রমজান মাসে ইরানে কামানবাজি
ড. এলহাম মালেকজাদেপ্রকাশিত : মে ৩০, ২০২০
সূরা বাকারার ১৮৭ নাম্বার আয়াতে রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। রাতের শেষভাগে সেহরী এবং প্রথমভাগে ইফতার করার কথা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। রোজা রাখার এই বিষয়টি মূলত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ও নক্ষত্রের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। যখন সূর্যাস্ত যায় বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে যেমন আযান দেয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অবগত করা হয়। ইসলামের বিকাশ লাভের পর মুসলমান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো সরকারিভাবে বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে এবং তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করে। সেগুলোর মধ্যে একটি উন্নত এবং বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলো কামানবাজি। যা সমসাময়িক কালে প্রচলন করা হয় এবং এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণ সেহেরি ও ইফতার করতো।
এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে জনসাধারণ খুব সহজভাবে অবগত হলেও কাজটি সহজ এবং সস্তা ছিল না। তাছাড়া এই কামান-গোলা পরিচালনা করার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত জনশক্তি প্রয়োজন হতো। সুলতান নাছির উদ্দিনের সময়কালে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার প্রাদশিক সরকার গ্রহন করেন এবং সাংবিধানিক বিল্পবের পরে কামানবাজির এই বিভাগটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চলে যায়। কিন্তু আহমদ শাহ‘র সময়কালে সামানী শাসকগণ ইরানে আক্রমন দখল করলে এই কামানবাজি সমস্যার সম্মুখিন হয়। কেন্দ্রিয় সরকার সমস্ত রাজস্ব যুদ্ধের ব্যয় করেন এবং এই কাজে নিয়োজিত সকল কর্মচারীকে যুদ্ধের কাজে লাগানো হয়। রেজা শাহ‘র শাসন আমলে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার ও দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে অর্পন করা হয়। এরপর ১৩১০ শামসী সালের দেই মাসে (ইরানি মাসের নাম) প্রাদশিক সরকার আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসলে নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।
আনুসাঙ্গিক বিষয়বলি মাথায় রেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ১৩১৯ শামসী সাল পর্যন্ত ইরানে এই প্রথা চালু ছিল। ১৩২০ সালে ইরানে আযান দেয়ার প্রথা চালু করা হয় এবং ১৩২২ শামসী সালে রেডিওতে আযান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এই প্রবন্ধটিতে ইরানের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংগৃহীত বিভিন্ন নথি ও দলিল ব্যবহার করা হয়েছে। কামান ব্যবহারের পদ্ধতি বিশ্লেষণ রমজান মাসে সরকারি পদক্ষেপসমূহ, সমস্যাসমূহ এবং এর থেকে পরিত্রানের পদক্ষেপসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
রমজান মাসে রোজা রীতিনীতি পর্যলোচনা
শরীয়াতের দৃষ্টিতে সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। পারিভাষিক অর্থে পানাহার ও খাদ্য ও কিছু নিদিষ্ট কাজ থেকে নিজেকে সংযত ও বিরত রাখা। ফজর এর পূর্বমুহূর্ত থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের অর্থাৎ মাগরিব পর্যন্ত এই সকল কাজ থেকে সম্পূর্ন বিরত থাকার ব্যাপারে হাদিস ও ফিকাহ গ্রন্থসমূহে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমনটি সূরা বাকারাহ ১৮৭ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, ‘রাতের