রহমান মুফিজের কলাম ‘বাউলের পৃথিবী এক সহজিয়া জগৎ’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২৩
অনুভূতিসম্পর্কিত দুনিয়ার সব সঙ্কট মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্তীয় ভদ্রলোকির মধ্যে যে কী পরিমাণ অন্ধতা, কট্টরতা, কূপমণ্ডুকতা, ভণ্ডামি, বেঈমানি ও সুবিধাবাদিতা লুকিয়ে থাকে, তা ইতিহাসের পরতে পরতে আপনি ‘সোনার অক্ষরে’ দেখতে পাবেন। ‘মধ্যবিত্ত’ এই শ্রেণিটা পৃথিবীতে রীতিমতো ধর্ম হয়ে উঠতে চায়। আর তার ধর্ম হয়ে ওঠার প্রধান নিয়ামক বস্তু হলো ‘অনুভূতি’।
সাহিত্যিক মোতাহার হোসেনের বিখ্যাত উক্তি `ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম`— এই কথাটাকে আপনি এইভাবে সাজাতে পারেন, ধর্ম ধর্মান্ধ লোকের অনুভূতি আর অনুভূতি মধ্যবিত্ত লোকের ধর্ম। আরেকটু খুলে বলি, ধর্মান্ধ লোকের সমন্ত অনুভূতি ক্রিয়াশীল থাকে তার ধর্মকে ঘিরে। আর মধ্যবিত্তের অনুভূতিকে ঘিরে গড়ে ওঠে তার সমস্ত ধর্ম ।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি-সমাজ সবকিছুর বিশেষ বিশেষ উপাদানকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্তের কাল্ট যেন গড়ে তোলাই লাগবে। না হলে সমাজে তার আত্মপরিচয় সঙ্কট প্রবল হয়। এর মধ্যে ঘাটের মড়া ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যপ্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এইসব অনুভূতিসম্পর্কীয় উল্লম্ফনের যেন বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।
নিম্নবিত্ত বা প্রান্তিক মানুষের অনুভূবিষয়ক ‘রাজনীতি’ খুব একটা নেই বললেই চলে। মানে অনুভূতি নিয়ে তার খুব একটা মাথাব্যথা নেই আর কি। এমন কি সাধারণ মানুষের যে কালচার, যে ধর্ম, সেই ধর্মকে ঘিরেও প্রান্তিকদের অনুভূতিবিষয়ক রাজনীতি অনুপস্থিত ছিল বহু বহু বছর। ফলে আপনি দেখতে পাবেন, গাঁ-গেরামের সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবনের যাপনবৈচিত্র্য রয়েছে।
সংসারী, সন্যাসী, বাউল, ভবঘুরে, ভাদাইম্যা, নানা প্রতিভার শিল্পী, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সব ধরনের মানুষের একটা সামাজিক সংহতি প্রান্তিক মানুষের ঐতিহ্যের মধ্যে পাওয়া যাবে। তারা ধর্ম নিয়ে, দর্শন নিয়ে, ইশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, নারী-পুরুষ, ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, এমন কি নানা জ্ঞানভিত্তিক বিষয় নিয়েও সহজিয়া বাহাসে স্বচ্ছন্দ। ভিন্ন ভিন্ন রুচি ও বিশ্বাস নিয়েও তারা সমাজে সম্মানের সঙ্গে সহাবস্থান করে। বাহাসে তারা এত প্রাণবন্ত যে, প্রতিটি আলাপ থেকেই গভীর জ্ঞানরস আস্বাদনে তাদের মধ্যে আন্তরিক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। মতের অমিল হলে তারা একজন আরেকজনের দিকে তেড়ে যায় না। ভিন্নমতকে সমাজচ্যুত করার প্রবৃত্তি নাই। ‘বারো জাত না হইলে গ্রাম হয় না’ এমন সামাজিক বিশ্বাসকে লালনের মধ্য দিয়ে সামাজিক বৈচিত্র্যকে অনায়াসের তারা অনুমোদন করে।
দেশের সাংস্কৃতিক নির্মাণ, অর্থনৈতিক কাঠামো ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে প্রান্তিক শ্রেণি-বিশেষ করে কৃষক, ক্ষেত-মজুর, জেলে, তাঁতি, কামার-কুমারের কর্তৃত্ব ছিল। কর্তৃত্ব মানে বোঝাতে চাইছি টোটাল সামাজিক কাঠামোতে এই শ্রেণিটারই নেতৃত্ব ছিল। তখন সমাজে বিভেদের রাজনীতি ক্রিয়াশীল ছিল না। কিন্তু যখন কয়েক দশকে সমাজের নেতৃত্ব পুরোমাত্রায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে চলে আসলো তখনই সমস্ত বিভেদের রাজনীতি ক্রিয়াশীল হয়ে উঠলো।
সাধারণ খুনসুটি বা অবৈরি দ্বন্দ্বগুলো হয়ে উঠলো বৈরী। সমাজকে চরম মাত্রায় অধিকার করে বসলো মধ্যবিত্তের অভিমান। মানে জাত্যাভিমান। তার আইডেন্টিটির রাজনীতি দাঁড়িয়ে গেলো তার ভাষা, ছলনা, বেঈমানি, বাটপারি, সুবিধাবাদিতা ও চরম অবিমৃষ্যকারীতার ওপর। এই সমস্ত কিছুকে জায়েজ করবার সে যে হাতিয়ার খাড়া করলো তার নাম ‘অনুভূতি’। তার যাপনের স্তরে স্তরে এই অনুভূতি সরিসৃপের মতো বাস করে। পান থেকে চুন খসলেই সে ফনা তোলে। ছোঁবল দিয়ে মারে প্রতিবেশকে। সমাজের নেতৃত্বশীল মধ্যবিত্তের এই প্রবৃত্তি এখন ছড়িয়ে পড়ছে প্রান্তিকদের মধ্যেও।
