রাজনীতি বনাম খেলা আর অন্ধ ভক্তি
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ১৩, ২০২১
বিদেশি ফুটবল দলের প্রতি আমাদের সমর্থনের বহর আর চরিত্র দেখলে, বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের চরিত্র বা দলকে সমর্থন করার কারণটা বুঝতে পারা যায়। দুটাই প্রায় ক্ষেত্রে একই রকমের অন্ধ ভক্তি। ফুটবল খেলা আমার দেখা হয় না বহুদিন, না দেশের না বাইরের। বিরাশি সাল থেকে এ দেশের সরকারি টেলিভিশনে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখানো আরম্ভ হয়। বিশ্বকাপ ফুটবল সম্পর্কে তখন খবর রাখতো খুব কম লোক। যখন বিরাশি সালে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখানো আরম্ভ হয়, প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই ফুটবল খেলা দেখানোর রাজনীতি আর বাণিজ্য বুঝতে আরম্ভ করলাম।
বিরাশি সালটা তবুও খেলা দেখার আনন্দের ভিতর দিয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন দলের খেলোয়াড়দের খেলার নৈপুণ্য তখন নিরপেক্ষভাবে অনেকে আলোচনা করতেন। সবাই খেলা বুঝতেন না, বিশেষ করে মহিলা দর্শকদের অধিকাংশ। নিছক বিনোদন লাভ করতেন তারা খেলা দেখে। ঠিক আবার কেউ কেউ খেলা না দেখলে তিনি যে আধুনিক নন তা প্রমাণ করার জন্য খেলা দেখতেন। বহু মা সন্তানকে সঙ্গ দেবার জন্য খেলা দেখতেন। আজকের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেদিনের দর্শকদের বিচার করা যাবে না। প্রথমবার বিশ্বকাপে কারো বাড়িতে সমর্থক দলের পতাকা ওড়েনি।
বাংলাদেশে তখন ব্রাজিলের সমর্থক বেশি। সহজ কারণ সারা বিশ্বে তখন ব্রাজিল আলোচিত তিনবার বিশ্বকাপ জেতার জন্য। বিশেষ কারণ পেলের সম্মান আর কিংবদন্তী। নানা কারণে ফুটবলের ইতিহাসে পেলে আর ব্রাজিল আলোচিত হবে আরো বহুকাল ধরে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঠিক যেমন নানা দোষত্রুটির পরেও আওয়ামী লীগের নামটা বিশেষভাবে উচ্চারিত হবে। কারণ দলটার জন্ম জনগণের ভিতর থেকে। ব্রাজিলের ফুটবল অনেকটা তেমনি।
বিরাশি সালে যখন বিশ্বকাপ হয়, ব্রাজিল জনপ্রিয়তার দিক থেকে সারা বিশ্ব আলোচিত তখন, ব্রাজিলের খেলার নিপুণ্য দেখার জন্য সারাবিশ্বের ফুটবলপ্রেমী বা ফুটবলাররা অপেক্ষা করতো। তখন সারাবিশ্বে এতটাই ব্রাজিলের সম্মান আর জনপ্রিয়তা ছিল। ব্রাজিলের এ সম্মান লাভের পেছনে কারণও ছিল। বলা হতো ফুটবল খেলাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ব্রাজিল। শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল কি না সেটা বিতর্কিত বিষয়, তবে দৃষ্টিনন্দন ছিল। বিভিন্ন দল সে চেষ্টা করছিল তখন, দৃষ্টিনন্দন খেলা। বিরাশির বিশ্বকাপ ফুটবলে অন্তত সে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপারটা ছিল, বহু দল তার সাক্ষর রেখেছিল। জার্মান ফ্রান্স তো বটেই। যতদূর মনে পড়ে বিশ্বকাপ তার পর থেকেই রূপ পাল্টাতে শুরু করে। বিরাশির খেলার শেষদিকে মনে হচ্ছিল বিশ্বকাপ রূপ পাল্টাতে আরম্ভ করেছে ভয়াবহ বাণিজ্যকে মাথায় রেখে।
পরের বিশ্বকাপে হঠাৎ আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে ম্যারাডোনাকে ঘিরে। হাত দিয়ে ম্যারাডোনার গোল করা টেলিভিশনের ক্যামেরা ধরতে না পারলেও, অন্যরা ধরতে না পারলেও, মাঠে বসেই ঠিক ধরে ফেলেছিলেন পেলে। পেলে যে কত বড় মাপের খেলোয়াড়, সেটা আমি সেদিন টের পেয়েছিলাম। সম্মান বেড়ে গিয়েছিল তাঁর প্রতি নানা ঘটনায়। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও। ফুটবলের জগতে এখন পর্যন্ত তিনি সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। ম্যারাডোনার সেদিনের হাতে দেয়া গোলে আর্জেন্টিনা জিতেছিল ঠিকই, সেই সঙ্গে খেলার জগতে বয়ে এনেছিল অশনি সংকেত। ম্যারাডোনা উপলক্ষ্য মাত্র, আসল খেলোয়াড় ছিল সব মুনাফাখোরের দল। ম্যারাডোনা তখন বিরাট তারকা, বয়স আর অভিজ্ঞতা দুটোই কম; মাফিয়াদের হাতের পুতুল হয়ে গেলেন ফুটবল জগতের অতবড় এক প্রতিভা। মাফিয়াদের বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহ করতে চাইলেন, তখন অস্তগামী সূর্য। নানান অঘটনের ভিতর দিয়ে প্রাণ দিলেন তুলনামূলক কম বয়সে। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তার বীজ তিনি বপন করেছিলেন।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থক বেশি। আর্জেন্টিনারই অধিক বলে মনে হচ্ছে। কারণ মানুষ বিজয়ীর দিকে থাকতে চায়। তাতে একধরনের অহম আছে। যারা মতাদর্শগত জায়গা থেকে লড়ে, তাদের ব্যাপারটা ভিন্ন। দল ভারী দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেয় না। বাকিরা অন্ধের মতো অনুকরণ করে। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল পরপর চারটি বড় খেলায় হেরে যাক, জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকবে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল সারা ক্রিকেটের জগতে তুঙ্গে। ভারতের কথা আলাদা। ভারত নিজে ক্রিকেট খেলে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সব ক্রিকেট খেলোয়াড় দেশের জনসংখ্যার যোগফল ভারতের জনসংখ্যার সমান হবে কিনা সন্দেহ। ফলে ভারতের বাইরে বিরাট সমর্থন ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের, ভারতের ভিতরেও। এখন নেই কেন? কারণ সেই আগের মতো পরপর বিশ্বকাপ জিততেছে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলে খেলার জগতের এসব সমর্থকদের সমর্থনের গুরুত্ব নেই। কারণ সাধারণত তারা বিজয়ীর পক্ষে থাকে। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের যত সমর্থন, ক্ষমতায় না থাকলে কি থাকবে?