কালো রেখা হতে প্রভাতের সাদা রেখা স্পষ্ট হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পানাহার করো। এরপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’ এছাড়া এই রাতের কালো রেখা এবং প্রভাতের সাদা রেখার বর্ণনা তাফসির ও ফিকাহ গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইসলামের প্রথম দিক থেকেই ফজর ও রাতের মহিমাকে আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও এই বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে শিয়া-সুন্নি মাঝে যা আজ ও বিদ্যমান। যদিও এই বিষয়টি লেখার সাথে সর্ম্পকিত নয় তবুও এই সম্পর্কে জানার জন্য এখানে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া এই বিতর্কিত বিষয়টির নিয়ে ফজর ও মাগরিবের সময় নির্ধারণের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সেহেরী ও ইফতারের জন্য অবগত করা হয়েছে। বিভিন্ন আলেম-ওলামাদের ভাষণ এবং সকল গলি, ওয়ার্ডে মসজিদের আযান শুনে এই সর্বজনীন নিয়মের উপর বিশ্বাস রেখে একইভাবে রোজা রেখেছে এবং রমজান মাসের পরিসম্পাতি ঘটেছে। আলেম-ওলামাদের এই সকল ফতোয়া সমূহ অবশ্যই তাদের অভিজ্ঞতা এবং রাতের আকাশের নক্ষত্রের অবস্থান বিভিন্ন সময়ের ঋতুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। চাঁদের অবস্থান, সূর্যের উদয়-অস্ত ছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতি যেমন যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম এবং এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত সকল বিষয়ের সাথে পরিচিত ছিলেন। বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব ও আলেম আয়াতুল্লা মির্জা মুহাম্মদ হাসান নাইনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নাতিজেয়ে এলামে ওয়া তানজিরিয়ে আলমালে’ বর্ণনা করেছেন, আকাশের দিকে দেখ, পর্যবেক্ষন করো এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্তে পৌঁছাও। অধিকাংশ মানুষের কাছে ঘড়ি ছিল এবং তাদের জীবনযাপন ও ছিল সহজ-সরল সাধারন ঘড়ি থাকায় তাদেরও মধ্যে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল না। আর এই কারণে সারা বছরের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সম্পর্কে সকলেই অবগত ছিল এবং এর উপর নির্ভর করেই দৈনন্দিন ইবাদত করত। এই কাজের জন্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ও মজার গল্প প্রচলিত রয়েছে যা বিভিন্ন কওমকে (গোত্র) আকৃষ্ট করেছিল এবং ইসলামের সূচনা হয়েছিল, ইসলামের সোনালি সভ্যতা অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছিল।
৬৩৩ কামারীতে আলফুতির ছেলে কামাল উদ্দিন আব্দুর রাজ্জাক মারুভ লিখেছেন, ঐ বছর মাদ্রাসার সামনে একটি দ্বারমণ্ডল তৈরি করা হয়েছিল। হলরুমের দরজা, দেয়াল ও মহলে নক্ষত্রপুঞ্জের নকশা (ছবি অঙ্কন) করা হয়েছিল অতি সুসজ্জিত ভাবে। মহলের ভেতরে দুইটি উন্মুক্ত সোনালি রঙের বড় গামলার মতো ছিল এবং এই গামলার দুইটির পিছনে দুটি বড় ধাতব প্রস্তর ছিল যা দেখা যেত না। এক ঘণ্টা পরপর ঐ বৃহৎ গামলার মতো বস্তুটি উন্মুক্ত হয়ে যেত এবং ধাতব প্রস্তরটি সেখান থেকে সংকেত প্রেরণ করত। প্রতিবার যখন ধাতব বস্তুটি উন্মুক্ত হতো, একটি করে খিলান খুলে যেত। দরজাগুলো যখন ঘণ্টা বাজাতো তখন ঘণ্টার তারগুলো ধাতব প্রস্তরটির সে গামলার উপর বাড়ি দিত, তখন দরজাগুলো তাদের নিদিষ্ট স্থানেই উন্মুক্ত হতো (বাজতো)। এই ঘণ্টা ধ্বনির মাধ্যমে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় অর্থাৎ এই পদ্ধতির মাধ্যমে সেহেরী ও ইফতার সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করা হতো এবং ঘণ্টা ধ্বনির মাধ্যমে মুয়াজ্জিন আযান দিত। ইরান একটি ইসলামি শাসন ব্যবস্থা ভিত্তিক রাষ্ট্র এবং ইরানে ঠিক একই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সেহেরী ও ইফতারসহ ফজর ও মাগরিবের আজান ও নামাজের সময় নির্ধারণ করা হতো। কিন্তু আযান দেয়ার এই বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে সময় নির্ধারণ করা সঠিক ও সহিহ ছিল না। কেননা প্রতিটি মহল্লায়, গ্রামে, শহরে মসজিদ ছিল না। যদিও কোনও কোনও স্থানে মসজিদ ছিল কিন্তু উচ্চ শব্দ বিশিষ্ট মাইক ছিল না। যার কারণে আযান সকল মানুষের কাছে একইভাবে পৌছাতো না, মাইকের ধ্বনি কয়েক মিটারের বেশি দূরে পৌঁছাত না। আর এই বিশেষ সমস্যার কারণে সকল শহর ও গ্রামে, মহল্লায় জনসাধারণ রমজান মাসে সঠিক ও নির্ধারিত সময় সম্পর্কে অবগত হতে পারত না। এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য তারা অন্য রাস্তা সম্পর্কে চিন্তা করছিল। সে সময় অনেকের পিড়াপিড়ির কারণে রমজান মাসে সঠিক সময় নির্ধারণ করার তাগাদা দেয়া হচ্ছিল। কারণ রমজান মাসের রোজা রাখার গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। অধিকাংশ মানুষ নামাজ না পড়লেও রোজা রাখত।
বিখ্যাত কবি ও হৃদয়গ্রাহী লেখক আবদুল্লাহ মোস্তফা তেহরানের রামাদান মাসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে তার বিখ্যাত গ্রন্থ “সারহে জিন্দেগী-মান” সম্পর্কে বলেছেন, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালের রমজান মাসগুলোতে সকলে রাত হতে ভোর পর্যন্ত জেগে থাকত এবং এই কাজটি অতি মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। কেউ কেউ এই রাতগুলোতে ভোর পর্যন্ত ইবাদাত-বন্দিগি আবার দোয়া-দরুদ, আবার কোরআন তেলওয়াত করত। সেহেরী খেয়ে যোহর পর্যন্ত ঘুমাতো যেন রোজার প্রভাবটা কম পড়ে। এদের মধ্যে এক শ্রেণির লোক ছিল যারা সারারাত জুয়া খেলে রাত জেগে থাকত তাদের ভাষ্য মতে, যদি আমোদ-প্রমোদে মসগুল না হয়, তাহলে নিশ্চিত রাতে ঘুমিয়ে যাব আর দিনের বেলা ঘুম আসবে না। যার ফলে রোজা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। এই শ্রেণির লোকেরা অভিজাত পরিবারের ছিল কিন্তু তারপরেও যে কোন মূল্যে তারা রোজা রাখত। যদি কোনও ব্যক্তি রোজা না রাখতে চাইত কিন্তু তারপরেও কোনও সুযোগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে রোজা রাখা রাখত।
মুস্তাফি এই বিষয়ে আহমেদ মনশুর কথা নকল করে বলেন, আমি আমার ভাইয়ের সাথে সারারাত মজলিসে ছিলাম, যার কারণে সেহেরী খেতে পারিনি এবং রোজা না রেখেই বাড়িতে ফিরে আসি এবং আমাদের রোজা না রাখার খবর আমাদের বাড়িতে পৌঁছে গেছিল। যখন বাড়িতে প্রবেশ করলাম মা আমাদের ধরে ফেললেন। এরপর কিছুদিন আমাদের সাথে অতি অদ্ভুত আচরণ করলেন, এমনকি চাকর বাকরদেরও আদেশ দিলেন যেন আমাদের থেকে দূরে থাকে। আমাদের খাবার ঘরের মধ্যে রেখেই পালিয়ে যেত। আমাদের থালাবাসনগুলোও আলাদা করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে আমাদেরকে তওবা করিয়ে নিয়েছিল এবং এরপরেই আমাদেরকে বাড়ির সদস্য হিসেবে কবুল করেন। পরবর্তী রাতগুলো ছিলাম ইবাদতের মধ্যে দিয়ে কখনো বা ইবাদত ছাড়া।
সে নিজেই একজন আলেম ছিলেন। ঘুমন্ত ব্যাক্তিদের সেহেরী সময় জাগ্রত করার জন্য গরমকালে রাত জেগে কাটাতেন। ছাদে যেতেন এবং উচ্চ স্বরে কোরআন তেলয়াত, দোয়া মোনাজাত করতেন। এইভাবে প্রতিবেশীদের সেহেরীর জন্য জাগ্রত করতেন এবং এক সময় প্রতিবেশীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, যারা রাত জাগরণ করে বা অন্যেও চেয়ে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে তারা যেন দরজায় কড়া নাড়ার মাধ্যমে অন্যদের জাগ্রত করে। এছাড়াও কিছু মানুষ নেকির উদ্দেশ্য মহল্লার গলিতে গলিতে যেত এবং ধর্মীয় কবিতা পাঠ করার মাধ্যমে সকলকে জাগ্রত করত। রেজা শাহর শাসন আমলে তেহরানে ও কিছু যুবকরা এই পদ্ধতিতে জনসাধারণকে জাগ্রত করত। অন্যরা এর প্রশংসা করে বলেছেন, রমজান মাসে ফজরের আযানের পূর্বে মহল্লার গলিতে গলিতে কিছু যুবক যেত এবং উচ্চ স্বরে বলত, পানি আছে, আফিম, চিনি ও চা আছে। এই কথাটি বলার অর্থ মানুষকে সাবধান করা যাতে মানুষজন পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে বিরত থাকে, এবং আসক্ত না হয় এই রোজার সময়টাতে।
রমজান মাসে তোপ-কামানবাজি
পবিত্র রামাদান মাসে এই রকম বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি ছিল তোপ-কামানবাজি। এই বিষয়টি সম্পর্কে অনেক গল্প, কাহিনি প্রচলিত আছে। বই ও প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এই রীতি রেওয়াজটি ইসলামের অধিকাংশ রাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল। অনেকগুলো রীতি রেওয়াজ পদ্ধতির মধ্যে এই পদ্ধতিটিকে যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নেয়া হয়। মিসরের সুলতান মুহাম্মদ আলী (১৭৬৯-১৮৪৯) ১৮০৪ সালে মিসর সালতানাতের নায়েবে অধিষ্ঠিত হন এবং ওসমানিরা তাকে পদচ্যুত সিংহাসন দখল করে নেন। পরিক্ষা স্বরূপ একটি তোপ ক্ষেপনাস্ত্র জামার্নী থেকে নেয়া হয়েছিল এবং রমজান মাসে সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়ে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে চালানোর অর্থাৎ কামানবাজির নির্দেশ দেওয়া হয় জনসাধারণকে সঠিক সময় সম্পর্কে অবগত করার জন্য। তারপর থেকে মিসরসহ বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে অতি সুসৃঙ্খলভাবে কামানবাজি প্রথার প্রচলন করা হয়। ইরান নিজেও এই প্রথার বহুল প্রচলন ঘটায়।
এরপর থেকে এই কামানের শব্দের মধ্যে দিয়েই জনসাধারণ অতি নিরাপত্তারও সন্তুষ্টির সহিত সেহেরী ও ইফতার করত। জমিন থেকে মহাশূন্যে ছোড়া হতো এই কামান যাতে করে সকলে কাছে এর ধ্বনি পৌছে যায়। কিন্তু এই কামানবাজির এই পদ্ধতিটি মোটেও সহজলভ্য ছিল না এবং ব্যয়বহুল ছিল। আবার এই কাজে নিয়োজিত হবার পূর্বে সামরিক প্রশিক্ষনের প্রয়োজন হতো। তোপ, কামান, গুলিসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলোর পরিচিতি থাকার একটা ব্যাপার ছিল। কামান সত্যিকার অর্থে একটা যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল। সেহেতু এর ব্যবহার ছিল কঠিন এবং ভয়াবহ। কামানের গুলিগুলো বড় ও ভারী হওয়ায় অনেক দূর থেকে ছোড়া হতো আর এই রকম বহু কারণে এই কাজের জন্য শক্তিশালী ও সবল কর্মচারীর প্রয়োজন পড়ত। প্রথমের দিকে এইটাকে সরকারি মালিকানায় যুদ্ধের সরঞ্জাম এর সাথে রাখা হতো। ইরানের বিভিন্ন প্রদশে শহরগুলোতে রমজান মাস ছাড়াও জাতীয় দিনগুলোতেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই কামানবাজির আয়োজন করা হতো। আর এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু সংখ্যক দক্ষ, সবল কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হতো। তাদেরকে যাবতীয় কার্যাবলি ও নিয়মকানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সাংবিধানিক বিল্পবের পর ১২৮৫ শামসী ১৪ মুরদাদ সংবিধান জারি করা হয়। প্রশাসন এরপরেও এই প্রথা চালু রেখেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক গোলযোগ, দাঙ্গা, ফ্যাসাদের কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রভাব পড়েছিল এবং সকল প্রদেশের উপর বিশেষভাবে নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছিল। বর্ণানাকারীর মতে কঠিন সমস্যা ও পরিস্থির মধ্যে দিয়ে এই প্রথা চালু রাখা হয়েছিল।
শাসক নাছের উদ্দিন শাহ এর সময়কালে কামানবাজি অতি জাকজমক ভাবে করা হতো। এর সমস্ত খরচ রাষ্ট্র কতৃর্ক বহন করা হতো। এই কাজে নিয়োজিত সমস্ত কর্মচারী ছিল সরকারি বেতনভুক্ত। সে সময় রামাদান মাস ছাড়াও ঈদসহ সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং শাহ এর জন্মবার্ষিকীতে সরকারিভাবে কামানবাজির আয়োজন করা হতো। এরূপ ধারাবাহিকতার পরও কিছু শাসকগণ যেমন ফতেহ আলী শাহ তার ছেলে ও নাতিরা এবং কাজার বংশের শাহজাদারা তাদের শাসনমালে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিল না এবং এই সময়কালে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার অন্যান্য কর্মকতা, কর্মচারির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। ১৩১২ কামারীতে বেহবানের শাসক মুনতাসির মূলক রমাজান মাসে কামানবাজির জন্য টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ৭০ তুমান পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে টাকার কারচুপি হয় এবং টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার স্বীকার থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে প্রাদশিক সরকারের চাপ প্রয়োগ ও গুরুত্বরোপের কারণে পুনরায় এর ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়।
আহমেদ শাহের শাসনামলে সামানীরা আক্রমণ চালায় এবং পুরো দেশ দখল করেন। এমতবস্থায় সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে কামানবাজি জটিল সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিল। কারণ এমতাবস্তায় (যুদ্ধরত) সরকারের পক্ষে এর ব্যবস্থায় ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ অভ্যন্তরীন মন্ত্রণালয় যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল এবং যুদ্ধের খরচসহ সমস্ত আনুসাঙ্গিক খরচ সরকারের এই মন্ত্রনালয় এর উপর পড়েছিল। ১৩৩৪ সালে কামারীর রমজান মাসের কাছাকাছি কাজবিনে সেনাবাহিনীর একটি দপ্তর তৈরি করা হয় এবং সরকার ঘোষণা দেয়, এখন থেকে কামানবাজির সকল দায়িত্ব সামরিক বিভাগের উপর। অর্থাৎ যেখানে যেখানে কামানবাজির আয়োজন করা হবে সেনাবাহিনী সেখানে সকল দায়িত্ব পালন করবে। ১২৯২ শামসী সালের খোরদাদ মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে ফরমান দেয়া হয় যে, যেহেতু ইতিপূর্বে কাজবিনে কোনও সেনাবাহিনীর কোনো দপ্তর ছিল না সেহেতু রমজান মাসে, ঈদে ও বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবার ১০২ তুমান ও ৬ হাজার দিনার কামানবাজির জন্য খরচ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু সামরিক দপ্তর কাজবিনে রয়েছে সেহেতু আসন্ন কমানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার সামরিক দপ্তর থেকে বহন করতে হবে।
সামরিক বিভাগ উত্তরে সরকারকে বলেন, সামরিক দপ্তর এর পক্ষ থেকে এই খরচ বহন করা সম্ভব নয়। কারণ এর দায়িত্ব কেন্দ্রিয় সরকারের সামরিক বাহিনীর নয়। পরবর্তীতে অনেক রেষারেষি ও চাপ প্রয়োগের ফলে সরকারের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই বিভাগটি রাজস্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সর্বশেষে ওই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রতি রমজান মাসে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি শহরে একটি করে দল গঠন করা হবে এবং সেহেরী ও ইফতারের সময় কামানবাজির আয়োজন করা হবে। গিলান সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে এই মর্মে টেলিগ্রাফ করা হয় যে, গোলা-বারুদসহ কামানবাজির সমস্ত খরচ রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে।
