রথো রাফির প্রবন্ধ ‘কবি এক নির্গ্রন্থিক আত্মা’

প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২০

কবিদের কেবল বিভ্রান্তরাই অনুসরণ করে

কবিরা মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে কেবল উস্কেই দেয় না, নতুন ভাবনাকে বিকশিত করে। আর তা পৃথিবীর যেকোনো সাংগঠনিক কাঠামোর চিন্তারীতিকে যেমন অস্বীকার করতে পারে, তেমনি তা পৃথিবীর প্রভাবশালী যেকোনো গ্রন্থ থেকেও দূরে অপসৃত হতে পারে। ফলে প্রকৃত কবি নির্গ্রন্থিক, চিরকালই। আর একই কারণে সে নিজেও নিজের চিন্তাভাবনা মরিমার্জনে-পরিবর্তনে পিছপা হয় না।

শুধু তাই নয়, কবিরা চিন্তায় চিরকাল সংবেদনকে অবলম্বন ও উজ্জীবন করে চিন্তাকে রেখেছে প্রচ্ছন্ন বা উজ্জ্বল করে। এর সাথে সামনে আসে শরীরের প্রাধান্য, ইন্দ্রিয়ের স্বাস্থ্য-উজ্জ্বলতা, প্রবৃত্তির প্রতি দুনির্বার টান এবং বিমূর্ত চিন্তা থেকে মূর্ততার দিকে দুর্মর যাত্রা। প্রচল যুক্তি-বিশ্বাস এখানে, কবির কাছে ও কবিতায় মূল কথা নয়; ভালো লাগা, দ্রোহ আর প্রচলবর্জনই এর মনোবীজ।

কেবল যুক্তি, যা বিমূর্ততার দিকে ক্রমে সরিয়ে নিতে চায় আমাদের, কেবল বিশ্বাস যা শরীরকে অস্বীকার করে; এ দুটির সঙ্গে নির্বিরোধে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না কবি ও কবিতা। যেখানে কেবল কতগুলো রীতি-ভীতি-নৈতিকতার কাছে ভালো লাগাকে উৎসর্গ করতে হয়, অশরীরি কোনো ভৌতিক অনস্তিত্বের কাছে মাথা বিলিয়ে দিতে হয়, চিন্তার সংবেদনদীপ যেখানে ভক্তির বাতাসে নিভে আসে, সেখানে কবিদের স্বাধীন অভিব্যাক্তি যা নিশ্চয়তাকে উপড়ে ফেলে, যা পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়, যা কোনো নিরলবিরল পাঠকের একাকী জগতের বদ্ধ আবহে এবং আলোড়িত সমাজের মঞ্চে পরিবর্তন পিপাসু জনমানসে প্রাণস্পৃহার সজীব বাতাস বইয়ে দিতে সক্ষম, সেখানে এই বিরোধ নিরসনের কোনো আশা নেই।

রীতিনিষ্ঠ ক্ষমতাকাঠামোর নেতৃবৃন্দর কাছে এবং তাদের গ্রন্থগুলোর অনুমোদন কবিরা পাবে না, তাই তো স্বাভাবিক। তা কখনও কখনও কবিদের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে, তা কেবল তাদের অনুগত প্রচারক হিসেবেই্, এবং তা সাময়িক। কবি ও কবিতা আদর্শবাদী ভাবনার কাছেও বড়ো জটিলতা-উৎসারী।

Every faith practices some form of terror, all the more dreadful when the "pure" are its agents. Emil Ceoran