মানুষ যে বিজয়ীদের পক্ষে থাকে তার একটা মনস্তত্ত্ব সুবিধা নেয়া, লুটপাট করা। কিন্তু যারা লুটপাট করে না, তারাও বিজয়ীর পক্ষে থাকে কেন? কারণ সারাজীবন পরাজিত হতে হতে, বিজয়ীর পক্ষে থাকা তার সুখ। নিজেকে ঐটুকু সময় বিজয়ী মনে করে, সে আত্মাকে শান্তি দেয়। না হলে পরাজিত মানুষ বাঁচবে কী করে এত হতাশার মধ্যে। খেলার জগতে মানুষের এই আত্মতৃপ্তি লাভ, খানিক উদ্দীপনাকে নিয়ে যে বিরাট বেচাকেনা হয় সেটাই আমরা বুঝি না। আমাদের খানিক উত্তেজনাকে পুঁজি করে টাকার পাহাড় বানাচ্ছে খেলার জগতের ব্যবসায়ীরা। আমরাই সে সুযোগ করে দিচ্ছি, কারণ আমাদের আফিম খাইয়ে রাখা হচ্ছে। ধর্মের আফিম যেমন।
যদি আমরা আফিমের নেশায় বুদ হয়ে না থেকে, অন্যদের বিজয়ে মাতোয়ারা না হয়ে, নিজেরা পক্ষ বিপক্ষ সেজে নিজেদের মধ্যে নোংরাভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি না করতাম, যদি আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবের লড়াইটা লড়বার জন্য এগিয়ে যেতাম; আমাদের অনেক হতাশা বাস্তবিক কেটে যেতো। সকলের জীবনে তুলনামূলকভাবে অনেক সাফল্য আসতো। কিন্তু শত্রুপক্ষ তা চায় না বলে, আমাদের যুক্তিহীন সস্তা আবেগে বুদ করে রাখে। আগে যা করতো ধর্ম ব্যবসায়ীরা, এখন তা করে কর্পোরেট দালাল আর পুঁজির মালিকরা। প্লাটো শাসকদের পক্ষে বলেছিলেন, নাটক দরকার নেই। নাচ বরং ভালো। নাচ কথা বলে না। নাটক কথা বলে, বিদ্রোহ করতে শেখায়। রোম সাম্রাজ্য তাই নাটককে বা অভিনেতাদের সম্মান দেয়নি। মাতামাতি করেছে খেলাধূলা নিয়ে। গ্লাডিয়টরদের যুদ্ধ বা সিংহ আর মানুষের নিষ্ঠুরতম লড়াই দেখতে হাজার মানুষের জন্য বিরাট ক্লোসিয়াম বানাতো। লক্ষ লক্ষ মানুষ সিংহ আর মানুষের লড়াই দেখে উত্তেজিত হতো। সভ্য মানুষেরা এখন উত্তেজিত হয়, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার লড়াই দেখে। ফুটবল খেলা দেখে নয়, খেলা দেখতে তারা যায় না। যায় লড়াই দেখতে। খেলা দেখতে গেলে তো, যারা ভালো খেলবে তাদের প্রশংসা করবে, আগেই কারো পক্ষ নিয়ে বসে থাকবে না।
ব্রাজিল আর্জেন্টিনার যেমন অন্ধ সমর্থক আমাদের বিরাট জনতা, তেমন ভাবেই রাজনৈতিক দলের অন্ধ ভক্ত হিসেবে তারা সুবিধাজনকভাবে পক্ষ বিপক্ষ বেছে নেয়। নিজের দলের ছাড়া আর কারও সামান্য ভালো দেখতে পায় না। বিচার করবার ক্ষমতাকে বিসর্জন দিয়েছে তারা, রাজনৈতিক দলের অন্ধ ভক্ত হতে গিয়ে। ঠিক আবার খেলার মাঠেও। রাজনীতির মাঠে সোচ্চার হওয়া, যুক্তিবাদী হওয়া আর কিছু না হোক করোনাকে মোকাবেলা করার জন্য খুবই দরকার।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক