রবীন্দ্রনাথ একটা না, অনেকগুলি
মঈনুল ইসলাম তুহিনপ্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০১৯
ভারতের জাতীয় সংগীত নিয়াও বিতর্ক কম হয় নাই। সেদেশে রবিবাবুর মূর্তি ভাঙা হইছে, পাঠ্যবই থেকে তার লেখাপত্র বাদ দেওয়ার সুপারিশ হইছে, পাটনার রবীন্দ্র চক`র নাম বদলে `অটল বিহারী বাজপেয়ী চক` রাখার দাবি উঠছে, এমনকি আসামে `রবীন্দ্র জয়ন্তী` পালনে বেশ কয়েকবার নিষেধাজ্ঞা জারি করছে বিজেপি, আসামের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকেও বাদ পড়ছে ২৫ বৈশাখ।
চোখ বন্ধ করে একবার ভাবেন তো, ঘটনাগুলি বাঙলাদেশে ঘটতেছে! কী, ভাবতে পারতেছেন? না পারারই কথা। কারণ বাঙলাদেশে এই ঘটনা ঘটলে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই চাপের মুখে থাকা লাগত সরকারের। আর, মজার কথা, এই চাপগুলি আসত দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার নাম বেচে চলা কিছু সংগঠন এবং বিদেশে অবশ্যই বিজেপির পক্ষ থেকেই।
এইখান থেকে কী শেখা গেল? বিজেপি ওইদেশে কবিগুরুরে তুলাধুনা করলেও এদেশের `হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ` নামের প্রতিষ্ঠানগুলি চুপ থাকে, বিজেপির কাছেই গিয়া আশ্রয় চায়। আবার বিজেপি নিজের দেশে কবিগুরুরে নিষিদ্ধ করলেও, বাঙলাদেশে কবিগুরুরে স্বমহিমায় বহাল দেখতে চায়। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুর প্রতি বিজেপির ঐতিহাসিক-মতাদর্শিক ঘেন্নার ব্যাপারে আমাদের দেশের হিন্দুরা কি সচেতন? বাঙালি হিন্দু বিজেপির ধর্মতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে কি ভয়াবহরকম অসহায়, এটা এদেশে সুকৌশলে গোপন রাখে কারা?
একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ একজন ব্যক্তিমাত্র হইলেও, ঐতিহাসিক ভাবমূর্তি হিশাবে রবীন্দ্রনাথ একটা না, অনেকগুলি। সেই অনেকগুলি রবীন্দ্রনাথরে আমরা কার্যরত দেখব অনেকগুলা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও প্রেক্ষাপটে: এক রঠা সংস্কৃত আর হিন্দি আধিপত্যবাদের কবল থিকা বাঙলা ভাষারে রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াইরত; আরেক রঠা বাঙালি মুসলমানের আলাদা রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার বিপক্ষে খড়গহস্ত; এক রঠা জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে হামেশা উচ্চকণ্ঠ, আরেক রঠা দুইটা জাতিরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদের জ্বালানীতে ক্রমাগত দিয়ে যাচ্ছেন গভীর ইন্ধন; এক রঠা `একরাজ্যপাশে` বেঁধে গড়তে চান `মহাভারত`, আরেক রঠা বর্ণনা করেন স্বদেশী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী হিন্দুদের গোঁড়ামীর কথা; এক রঠা বাঙলাদেশের ষাটের দশকী ভার্শন হিশাবে নাজিল হয়ে এদেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের নেপথ্যে থাকেন, আরেক রঠা ওপারে বিজেপি ও হিন্দি ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুর লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন; এক রঠার একটি গানের ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করাই নোবেলকে `মৌলবাদী` বানায়, আরেক রঠার মূর্তি ভাঙারও কোন প্রতিবাদ এদেশি হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার কথা বলা সংগঠনগুলি করে না।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কোন রবিরে আমরা চাই? একটা জাতির উন্মেষকালে, তার নিজস্ব চরিত্র, ইতিহাস, ভাষা ও রাষ্ট্র গড়বার কালে, সেই জাতির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের এমন বিভক্ত ও পরস্পরবিরোধী চরিত্রের প্রকাশ নতুন কিছু না, সব জাতির ইতিহাসেই এইটি আছে। কিন্তু এটির মোকাবেলা কীভাবে হইতে পারে, তার হদিশ করা জরুরি। পাকিস্তান ও ভারতের সাথে এই অঞ্চলের বাঙালি মুসলমান বা হিন্দুর লড়াইটা কেবলমাত্র ধর্মের জায়গা থেকে না, জাতিগত জায়গা থেকেও। সেখান থেকে আমরা দেখি যে, পাকিস্তানের কাছে পূর্ব বাঙলার লোকেরা যেমন `এনাফ মুসলিম` ছিল না, বিজেপির কাছেও বাঙালি হিন্দু `এনাফ হিন্দু` না, পাকিস্তানের যেমন বাঙালের ব্যাপারে একটা নাকউঁচু তাচ্ছিল্য ছিল, হিন্দিভাষী ভারতেরও বাঙালি হিন্দুর ব্যাপারে সেইটি ষোল আনাই আছে। আর এই দুই প্রেক্ষাপটেই, বাঙালি হিন্দু কি মুসলমানের কমন অবলম্বন হইছে রবীন্দ্রনাথ, সেইটা ইতিহাসের ডিলেমা বা আয়রনি যাই হোউক, তাতে সত্যে ফারাক হয় না।