ধর্ম যেখানে বিশ্বাসকে প্রথমে স্থান দেয়, একই সাথে এই বিশ্বাসকে দৃঢ়তার জন্য পরবর্তী যতো কর্মকাণ্ড এই পরিমণ্ডলে পরিচালিত হয়। তাই এখানে চিন্তাশীলতার পরিণাম পূর্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত, এবং অজানা থেকে শুধু জানার দিকেই অভিযাত্রা। শত যুক্তিবিধৌত হয়ে পূর্ব জ্ঞাত সিন্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন সবকিছুকে বা তার বিপরীত ভাবনার সম্ভাবনাকে নাকচ করাই এই চিন্তচর্চার লক্ষ্য। আর যেখানে সংবেদন, যুক্তি, তথ্য ঠিক করে দেয় কী সিদ্ধান্ত হবে, সিদ্ধান্ত পূর্বজ্ঞাত কোনো বিষয় নয় যেখানে, সেখানে কায়েমি স্বার্থের বা ক্ষমতালোভী ধর্মের সাথে স্বাধীন চিন্তাশীল মানুষের সংঘর্ষ অনিবার্য। আর কবিরাতো সংবেদনকে উস্কে তোলে প্রাণকে আলোকিত করে, সজীব করে, যেখানে প্রচলকে সিদ্ধ করার যুক্তি বা বিশ্বাস কোনোটাই আগে নয়, তার পরবর্তী বিষয় বরং। ফলে যুক্তিবিধৌত মন-ও-বিশ্বাস বা বিশ্বাসবিধৌত মন-ও-যুক্তি উভয়ে সংবেদনজগতের চেয়ে হ্রাসকৃত, ছোট এবং সংকোচিত এক জগত। এ জগতের চেয়ে সবসময়েই বড়ো একটা মানুষ। এই হ্রাসকৃত জগতটিতে লোকটি পোষমানা না হলে, বা নানাধরণের আপোসরফা না করে, ছোট না হয়ে বসবাস করতে পারে না। কেবল হাসফাঁস করে।

আর এই বড়ো আছাঁটা মানুষগুলোর জগতই কবিতার জগত, যার দেখা সে আর কোথাও পায় না, এই পৃথিবীর কোনো সাংগঠনিক কাঠামোয়, কী ধর্মীয়, কী রাজনৈতিক কি রাষ্ট্রীয়, কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, কি বিজ্ঞানে। ফলে এদের অবস্থান সর্বদাই আদর্শবাদী, পদ্ধতিতান্ত্রিক, কি বিশ্বাসতান্ত্রিক যেকোনো বিশ্বের বাইরে, এবং অধিক মানবিক, সহনশীল ও সৃজনগুণউৎসারী। অন্যদিকে হাঁসফাঁস না করলে, তিনি মনে হয় কবি না, ক্ষমতার বা প্রতিষ্ঠানের স্তাবক, যেখানে তার পরিণতি, পান্তার পাতে লবণের জন্য মনকে বিসর্জন দেয়া।

All of life`s evils come from a `conception of life` Emil Ceoran

ধর্ম যেখানে অতীত, ভবিষ্যত সম্পর্কে একটা নিশ্চিত-সবজান্তা-ভাবনার-জগত, সেখানে অসম্পূর্ণ জানা, অনিশ্চিতয়তাগ্রস্থ কবির কাছে তারা আসতে পারে না এগিয়ে, আসতে পারে তার মতোই যারা সমধর্মী, পরমতসহিষ্ণু, পর-ও-স্ব-মতের যৌথক্রিয়ার যে ভিন্ন এক বা নব এক বিশ্বের দিকে যেতে চায়, যা তারই জানার বাইরে। কবি জানে সে সম্পূর্ণ নয়, সম্পন্ন নয়, কেবল পূর্ণতার দিকে তার এক সংবেদনশীল যাত্রা আছে, এবং এই পূর্ণতার দিকে তার নিজেরই সক্রিয়তা দাবি করে, কোনো ঐশ্বরিক সমাধানের অপেক্ষায় চেয়ে থাকা নয়।

তো গ্রন্থিকগণ, যারা এরই মধ্যে সমস্ত সমস্যা ও চাহিদার সমাধান পেয়েছে বলে দাবিদার, তাদের সাথে বিরোধে আসতেই হবে কবিকে এবং এই দাবিদারদের কাছে সে বিভ্রান্ত রূপে প্রতিভাত হবেই— এই তো স্বাভাবিক। নিজের ভেতরের সবজান্তাকে খুন করলেই সমাজপতিরা তাকে গন্ডীর বাইরে ঠেলে দেবে, বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আর সেইজন যদি কবিতার মানুষ হয়, কবি হওয়ার পথে ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এক সৃজনমগ্ন যাত্রার সূচনা করে। একশাস্ত্রী ও কবিদের মাঝে তাই ফাটল অমোচনীয়। ফলে কবিতো বটেই, আর হ্যাঁ, কবিতার পাঠকরাও যেকোনো ধর্মেই বা আদর্শবাদী গোষ্ঠীর কাছে বিভ্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

লেখক: কবি