আসল কথায় ফিরি। কথা বলছিলাম, নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট (কবাট)’ গানে এ আর রহমান নামের এক ভিন্নভাষী ব্যক্তির নতুন সুরারোপ নিয়ে। বাঙালি মধ্যবিত্তের কেউ কেউ মনে করছেন এ আর রহমান ওই গানে ভিন্ন সুর দিয়ে বাঙালির সংগ্রামী প্রেরণাকে হত্যার প্রয়াস চালিয়েছেন। বাঙালির অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। যদিও বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা অংশ সেটা মনে করছে না। তো, এ আর রহমানের সুরের পক্ষে-বিপক্ষে এই মুহূর্তে বাঙালি মধ্যবিত্ত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আমি মূলত এ সঙ্কটটাকে দেখছি ‘মধ্যবিত্তীয় সঙ্কট’ হিসেবে। এ সঙ্কট জাতীয় জীবন তো নয়-ই, কোনো অঞ্চলগত সাধারণ মানুষের জীবনেও কোনো প্রভাব বা আবেদন তৈরি করবে না। প্রান্তিক কোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠী তাদের সামাজিক সঙ্কটে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানকে আদৌ প্রেরণাদায়ী শক্তি হিসেবে কখনো ‘মধ্যবিত্তীয় মাত্রায়’ ব্যবহার করেছে কি না জানা নেই। আমার বিশ্বাস তাদের সহজিয়া জীবনে এমন ক্লাসিক গানের আবেদন খুব একটা নেই। সেজন্যই বলছি, এ গানের সুর নিয়ে টানাটানির বিষয়টা আসলেই ‘মধ্যবিত্তীয়’ ফ্যাসাদ।
লালন, হাসন, রমেশ শীল, রাধারমন, উকিল মুন্সী, আব্দুল করিম— এদের মতো কীর্তিমান লোকশিল্পীদের গানের দিকে তাকান। এছাড়া শত শত লোকশিল্পীর রচিত ও সুরারোপিত শত-সহস্র গান শত শত বছর ধরে লোকমুখে গীত হচ্ছে। গাইছে, শুনছে প্রান্তিক মানুষেরাই। জন থেকে জনে, লোক থেকে লোকালয়ে ছড়াতে ছড়াতে কতজন কতভাবে এইসব গান গাইছে তার ইয়াত্তা নেই। গাইতে গাইতে সুর সুরের জায়গায় নেই, কথা কথার জায়গায় নেই। একটা গানে একাধিক সুর, একটা সুরে একাধিক কথা আপনি খুঁজে পাবেন। কই- কোনো লোকগায়ক, লোককবি, কোনো লোকশিল্পী কখনো কারও বিরুদ্ধে ‘বিকৃতির’ অভিযোগ তোলেন নাই তো। কোনো সুর, কোনো কথাকে বাতিল ঘোষণার দাবি তোলেন নাই তো। বলেন নাই কেউ কারও অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আপনি তুলছেন, কারণ আপনি মধ্যবিত্ত। আপনি ক্লাসিক। আপনি এস্থেটিক। আপনার অনুভূতির দাম লাখ টাকা যে!
প্রখ্যাত শিল্পী কালীকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?
শাহ আবদুল করিম বললেন, কথা বোঝা গেলেই হইল। আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।
কালীকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনার সৃষ্টি… আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না… এটা কোন কথা… এটার কোন অর্থ আছে…?
শাহ আবদুল করিম বললেন, তুমি তো গান গাও… আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো… ধরো তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে… গাইতে পারবে…?
কালীকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, না, পারবো না।
শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, আমি পারবো। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই। সেজন্যই বললাম, শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।
কালীকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেন, সেই আদর্শটা কি?
শাহ আবদুল করিম আবার হেসে বললেন, একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।
বাউলের পৃথিবী! এক সহজিয়া জগৎ। ফ্যাসাদ নয় সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, সহাবস্থানের জগৎ। কোনো মানুষের সৃষ্টিকে, কোনো মানুষের পছন্দকে উড়িয়ে দিয়ে, অনুভূতির জিগির তুলে কাউকে ‘হাতকড়া’ পরিয়ে সে পৃথিবী নির্মাণ হবে না বন্ধু। বরং আমি তো ভাবছি, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানে এ আর রহমানের সুর নিয়ে যে অনাবশ্যক ‘চেতনা’র দিকদারি ফলাচ্ছেন, সে দিকদারি যদি একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে ফলাতেন তখন বুঝতাম আপনি সৎ মধ্যবিত্ত।
একটা দশক যেভাবে ভাত ও ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে, বাকস্বাধীনতা হরণ করে গোটা রাষ্ট্রকে রুদ্ধ কারাগার বানিয়ে রাখা হয়েছে তার বিরুদ্ধে যদি বুক চেতিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে একবার তীব্র চিৎকারে গাইতেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট, রক্তজমাট শেকল পূজার পাষাণ বেদি... ’ তাহলে বুঝতাম এই গান আসলেই আপনার প্রেরণা। এই গান আসলেই আপনার প্রকৃত ‘অনুভূতি’।
লেখক: কবি