ফলে, রবীন্দ্রনাথরে, এই নানামুখী রবীন্দ্রনাথরে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করতে পারি? পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র-মোকাবেলায় সেকালের তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদরা যে পন্থা গ্রহণ করছিলেন, তা নাকাম হইছে। আবুল মনসুর আহমেদের `রবীন্দ্রসাহিত্যে মোসলমান নাই কেন` প্রশ্ন বর্তমান সময়ের সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে আর তেমন পানি পায় না, যদিও রাজনৈতিকভাবে এই প্রশ্নের আলাদা গুরুত্ব হয়ত আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথরে আকাশে উদিত রবির মত পুজা করা কিংবা ভারতের কবি বইলা বাতিল করার যে সংকট, তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আমাদের মনে রাখা জরুরি, যে রবীন্দ্র-সন্ত্রাস এইদেশে আজতক বিদ্যমান, আমাদের পাশের দেশে সেই রবীন্দ্রনাথই বাঙালির ভরসা। এরে ভারতের নিজস্ব অন্তর্কোন্দল হিশাবে বিবেচনা করতে পারি আমরা, বলতে পারি যে এটা `ঘরের ভেতরের ঝগড়া` এবং তা আংশিক সত্যও বটে। কিন্তু ইতিহাস যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া, মানুশ ও জাতির মুক্তির সংগ্রামও যেহেতু কখনও ফুরাবার নয়, তাই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু অথবা আসামের বাঙলাভাষীদের সাথে আধুনিক মহাভারতের বর্গীবাহিনী বিজেপির যে লড়াই, এবং সে লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা, তারে আমাদের স্মরণে রাখাই উচিত বলে মনে হয়। অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা এই লড়াইটা আদৌ লড়তে চান কিনা বলা যায় না, শুনেছি সেদেশে এখন বিজেপির খুব বাড়-বাড়ন্ত।
বাঙলাদেশে যে রঠা বর্তমান, সে বিজেপির বেশ পছন্দেরই। কারণ, বাঙলাদেশ, বাঙালি মুসলমানের তৈরি করা ন্যাশন স্টেটরে `মহাভারত` প্রকল্পের বাইরে গিয়া শক্তিশালী কোন ঘটনা হইয়া ওঠা থেকে বিরত রাখে এই রঠা, এই রঠার গানের সমালোচনা বাঙলাদেশিরা করলে ভারতে `জঙ্গি জঙ্গি` রব ওঠে। ফলে, এই রঠারে আমাদের ভাঙতে হবে। কিন্তু সেইটা পাকিস্তানি স্টাইলে না, সেটা হইলে আমাদের প্রতিরোধের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একটা বড় ফাঁক তৈরি হবে। কোনরকম পর্যালোচনা ছাড়া, `রবীন্দ্রনাথ হিন্দু` `রবীন্দ্রনাথ ভারতের কবি` বা `রবীন্দ্রনাথ নজরুলরে নোবেল পাইতে দেয় নাই`-জাতীয় পাকিস্তান আমলীয় ক্ষোভ, উন্মাদনা ও অতি ধর্মবাদী গুজবের বাতাসে রঠারে ভাসায়ে দেওয়া যাবে না। বরং রঠারে আনতে হবে পূব বাঙলার কাদামাটিতে, পদ্মার পাড়ে বজরা থেকে নামিয়ে তারে করতে হবে নির্মম জেরা, শান্তিনিকেতনের বর্ণপ্রথা থেকে নামায়ে তারে নিয়া আসতে হবে দলিত আর নমশূদ্রদের কাছে, আলোচনা আর পর্যালোচনার মাধ্যমে ভাঙা লাগবে তার মহাভারতীয় মূর্তি।
বাঙালি মুসলমানের জাতিরাষ্ট্রে, এই শতকের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথরে বিনির্মাণ করতে হবে নতুনভাবে, যে রবীন্দ্রনাথ বিজেপির হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিপক্ষে দাঁড়ায়, যে রবীন্দ্রনাথ বিএসএফের গোলাগুলির সামনে দাঁড়ায়, যে রবীন্দ্রনাথ অমোঘ নিয়তির মত কপালে আটকায়ে থেকে এদেশের মুসলমানদের নোবেলের মত `জঙ্গি` অপবাদ দেয় না। এই রবীন্দ্রনাথরেই আমাদের বিনির্মাণ করা লাগবে, আর চোখ-কান খোলা রাখলে আমরা দেখব, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, খুব মৃদুভাবেই। রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষার বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার কতবড় সৈনিক, তা মোহাম্মদ আজমের লেখাজোখা পড়লে আমরা জানতে পাই। প্রমিতের রক্ষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই প্রতিবিপ্লবী `অপ্রমিত` রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠার মত, একটা প্রতিবিপ্লবী রবীন্দ্রনাথই আমাদের দরকার। সেইটা ষাটের দশকে করা গেলেই হয়ত ইতিহাসের দায় এত বাড়ত না, কিন্তু কী আর করা! রবীন্দ্রনাথের এই বিনির্মাণ ছাড়া অত্র অঞ্চলের বাঙালির, সে হিন্দু হউক বা মুসলমান, প্রতিরোধের ইতিহাস বা রাষ্ট্র গইড়া উঠবে না। একথা এইদেশের হিন্দু-মুসলমান উভয়েই যত তাড়াতাড়ি বোঝেন, ততই মঙ্গল।