রহস্য
হুমায়ূন আহমেদপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০১৭
রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু প্রায়ই এরকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়। গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, তার ঘরে একটা তক্ষক আছে। সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিটিনে তিনবার ডাকে। আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম। এরকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?
জি না।
একরাত থাকেন আমার বাসায়, নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটা। ঘড়ি ধরে বসে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে।
আরে দূর কী যে বলেন!
ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেন। চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দ্যাখা। পৃথিবীটা এরকম যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় না। ভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?
হ্যাঁ, চিনি।
তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজের কানে শুনেছেন। বলেছেন, একটা নিউজ করবেন।
ভালোই তো। নিউজ হবার মতো খবর।
আপনি আসেন না ভাই থাকেন একরাত। নিজের কানে শুনবেন।
আমাকে শোনালে কি হবে?
আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচার। আপনাদেও কথার একটা আলাদা দাম।
তাই নাকি?
আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না।
এই জিনিসটা নিয়ে খুব হই চই করছেন মনে হচ্ছে?
না, হই চই কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেন। বাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নজমুল হুদাকে চেনেন?
জি না।
উনিও এসেছিলেন। খুব মাইডিয়ার লোক। আপনি আসুন না।
আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে।
ভদ্রলোকের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি মুখভর্তি করে হাসলেন। টেনে-টেনে বললেন, চলেন চা খাই।
না, চা খাব না।
আরে ভাই আসেন না। প্রফেসর মানুষ, আপনাদের সঙ্গে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার।
ভদ্রলোক হা-হা করে হাসতে লাগলেন। যেতে হলো চায়ের দোকানে।
চায়ের সঙ্গে আরকিছু খাবেন? চপ?
না।
আরে ভাই খান না। এই এদিকে দুটো চপ দে তো। এখন ভাই বলেন, কবে যাবেন?
আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলে দেব একদিন।
চা খেতে খেতে ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটি রহস্যের কথা শুরু করলেন। নাইনটিন সিক্সডঁতে তিনি বরিশালের পিরোজপুরে থাকতেন। তার বাসার কাচে একটা বড় কাঁঠাল গাছ ছিল। অমাবস্যার রাতে নাকি সেই কাঁঠাল গাছ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত। আমি গম্ভীর গলায় হয়ে বললাম, সেই কান্নারও কি কোনও টাইম ছিল? নির্দিষ্ট সময়ে কাঁদত? আপনার তক্ষকের মতো?
ভদ্রলোক আহত স্বরে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
বিশ্বাস করব না কেন?
আমি কান্নার শব্দ গোটাটা টেপ করে রেখেছি। একদিন শোনাবো আপানাকে।
ঠিক আছে।
বরিশালের ডি সি সাহেবও শুনেছেন। চেনেন উনাকে? আসগর সাহেব। সিএসপি। খুব খান্দানি ফ্যামেলি।
না, চিনি না।
ডিসি সাহেবের এক ভাই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিরাট অফিসার।
তাই বুঝি?
জি। উনার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। খুব খাতির যতœ করলেন। গুলশানে বাসা। তিনতলা। উনি থাকেন এক তলায়। ওপরের দুটো তলা ভাড়া দিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমার প্রায় এক ঘণ্টা সময় নষ্ট করে বিদায় হলেন। আমার মায়াই লাগল। ইন্ডেনটিং ফার্মে সামান্য একটা চাকরি করেন। দেখেই বোঝা যায় অভাবে পর্যুদস্ত। চোখের দৃষ্টি ভরসা হারা। বসয় এখনও হয়তো ত্রিশ হয়নি কিন্তু বুড়োটে দেখায়। বিচিত্র চরিত্র।
মাসখানেক তার সঙ্গে আমার দেখা হলো না। তার প্রধান কারণ, যে সব জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হবার সম্ভাবনা সেসব জায়গা আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করেছি। নিউমার্কেটে আড্ডার জায়গাটিতে যাই না। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এই লোকটি পিচ্ছিল পদার্থ, সে গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাবে। আর ছাড়ানো যাবে না। কিন্তু তবু দেখা হলো। একদিন শুনলাম সে ইউনিভার্সিটি ক্লাবে এসে খোঁজ নিচ্ছে। ক্লাবের বেয়ারা বলল, গত কিছুদিন ধরে নাকি সে নিয়মিতই আসছে। কী মুসিবত।
একদিন আর এড়ানো গেল না। ভদ্রলোক বাসায় এসে হাজির।
কী ভাই, আপনি তো আর এলেন না?
কাজের ব্যস্ততা...
আজ আপনাকে নিতে এসেছি।
সে কি?
কবি শামসুল আলম সাহেবও আসবেন।
তাই বুঝি?
