
রশীদ করীম
রশীদ করীমের লাঞ্চবক্স
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০১৯
যারা রশীদ করীমের সান্নিধ্য লাভ করেছেন, তারা মাত্রই জানেন, জীবনমুখী এ-মানুষটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অন্যের মাঝেও খুব সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারতেন। রশীদ করীমের সাহিত্য কর্মও যেন তার ব্যক্তিসত্তারই অনুক্রমনিক। তার উত্তম পুরুষ থেকে শুরু করে প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, শ্যামা, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত এবং সর্বশেষ উপন্যাস লাঞ্চবক্স— এই ছড়িয়ে রয়েছে এই পরিচয়। কোনো জীবনই নিষ্কলুষ নয়। দুঃখ, হতাশা, ক্লেদ যন্ত্রণা থাকবেই। রশীদ করীমের উপন্যাসের চরিত্রগুলোও সেসব থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনেরই জয়জয়কার। তার এই প্রাণপ্রবাহতা এই জীবনসঞ্জীবনী রস সব উপন্যাসেই কম বেশি উপস্থিত থাকলেও লাঞ্চবক্সের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় এ কারণে, এ উপন্যাসটি তিনি লিখেছেন জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে, যখন তার বয়স সত্তরের দ্বারপ্রান্তে।
এ উপন্যাসের প্রতি তার নিজেরও রয়েছে বিশেষ পক্ষপাত। প্রথম সাক্ষাতের দিনই তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন, লাঞ্চবক্স পড়েছি কীনা! সলজ্জ উত্তর ছিল, ‘না’। ‘পড়ো দেখো, পড়ে দেখো।’ প্রাণিত করেছিলেন তিনি। পড়া আর হয়ে উঠছিল না। বাংলাদেশের বইয়ের মার্কেটে তো আবার বাংলাদেশের লেখককুল নিষিদ্ধ। ভারতের যে কোন অখ্যাত লেখকের বই হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলন ছাড়া বাংলাদেশের যত বড় লেখকই হোন না কেন, তাদের বই খুঁজে পাওয়াটা ভাগ্যেরই ব্যাপার। তাছাড়া ভেতর থেকে বইটি পড়ার তেমন উৎসাহও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বইয়ের নামের মধ্যে কেমন একটা স্কুল স্কুল গন্ধ! আর এ তো শেষ বয়সের লেখা! এ আর কি পড়বো! কী যে ভুলের অন্ধকারে ছিলাম, সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত রশীদ করীমের উপন্যাসসমগ্র হাতে আসার পর তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল!
১২৩০ পৃষ্ঠার সুবিশাল বইটির প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো বারবারই পড়া। তাই ভাবলাম, শুরু করা যাক না শেষের দিক থেকে। আর একেবারে শেষের উপন্যাসটিই হলো লাঞ্চবক্স। এক পৃষ্ঠা পড়ার পর, সেই যে পড়ে গেলাম পড়ার চক্করে, পুরোটা না পড়ে আর ওঠা গেল না। শুরু করেছেন তার সেই চিরাচরিত খানিকটা স্যাটায়ার, খানিকটা কৌতুক, খানিকটা রহস্যের মায়াজাল বিস্তারকারী অভিজাত সরল গদ্যে— ‘আমি যে গল্পটি বলতে বসেছি সেটি শুনতে ইচ্ছুক হবেন ক’জনা বলতে পারবো না। কারণ গল্পটিতে রোমান্সের যে অংশটুকু আছে, তা খুবই বাসি আর যতোটুকু অ্যাডভেঞ্চার আছে, খবরের কাগজগুলো নিত্যই তার ঢের বেশি পরিবেশন করছে। এই কাহিনীর মধ্যে খানিকটা গোয়েন্দা কাহিনীর রহস্য আছে। এবং লেখাটিতে যে কমেডিটুকু আছে তা পাঠ করে আপনাদের হাসির বদলে কান্নাও পেতে পারে।’
হাসি কান্না সেটা আপেক্ষিক ব্যাপার। তবে পড়ে যে প্রীতিকর স্বাদ এবং উপলব্ধির আস্বাদ পাওয়া যায়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আধুনিক উপন্যাসের যা যা বৈশিষ্ট্য আছে, তা ধারণ করেই এই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়েছে উত্তম পুরুষ নায়কের জবানীতে। নায়ক কখনো কাহিনী বর্ণনা করে যান, কখনো আত্মবিশ্লেষণে মেতে ওঠেন, কখনো অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে অন্যান্য চরিত্রগুলোর কার্যকারণের বর্ণনা দেন, আত্ম স্পর্শ করেন।
