছেন লোকেদের। ওনাদের শিশুরা অনেক `সচেতন` হইয়া দল করে, প্রোগ্রামে আসে ইত্যাদি। হাহা। নিজেদের মারামারির জন্য বারবার স্ট্যাণ্ড নিতে ভুল করা বামদের স্বভাব। নিজেদের ভাল প্রমাণার্থে তারা একরকম স্বীকারই কইরা নিছেন যে, ফ্রন্ট ভুল করছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে, ইউনিয়নও কি দায় এড়াইতে পারে? আমাদের সব শিশু সচেতন, এইটা আসলে কোন আলাপই না। হেফাজতের সময় ফ্রন্টও হয়ত এমন ভাবতো, এখন ধরা খাইছে। আপনাদের কোন শিশুর এমন ভিডিও ভাইরাল হওয়াও অসম্ভব কিছুই না। ফলে, এই যে স্ট্যাণ্ড নিলেন ইউনিয়নের লোকজন, এইটারে আমার খুব লেজিট কিছু মনে হয় নাই। মানে যুক্তিটাই আসলে ধোপে টেকে না।
`রাজনীতিতে শিশুদের ব্যবহার` আমাদের কাছে অত ভাল কিছু না। বালেগ হওনের আগে রাজনীতি করা মানেই ব্রেইনওয়াশ ভাবে লোকে। কিন্তু বড় হওয়ার পরে যে রাজনীতিটা মানুষ করে, তা কি ছোটকালের শিক্ষা-কালচার-ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি দিয়া প্রভাবিত না? এই যে আমাদের এইখানে সড়ক আন্দোলন, আপনারা কন `কিশোর বিদ্রোহ`, এইখানে শত শত শিশু আসছে। তাদের আপনি সাপোর্ট করতে গেলেন, বলা হইল আপনি তাদের পলিটিকালি ম্যানিপুলেট করতেছেন। শহীদুল সাহেব এইটারে একটা গুমোট পলিটিকাল অবস্থার আউটবার্স্ট হিশাবে দেখাইলেন, বলা হইল উনি মিসইনফরমেশন দিতেছেন। অথচ, শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলন কি পলিটিকাল ছিল না? তারা রাস্তার আইল্যাণ্ড ভাঙছে, রড ভাইঙা হাতে তুলছে, পুলিশ বুথ ভাঙচুর করছে। আবার মজা দেখেন, ভিতরে ভিতরে ছাত্রলীগও তাদের কলেজ শাখার সদস্যদের দিয়া এই আন্দোলন ম্যানিপুলেট করতে চাইছেন, সেইটা কেউ বলে না। তাইলে শিশুদের রাজনীতিতে ব্যবহারের যে অভিযোগ, এইটার সমাধান কী?
এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত মালালা বা গ্রেটা থুনবার্গ দিয়া পারবেন। ওনারাও তো শিশু, অন্তত জাতিসংঘের বিচারে। দুনিয়ার নানান জায়গায় শিশুদের রাজনীতি করা ও রাজনৈতিক ব্যবহারের নানান নমুনা আছে। শিশুদের নিয়া রাজনীতি তো দুনিয়ায় কম হইতেছে না, আপনি সোশিও-পলিটিকাল কনটেক্সট দেখলে বুঝবেন, দুনিয়ার যতগুলা স্পেশাল পলিটিকাল ফেনোমেনা আছে, তার মইধ্যে শিশুও অন্যতম। কওমি মাদ্রাসার চাইল্ড এবিউজের ঘটনা এইজন্যেই বিশ্ব মিডিয়ায় এত গুরুত্ব পায়। যাদের নিয়া এত রাজনীতি, সামনের দিনে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলন করবে না, এই কথা হলপ কইরা বলা যায় না।