ডৎ। চিনেন তো শামসুল আলম সাহেবকে? দুটো কবিতার বই বেরিয়েছে। পাখির পালক আর অন্ধকার জ্যোৎ¯œা।
তাই বুঝি?
জি। আমাকে দুটো বই-ই দিয়েছেন। খুবই বন্ধু মানুষ। বাড়ি হচ্ছে আপনার ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা।
ও।
উনার ছোট ভাইও গল্পটল্প লেখেন। আরিফুল আলম।
গেলাম তার বাসায়। ঝিকাতলার এক গলিতে ঘুপসি মতো দু’কামরার বাড়ি। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে সময়নিষ্ঠ তক্ষকের ডাক শোনার জন্যে। কত রকম যন্ত্রণা যে আছে পৃথিবীতে।
ভদ্রলোক আমাকে ঘরে বসিয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। মহিলার হাতের সযতœ স্পর্শ আছে। ভদ্রলোক বিবাহিত জানতাম না। এ নিতে তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন। অল্প বয়েসী তরুণী এবং অসম্ভব রূপবতী। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম।
আমার স্ত্রী লীনা। আর লীনা, উনি হুমায়ূন আহমেদ। এর কথা তো তোমাকে বলেছি। উনি লেখেন টেখেন। ছাপা হয়।
লীনা হাসিমুখে বলল, জি আপনার কথা প্রায়ই বলে।
লীনা একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।
লীনা চলে গেল ভেতরে। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, লীনার গল্প-উপন্যাস লেখার শখ আছে। কয়েক দিন আগে সাপ নিয়েও একটা গল্প লিখেছে। মারাত্মক গল্প ভাই। আপনাকে পড়ে শোনাতে বলব। আমি বললে পড়বে না। আপনিও কাইন্ডলি একটু বলবেন। রিকোয়েস্ট করবন।
আমি বললাম, গুণী মহিলা তো।
ভদ্রলোকের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তা ভাই, কথাটা অস্বীকার করব না। গানও জানে। নজরুল গীতি। ভালো গায়। বাড়িতে টিচার রেখে শিখেছে।
তাই নাকি?
জি, শোনাবে আপনাকে। একটু প্রেসার দিতে হবে আরকি। আপনি একটু রিকোয়েস্ট করলেই শোনাবে। কাইন্ডলি একটু রিকোয়েস্ট করবেন।
ঠিক আছে, করব।
চা এসে গেল। চায়ের সঙ্গে বড়া জাতীয় জিনিস। বেশ খেতে। আমি বললাম, বড়া এগুলি? ডালের নাকি?
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হাসলেন, নারে ভাই, ফুলের বড়া। হা-হা-হা। কত রকম অদ্ভুত রান্না যে লীনা জানে। মাঝে মাঝে এত সারপ্রাইজ হই। খেতে কেমন হয়েছে বলেন? চমৎকার না?
ভালো, বেশ ভালো।
আরেকদিন আসবেন, চাইনিজ স্যুপ খাওয়াব। চিকেন কর্ন স্যুপ। চাইনিজ রেস্তোরাঁর চেয়ে যদি ভালো না হয় তাহলে কান কেটে ফেলবেন। হা-হা-হা। থাই স্যুপও জানে।
আমি মেয়েটির লেখা একটি ছোটগল্প শুনলাম। দুটি কবিতা শুনলাম। তিনটি নজরুল গীতি শুনলাম। ভদ্রলোক মুগ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। বারবার বললেন, ইস্্ শামসুল আলম সাহেব আসলেন না। দারুণ মিস করলেন, কি বলেন ভাই?
রাত ১১টার দিকে বললাম, তা হল আজ উঠি?
তক্ষকের ডাক শুনবেন না?
আরেকদিন শুনব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলবেন না যেন ভাই। আসতেই হবে।
ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। রাস্তায় নেমেই বললেন, আমার স্ত্রীকে কেমন দেখলেন ভাই?
খুব গুণী মহিলা।
ভদ্রলোকের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ধরা গলায় বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা। ঠিক না ভাই?
আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, গরিব মানুষ, স্ত্রীর জন্য কিছুই করতে পারি না। কিন্তু এসব নিয়ে লীনা মোটেও মাথা ঘামায় না। বড় ফ্যামিলির মেয়ে তো। ওদের চাল-চলনই অন্যরকম। আমরা খুব সুখি।
আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভাগ্যবান আপনি।
ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন। যেন আবেগে কেঁদে ফেলবেন। ভাই, আরেকদিন কিন্তু আসতে হবে। তক্ষকের ডাক শুনতে হবে। আসবেন তো? প্লিজ। লোকজন এলে লীনা খুব খুশি হয়।
তক্ষকের ডাকের মতো কত রহস্যময় ব্যাপারই না আছে পৃথিবীতে।
শ্রেষ্ঠ গল্প থেকে