
মারিয়া সালাম
রমজানে শুধুমাত্র না খেয়ে থাকা এক ধরনের প্রহসন
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২৫
আমাদের ছোটবেলায় ঠিক এই রকম সময় রোজা শুরু হতো। সেসময় মে-জুনের দিকে যখন ভয়াবহ গরম পড়তো, আমরা রোজা রাখতাম। উত্তরবঙ্গের গরম, সেটা কী রকম হতে পারে, এসময় ঢাকার দিকে বসে বোঝা প্রায় অসম্ভব। আর এখানকার শিশুরা সেটা বুঝবেও না। আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন মফস্বলে ঘরে ঘরে এসি বা ফ্রিজ রাখার প্রচলন ছিল না। লোডশেডিং ছিল নিত্য ঘটনা আর বাসাবাড়িতে আইপিএস বা জেনারেটর থাকবে, সেটাও ছিল কল্পনাতীত।
স্কুল এখনকার মতোই লম্বা সময় বন্ধ থাকত। এই বন্ধের সময়টাতে আমরা বেশির ভাগ সময় মক্তবে পড়ে থাকতাম। মসজিদের বারান্দাজুড়ে লম্বা কাঠের টুল বিছানো থাকত, সেগুলোর ওপরে আমপারা বা কোরআন শরিফ রেখে আমরা সুর করে পড়ে যেতাম বিকাল অব্দি। যারা আমপারা পড়তো তাদের লক্ষ্য থাকতো, সেটা শেষ করে কোরআন ধরার। আর যারা কোরআন পড়তাম তারা যেকোনো মূল্যে তারাবির সাথে মিল রেখে খতম করতাম।
এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের জন্য, নিজেদের সক্ষমতা দেখানোর একটা ব্যাপার ছিল। সৌভাগ্য বলতে পারি যে, আমরা যে সমাজ কাঠামোয় বেড়ে উঠেছিলাম সেখানে সহপাঠীদের মধ্যে সক্ষমতা দেখানোর একমাত্র উপায় ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এগিয়ে থাকা। আমার মনে আছে, নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোরআন খতম করা এবং পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিসাসুল আম্বিয়া শেষ করার জন্য মক্তবের সহপাঠীরা একবার আমাকে পিটিয়েছিল।
দুপুরের দিকে মক্তবে থাকার আরেকটা বড় কারণ ছিল সম্ভবত মক্তবে লোডশেডিং হতো না, আমার ঠিক মনে পড়ছে না এইমুহূর্তে। তবে কখনোই আমি পাইনি।
বিকেলের দিকে রোদ কিছুটা পড়ে গেলে আমাদের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব এসে যেত। ছোলা, বেগুনি আর পিঁয়াজু ভাজার গন্ধে ম ম করতো চারদিক। ভাগ্য ভালো হলে কোনো কোনো দিন বিরিয়ানি রান্না হতো। তবে আমাদের মূল আকর্ষণ ছিল বরফ কেনা। মোড়ের মাথায় চটের ঝোলা দিয়ে ঢেকে রাখা বড় বড় বরফের চাঁই। আমরা পাত্র নিয়ে গিয়ে বরফ কিনে আনতাম শরবত বানানোর জন্য। লেবু ও চিনি দিয়ে বানানো হতো শরবত অথবা রুহ আফজা গোলানো হতো।
তবে, বরফ ছিল সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। এই গরমে সারাদিন পরে যখন মাগরিবের আজানের সাথে সাথেই বরফ মেশানো শরবতে চুমুক দিতাম, আমাদের আর কোনো ক্লান্তি থাকত না। ইফতার খেয়ে কিছুক্ষণ নিজেদের মতো পড়ালেখা করেই ছাদে বসে গল্পগুজব করতাম আর বাড়ির বড়রা চলে যেত রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে।
সেহরির সময় আমাদের কারো ডেকে তুলতে হতো না। আমরা নিজেরাই উঠে যেতাম কিভাবে যেন। সেহরির সময় তরুণরা জড়ো হয়ে ড্রাম পিটিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এলাকার লোকদের ডেকে তুলত। অবাক বিস্ময় আর উত্তেজনা নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে সেসব দেখতাম আর অপেক্ষা করতাম নাকে কখন সেদ্ধ ডালের গন্ধ এসে লাগবে। সেহরির জন্য খাবার আয়োজন ছিল খুব সাধারণ, গরম ভাত হলে ঘি, ডালভর্তা, ডিম ভাজা বা মুরগির মাংস। মাঝে মাঝে গরুর মাংস দিয়ে রুটি খেতাম।
সেসব রুটি রাতে তৈরি করে বড় কাপড় দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে রাখা হতো যেন কয়েক ঘণ্টা গরম আর নরম থাকে। খুব গরম পড়লে, রাতের ভাতে পানি দিয়ে রেখে দেয়া হতো সেহেরির জন্য। আমরা ডিম ভাজা দিয়ে পান্তা খেতাম।
শিশু বলেই হয়তো জীবনটা খুব সহজ ছিল, জীবনকে দেখা বা উপলব্ধি করার বিষয়টাও ভিন্ন ছিল। তখন রোজা মানেই ছিল অভুক্ত থেকে নিজের সক্ষমতার পরিচয় দেয়া। আমি রোজা রাখতে পারি বা ধর্মীয় গ্রন্থ শেষ করতে পারি, এতেই গর্ব ছিল। আমার ক`টি জামা ছিল বা বিলাসিতার জন্য কী কী আছে, এসব ছিল অতি তুচ্ছ ব্যাপার। বড়বেলায় যখন এই তুচ্ছ ব্যাপারগুলোই মানুষের সম্মান বা যোগ্যতা নির্ধারণের মাপকাঠি হয়ে উঠল, তখন রমজানের সময় শুধুমাত্র না খেয়ে থাকাটা এক ধরনের প্রহসন বলে মনে হতে থাকল।
কারণ, সিয়াম সাধনার অর্থ আমার কাছে যা, সেটা ইদানীং রোজা রাখলেও পালন হয় না, না রাখলে তো সেই প্রশ্নেই যেতে হবে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী