রবীন্দ্রনাথের গল্পে পূর্ববাংলার প্রাণ ও ব্যথা অনুপস্থিত

পর্ব ৪

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: তারমানে, গল্প লেখা শুরু করার আগে আপনি গল্প পড়েছেন। সে গল্পগুলো কীভাবে লেখার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে?

মেহেদী: আমি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছর একটা একটা গল্প পড়েছি আর অবাক হয়েছি এজন্য যে, গল্প হিসাবে ওগুলো ভালো, গল্পে যদি গল্পই পড়তে চাই। কিন্তু পূর্ববাংলার মানুষের অনুপস্থিতি আমাকে ভাবিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে মানের গল্পকার, তার উচিত ছিল এই অঞ্চল ও মানুষকেও গুরুত্ব দেয়া, যেহেতু এখানে তিনি এসেছেন। যে অর্থে পদ্মাপারের জীবন তিনি দেখেছেন, সে অর্থে তার গল্পে এখানকার মানুষ নাই। হৈমন্তী, মৃন্ময়ী, চন্দরা আছে, তাদের ক্রাইসিস আছে, কিন্তু `সখিনা`, `মদিনা`দের গল্পও আমি তার কাছে প্রত্যাশা করেছিলাম। নাই। পরবর্তীকালে বিনয় সরকার পড়তে গিয়ে এই বিষয়ে একটা পর্যবেক্ষণ পেলাম। বিনয় সরকার বৈঠকে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের দশ হাতে যদি সাহিত্যের দশটা দিক থাকে, সেখানে পূর্ববাংলা নাই, এটা তার দুর্বলতা।’ এমন রবীন্দ্র-সমালোচনা তেমন আর পাই না। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো থিমেটিক্যালি বিশ্বজনীন হতে পারে, কিন্তু পূর্ববাংলার প্রাণ ও ব্যথা তাতে অনুপস্থিত। যেমন, পৃথিবীতে কে কাহার এই মর্মবাণী বা ম্যাসেজ পোস্টমাস্টার গল্পে আছে, কিন্তু রতন পূর্ববাংলার মেয়ে বা কিশোরী চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে না। ছোটগল্পে পূর্ববাংলা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাজের সুযোগ ছিল। তিনি এড়িয়ে গেছেন। তার মতো লেখক কেন এমনটি করলেন, আমি বুঝি না! এরপর আরো যারা গল্পকার, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতি, সুবোধ, নরেন্দ্রনাথ, নারায়ণ, বিমল, এদের কারো গল্পেই পূর্ববাংলা পাইনি। বৃহৎবঙ্গের জায়গা থেকে একটা বাংলাকে রিড করা গেছে। অবশ্য তাদের গল্পে পাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তারা যে মানের গল্পকার, তাদের কাজ করা উচিত ছিল। গল্পকার এমন অঞ্চল ও সংকটের পরিস্থিতি উপস্থাপন করেন, যা কেউ জানে না। তাতে সাহিত্যে নতুন কন্টেন্ট তৈরি হয়। সেই অর্থে অচেনা পূর্ববাংলা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আগপর্যন্ত  বাংলা ভাষার ছোটগল্পে অজানা ভুবন। যেহেতু ভাষা বাংলা, ফলে এটা বিস্ময়ের যে, বাংলা ভাষার বিশাল জনগোষ্ঠী অধরা থাকল গল্পে ওয়ালীউল্লাহর আগপর্যন্ত। গল্পে পূর্ববাংলাকে ধরার চেষ্টা নজরুল করেছেন, কিন্তু কন্টেন্ট এত দুর্বল যে, গল্পগুলো আলোচিত হবার হয়। তবুও পদ্মগোখরাসহ বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে কথা বলি আমরা। তাও নজরুলের কবিত্বের এসেন্স যুক্ত হয় বলেই।

সরফরাজ: এই পাঠ আপনার মনোজগতে কীভাবে প্রভাব ফেলল?

মেহেদী: বিভিন্ন দশকের সেরা গল্পকারদের পড়ে বুঝলাম, পূর্ববাংলার গল্প কেমন হবে আমার কালে। আমি মূলত এক দশক ধরে তাই লিখে যাচ্ছি। এখানকার মানুষের গল্প, সংকট এখানকার, জীবন এখানকার। পড়লে আরো যেটা লাভ হয়, রিপিটেশন হয় না। যা যা লেখা হয়ে গেছে, এরপর থেকেই শুরু করা উচিত। এটা এদেশের ভবিষ্যত পাঠকের কষ্টকে আরো বাড়াবে, যদি তারা তাদের দেশের গল্পে নিজ মানুষ ও ভাষাকে খুঁজে না পান। আমার মনে হয়েছে, এখানকার অধিকাংশ ভালো লেখক এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, মঈনুল আহসান সাবের, শহীদুল জহির এক্ষেত্রে অনুসরণীয়। কীভাবে নিজ দেশের প্রতিবেশকে তুলে ধরতে হয়, তারা দেখিয়েছেন।

সরফরাজ: আরও বেশ ক’জন কথাসাহিত্যিক কিন্তু এখানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাদের নাম আপনি উল্লেখ করলেন না। যেমন, সুচরিত চৌধুরী, মাহমুদুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন...

মেহেদী: যাদের নাম বলেছি, ভেবেচিন্তেই বলেছি।

সরফরাজ: তাহলে যাদের নাম উল্লেখ করলেন না, তাদের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

মেহেদী: সৈয়দ হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন- প্রত্যেককে নিয়েই আমি লিখেছি। আলাদা লেখা। বেশ কয়েকটি। তাদের গল্পে যথেষ্ট শিল্পমান আছে। ভালো গল্প লিখেছেন হাসান আজিজুল হক। কিন্তু কোথায় যেন অস্পষ্টতা আছে। বলতে গেলে, আমার আরো সময় প্রয়োজন। আরো ভাবতে হবে।

সরফরাজ: আপনার এই ভাবনা অনেককেই কনফিজড করতে পারে। তবুও ভবিষ্যতে সেসব আমরা ব্যাখ্যাসহ শুনব, আশা রাখি। বিশেষ করে মাহমুদুল হককে নিয়ে আপনার একটি গদ্য ছাড়পত্রে ছাপতে আমরা প্রতীক্ষায় রইলাম। এবার আপনার প্রথম গল্প নিয়ে একটু গপসপ করা যাক।

মেহেদী: ধন্যবাদ সরফরাজ ভাই, আমাকে ভাবার সময় দেয়ার জন্যে। মাহমুদুল হককে নিয়ে অবশ্যই ছাড়পত্রে আমি একটা গদ্য লিখব। তবে এজন্যে সময় লাগবে। এবার আসা যাক আমার প্রথম গল্প প্রসঙ্গে। গল্পটির নাম ছিল, কাছারি। `কাছারি` আমার মায়ের প্রতিবেশের গল্প। নোয়াখালি অঞ্চলের। গল্পটা ২০০৮ সালের এপ্রিলে লেখা। আমি তখন ভাবছিলাম, কি দিয়ে শুরু করব? এর আগেও একটা গল্প লিখেছিলাম, তবে সেটা প্রকাশ করিনি। সেটা মানহীন তো বটেই, ছিল উদ্দেশ্য, লক্ষ্যহীন। কাছারি গল্পে আমি এমন কয়েকটি বিষয় আনলাম যেটা আমার জন্য ভালো সূচনা। একটা পরিত্যক্ত কাছারির সূত্রে আমি ঔপনিবেশিক সময় চলে গেছিলাম, সেখান থেকে কাছারিকে কেন্দ্রে রেখে ইতিহাসকে টেনেছি, যে ইতিহাস পূর্ববাংলার, কিন্তু সবার অগোচরের। যে ঔপনিবেশ স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। স্থানীয় মানুষ উপনিবেশ সম্পর্কে না জেনেও এর প্রভাবের মধ্যেই অবস্থান করছিল। তাদের কাম, প্রেম, রুচি সব। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে কাছারিতে আশ্রিত একজন মানুষের নয়া উপনিবেশের শিকার কীভাবে একটি জমিদার বাড়ির মানুষ সেই ন্যারেশন তৈরি হয়েছে কাছারিতে। যার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সোজা দেশভাগের পর পাকিস্তানে ঢুকে যাওয়া যায়। পূর্ববাংলার সংস্কৃতি আলাদা, যে কোনো উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিজ সংস্কৃতি দিয়ে এরা খাঁড়া হতে পারে, তার নমুনা কাছারি গল্পে আছে।

চলবে...