আনন্দের বিষয় এটি ছিল যে, ১৫ শাবান ইমাম এর জন্মদিন উপলক্ষে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার গোলন্দাজ বিভাগ বহন করে। ২৫ রমজান ১৩৩৪ দক্ষিণ মন্ত্রণালয় থেকে রাজস্ব বিভাগে এই মর্মে চিঠি লেখা হয় যে, লোরস্তোনকে ও এর সাথে সংযুক্ত করা হোক এবং পরস্পর এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার ফরমান জারি করা হোক। ইরানের সরকারি রাজস্ব বিভাগ ১৩৩৪ কামারীর কামানবাজির আকর্ষণীয় তথ্য প্রকাশ করে। পবিত্র মাহে রামাদান, ঈদ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কামানবাজির তালিকা তুলে ধরা হলো:
১. ১১ রজব আমিরের (আ.) জন্মবার্ষিকী
২. ৪ শাবান হোসেনের (রা.) জন্মবার্ষিকী
৩. ২৫ শাবান কায়ূমের (রা.) জন্মবার্ষিকী
৪. ২৭ শাবান হযরত হুমাইনির (রহ.) জন্মবার্ষিকী
৫. পবিত্র রমজান মাসব্যাপী
৬. ঈদুল ফিতর
৭. ঈদুল আযহা
৮. ১২ রবিউল আওয়াল মহানবির (সা.) জন্মবার্ষিকী।
উপলক্ষে কামানবাজির আয়োজন করা হয়। এটি ছিল ১৩৩৪ সালের কামানবাজির তালিকা। বলা হয়ে থাকে যে, ইরানের প্রতিটি প্রদেশে এই কামানবাজি করা হয় এবং এর খরচ প্রাদশিক সরকার ৯০০ রিয়াল করে দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রদত্ত তালিকাটি ছিল খাপছাড়া। কারণ এটি পরিপূর্ণ কোনো তালিকা নয়। তালিকাটি থেকে হযরত আলির (রা.) জন্মবার্ষিকী বাদ পড়ে যায়। এছাড়া হযরত হোসেনের (রা.) এবং হযরত কায়ুম (রা.) সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয় এবং নুহ রোজ (ইরানী নববর্ষ) বাদ পড়ে যায়। বিধায় এই অসাধুতা এবং বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পুনরায় একটি নির্ভেজাল তালিকা তৈরি করা হয়। তালিকাটি নিম্নরূপ:
১. নুহ রোজ (ইরানী নববর্ষ)
২. হযরত আলির (রা.) জন্মবার্ষিকী
৩. হযরত আমিরের (রা.) জন্মবার্ষিকী
৪. হযরত কায়ুমের (রা.) জন্মবার্ষিকী
৫. সৈয়দ শাহদার (র.) জন্মবার্ষিকী
৬. হযরত হামাউনির (র.) জন্মবার্ষিকী
৭. পবিত্র রামাজান মাসব্যাপী
৮. ঈদুল ফিতর
৯. ঈদুল আযহা
১০. ১২ রবিউল আওয়াল মহানবির (সা.) জন্মবার্ষিকী
কামানের গুলি-তোপের মূল্য জায়গাভেদে এক এক রকম ছিল। আর এই কারণে বিভিন্ন রকমের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল সময়ের সাথে সাথে। পরবর্তীতে গিলান সরকার এই বিষয়টি কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে তুলে ধরেন এবং যৌথভাবে সমাধান করেন। পরবর্তীতে কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, কামানবাজি রমজান মাসকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হবে শুধুমাত্র সেহেরী ও ইফতারের জন্য। পরবর্তীতে এই নিয়ম চালু করা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, কেন্দ্রিয় সরকারের তিনটি বিভাগ যথা: রাজস্ব, সামরিক ও প্রাদশিক পরস্পর সমন্বয় করে এর ব্যয়ভার বহন করবে। সাংবিধানিক বিল্পবের পরে এই বিষয়টিকে সংবিধানের ধারার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ধারাবাহিকভাবে এই কামানবাজির প্রথা চলতে থাকে।
অবশেষে কালের পরিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনুমানিক ১৩১৯ শামসী মাসে এই প্রথা রহিত করা হয়। যদিও কোনও কোনও শহরে সীমিত আকারে কামানবাজির প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে ১৩২০ সালে প্রথমবারের মতো রমজান মাসে সেহেরী ইফতারের আযান দেয়া হয় এবং ১৩২২ সালে শামসী মাসে রেডিওতে (রেডিও ইরান) প্রথমবারের মতো আযান সম্প্রচার করা হয়। আর এরই মধ্যে দিয়ে ইরানের এক ঐতিহ্যের অবসান ঘটে।
অনুবাদ: মুমতাহহিনা খাতুন