উপন্যাসের পটভূমি একটি ট্রেন। ট্রেনে আমাদের নায়ক চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছেন। তা ভ্রমণটা স্বাভাবিকই ছিল, যে ঘটনা ঘটছিল, সেসব ঘটতেই পারে। এই যেমন, ‘আমার আসনে ফিরে এসে দেখি, আমার মুখোমুখি আসনটিতে ভারি সুন্দরী এক মহিলা বসে আছেন। আমার সঙ্গে কথা শুরু করলেন না বটে, কিন্তু সামান্য একটু হাসলেন। তারই মধ্যে আভাস ছিল, সাড়ে ছ’ ঘন্টার এই জার্নিতে তো আর ওভাবে চুপ করে বসে থাকা যায় না, দু একটি কথাও হবে।’ কিন্তু এটা যে নায়কের দুরাশা, বোঝা গেল একটু পরই, কালেক্টর এসে সেই সুন্দরী মহিলাকে বললেন, কিছু মনে করবেন না। একটা ভুল হয়ে গেছে। আসলে পাশের কম্পার্টমেন্টে এই একই নম্বর সিটটি আপনার।
ভদ্রমহিলা কিছু মনে করলেন না। মালপত্র নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু মনে করলেন আমাদের নায়ক। এ রকমই চলছিল, একটি ট্রেনে যে রকম ঘটনা ঘটে থাকে: এর ওর মধ্যে এ গল্প সে গল্প। পলিটিক্যাল তর্ক, ‘এ আলোচনা থাক। এখন আর একজনের শাসনামল। রেডিও-টেলিভিশন দেখে বুঝতে পারবেন শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন ছিলেন? স্মৃতি থেকে তাকে মুছে ফেলার জন্যে কিনা করা হচ্ছে? শেখ সাহেবের নাম উচ্চারণ করাও মানা।’ এ আলোচনার সূত্র ধরে বোঝা যাচ্ছে উপন্যাসের ঘটনাকাল। পরে লেখক আরো স্পষ্ট করেছেন, ‘যে সময়কার ঘটনা বিবৃত করছি, সেটা শেখ মুজিবের পরবর্তী শাসনামল। দেশে কি সব ঘটছিল। তিনি বসিয়ে দিলেন সান্ধ্য আইন।’ সে সান্ধ্য আইনের ভয়েই নায়ক এবং তার পার্শ্ব যাত্রী দুজনই চিন্তিত, রাতে ঢাকায় পৌঁছানোর পর কার্ফুর মধ্যে বাড়ি যাবেন কি করে? এ উদ্বেগটুকুও ট্রেন যাত্রীদের মধ্যে থাকতেই পারে। সময়টা যে রকম ছিল, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি সামান্য লাঞ্চবক্স পুরো প্রেক্ষাপটকেই পাল্টে দিল। আমাদের নায়কও যেমন আর সাধারণ রইলেন না, উপন্যাসও রহস্য-রোমাঞ্চ-আর নাটকীয়তায় নতুনভাবে উপভোগ্য হয়ে ওঠলো।
লাকসাম স্টেশন থেকে ট্রেন যখন নতুনভাবে যাত্রা শুরু করলো, তখনই রেলের বেয়ারা এসে লেখকের সামনে টেবিলের ওপর একটি লাঞ্চ বক্স রাখলো। ‘আমার কাছে রাখলো কেন? বেয়ারাটি চলে যাচ্ছিলো। খপ করে তার হাত ধরে ফেলে জিগ্যেস করলাম, আমাকে কেন? বেয়ারা সুদূরের কোনো কম্পার্টমেন্টের দিকে একটি ইঙ্গিত করে বললো, ঐখানের এক বেগম সাহেব পাঠিয়েছেন।’
নায়ক ভাবতেই পারেন, ভুল টিকিটে তার সামনে যিনি বসেছিলেন, সেই ভদ্রমহিলাই তার জন্যে লাঞ্চ বক্সটি পাঠিয়েছেন। ইতিমধ্যেই এক বোরখাওয়ালী নারীর অস্তিত্ব ঘটেছে উপন্যাসে। যিনি আমাদের নায়কের দৃষ্টিগোচর হয়েছেন। ঘটনাক্রমেই ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পতিত হলো। যাত্রীদের সবাইকে নামতে হলো ট্রেন থেকে। লাঞ্চ বক্সে লাঞ্চ পাঠানোর জন্যে সেই ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে লেখককে বিব্রত হতে হলো। জানা গেল লাঞ্চ বক্সটি ঐ ভদ্রমহিলা পাঠান নি। তবে? ভদ্রমহিলার পাশে বসা সেই বোরখাওয়ালী খিল খিল করে নায়কের কথা শুনে হেসে ওঠলেন। ২০ বছর পর এরকমই নাটকীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল কেয়ার সঙ্গে! নায়ক এক সময় কেয়ার রূপের পাগল ছিলেন। সে টানেই ওর গান শুনতে যেতেন। কেয়ার রূপের পাগল ছিল অনেকেই। সে পাগলদেরই একজন কেয়াকে না পেয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, সেজন্যেই আজ ওকে বোরখা পরে থাকতে হচ্ছে। কেয়া এক মুহূর্তের জন্যে বোরখা সরালে নায়ক আবিষ্কার করলেন ওর কুৎসিত মুখ। কি করে হলো জানতে চাইলে কেয়া জানাল, সেই বদমাশ লোকটা অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল। এরপর নাকি ওর প্রতি স্বামী মোতাহারের ভালোবাসা আরও বেশি বেড়ে গেছে।
এটাই লেখক রশীদ করীমের বৈশিষ্ট্য। চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি তৈরি করতে চান আশার বৈতরণী। এ পর্যায়ের আলাপে লাঞ্চ বক্সের প্রসঙ্গটা চাপা পড়েই থাকে। আরো অনেক বিষয়ই থেকে যায় অমীমাংসিত। সে টানেই কেয়ার কাছে দ্বিতীয়বার আসতে হয় নায়ককে। এ পর্যায়ে কেয়া পাত্তা দেয় না। নায়ক ক্ষুদ্ধ হলে অবগুন্ঠনবতী বোরখা খুলে ফেললো। নায়ক দ্বিতীয়বারের মত বিস্মিত হলো, চমকিত হলো। মুখে বোরখা ফেলতে ফেলতে তিনি বললেন, আমি কেয়া নই। আমার নাম নাদিরা।
এই সেই নাদিরা একদিন নায়কের দ্বারা চরমভাবে উপেক্ষিত হয়ে যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অনন্য উচ্চতায়। পি এইচ ডি ডিগ্রী গ্রহণ করে বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে আর রূপে তো অনন্য ছিল সে আগে থেকেই। এই যে একই জায়গায় একই রকম বোরখার আড়ালে দুজন নারী, এটা কিভাবে সাধিত হলো! তবে কি হ্যালুসেশন! নাকি প্রতীকী রূপ। একজন ধরে আছে পংকিল অতীত, কেয়া— এসিড দগ্ধ। আরেক জন অপরূপা, নাদিরা— নায়কের জন্যে এ জীবনে বিয়ে করে নি, এমন কি নায়ক ছাড়া আর কাউকে নিজের মুখ দেখাতেও রাজী নন। একজন বোরখা পরেছেন নিজের কুৎসিত সত্তাকে আড়াল করার জন্য, আর একজন বোরখায় মুখ ঢেকেছেন নিজের সৌন্দর্যকে আড়াল করার জন্য। শেষপর্যন্ত দুজনই নায়কের কাছ থেকে দূরেই থেকে যায়। আর দূরে থাকাটাই যে আকর্ষণ এবং প্রেমের টান, সেটা আমরা উপন্যাসের একেবারে শেষে গিয়ে পাই, নায়কের স্ত্রী নয়ন নায়ককে চা দিতে দিতে বললেন, ‘নাদিরার কথা আমিও শুনেছি। তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়নি বলে তুমি মনে করেছো খুব ঠকে গেলে। কিন্তু যদি তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হতো, আর আমার সঙ্গে হতো না, তাহলেও এতো বছর পর আজ তোমার মনে হতো, খুব ঠকে গেলে। এই বলে তিনি একটু হাসলেন।’
আর লাঞ্চ বক্সটা কে পাঠিয়েছিল? হুঁ! নায়ক কিন্তু সে উত্তর ঠিকই খুঁজে পেয়েছেন। পাঠক না হয় বইটা পড়েই সে উত্তর খুঁজে নেবেন! এই আলোচনা পড়ে এটা ভাবার কারণ নেই যে, লাঞ্চ বক্স শুধু হৃদয়বৃত্তির গল্প— সূক্ষ্ম আঁচড়ে পচাত্তর-পরবর্তী সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাও এসেছে। এসেছে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রটি নিজের সবুজ রংটি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে সে আশংকাও! কেয়ার এসিড ঝলসানো মুখটি শুধু নায়ককেই চমকে দেয় না, বর্তমান সময়ের একটি তীব্র সামাজিক সংকট সম্পর্কে লেখক যেন আমাদের বিবেককেও উস্কে দেন। আর নাদিরা চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক আমাদেরকে জারিত করেন একটি শুদ্ধ শুভ্র অনন্ত প্রেমালোকে— যা চিরন্তন। যে অনুভূতি যুগ থেকে যুগে যুগে বয়ে বেড়াবে মানুষ। সে কারণেই জীবনবাস্তবতা-ভিত্তিক উপন্যাস না হয়েও লাঞ্চ বক্স বিশেষত্বের দাবীদার।
উপন্যাসে নাদিরা চরিত্রটি হয়তো আরো বিশ্বস্তভাবে অংকিত হতে পারতো। পারতো নায়কের স্ত্রী চরিত্রটিও আরো বিকশিত হতে। কিন্তু গঠনরীতির কারণে এসব ছোটখাটো দুর্বলতা প্রকটভাবে চোখে পড়ে না। শুরু থেকেই রশীদ করীম নতুন। তিনি আধুনিকতার নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন বাংলাদেশের উপন্যাসে। সর্বশেষ উপন্যাস লাঞ্চ বক্স-এও রয়েছে নিজেকে উতরানোর চেষ্টা।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রশীদ করীমের তুলনা হতে পারে না। শেষের কবিতার সঙ্গে তুলনা হতে পারে না লাঞ্চ বক্সেরও। কিন্তু একটা জায়গায় দুজনেরই দারুণ মিল, দুজনই জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে লিখেছেন টাটকা প্রেমের চিরসবুজ উপন্যাস— আসলে প্রকৃত লেখকের কাজই তো জীবনকে প্রণোদিত করা!
লেখক: কথাসাহিত্যিক