রথো রাফি
রথো রাফির পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৮, ২০২০
দৃষ্টি ও দৃশ্য
তুমি জানো, আমি কতটা দৃশ্যমুগ্ধ। আমার চোখ চায় প্রতি মুহূর্তে তোমাকে দেখি।
কিন্তু তুমি যেন কখনও আসো না। তুমি আসবে আসবে ভেবে আমি বসে থাকি।
একা একা সন্ধ্যা গড়ায়। আর সব দৃশ্য মুছে ফেলে পৃথিবী। অন্ধকার দশদিগন্ত জপ
করে, `চোখ মেলে রেখে কী করবে তুমি, এবার ঘুমাও, হয়তো আশা আছে স্বপ্নে
তাকে দেখার।` আমি কী করে বলি, `হে রাত, হে দিন, জেগে থেকে বা ঘুমিয়ে কী
লাভ বলো, স্বপ্ন আর কল্পনার ওপর আমার তো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ছিল না
কখনও। সে এলে, এক পলক দেখি, যেন স্বপ্নেই দেখি। তাকে দুটি পলক
দেখার আশায় বলো, প্রার্থনার অধিক আমি কী করতে পারি। আর প্রার্থনার জবাব,
তা তো অপরের হাতে যে স্বাধীন। আর আমাকে করে রাখে পরাধীন প্রতীক্ষার
পাথর। দিন যায়, রাত যায়, পিপাসা শুধু বাড়ে, যেন পিপাসাই অমর। যেন
জমজমের পানি আমার জিভ কখনও পাবে না। কেননা তার হৃদয়ই একমাত্র
সেই পবিত্র কূপ। হৃদয়ের অসুখের একমাত্র ওষুধ। সে, আসে না। অগত্যা আমি
বসে থাকি। ততদিনে এমনকি পাথর ফেটে একটি কচি চারাও চোখ মেলে। আর
আমাকে দেখে হাসে। প্রশ্ন করে, তোমার ভুল কি ভাঙবে না এখনও! নিরুত্তর
তাকিয়ে থাকি আমি। মনে পড়ে, কবে যেন একবার তুমি এসেছিলে। এক পলক,
যেন-বা স্বপ্নে।` কিন্তু কী করে তোমার ডানা দুটি বাঁধি, যেন ফের দূরে যেতে না
পারো! আমি কী করে ভুলি, শুভ্র হংসীটি ওড়াউড়ি করে। এ দৃশ্যই আমার চোখে
এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ডানা বাঁধি যদি এ দৃশ্য দেখতে পাব না আর।
আমি বসে থাকি, সাদা পাখা দুটি আকাশে ভাসিয়ে যদি আসো। কী অদ্ভুত, যদিবা
আসো, আমাকে তরঙ্গিত করে নির্দ্বিধায় ভেসে যাও, যেন-বা রূপই সব, হৃদয় নেই!
যেন স্বপ্নে দেখেছি। চোখ মেলে দেখি, নেই! যদি জানতে, আমার স্বাধীনতার মতোই
তোমার স্বাধীনতাকেও আমি খুব ভালোবাসি। অথচ কষ্ট হয় খুব এ চোখে, এ হৃদয়ে!
যদি জানতে, আমার দুচোখ দিয়ে আমার হৃদয়ই তাকায়। যদি দেখতে পেতে তুমি,
মরুর দিগন্তে সবুজ স্বপ্নের লোভে মেঘের মতোই কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়তে তুমি!
পথ
পথ বড়ই ছেনাল। ডাকে, আয়। এ দিকেই যেতে হবে।
আমিও সমানই ধড়। যাই আমি। সেদিকেই আমি যাই।
শুরু সেখানেই, শেষ যেখানে। তুমিও জানো। জানি আমি।
তাই শেষ থেকে শুরু। অচেনা দিগন্তে রাখি পা দুখানি।
ঘাসের সমাপ্তি নতুন পথ করে রচনা। তবু দেখো
পথহীন আমি চিরকাল। পথে আছি মানে, আছি আমি
পুরোনো পথেই। পথহীনতাই ভালো—এই জ্ঞানে চলি
আমি আপন পা দুটি রক্তস্নানে নিশিদিন সারাক্ষণ
পবিত্র করে। না হলে, কী করে নতুন পথ সৃষ্টি হবে!
লোকে লাল টকটকে পা দেখে কপালে তোলে চোখ!
ফুলের সুগন্ধ থেকে যদি জানা যেত, গাছের অমেয়
শ্রম কীভাবে মাটির অতল থেকে তুলে আনে, প্রাণের
রস, হৃদয়ের বিকাশের শত রঙ, কণা কণা ঢালে
দিনরাত পাপড়িতে পাপড়িতে, তিল তিল সাজায় জীবন!
বোধি
পাঁচ হাজার বছর ধরে, তোমার হাড়ের ছাই বহন করছি
এ কী বিশ্বাস, এ কী আসলে শ্রদ্ধা
কখন কোথায় ছিলাম, সে হলো আজ ইতিহাস
উত্থান, পতন, আর তাড়া খাওয়ার দিনগুলো
বলে যায়, কত কথা, বিবিধ ব্যঞ্জনা
কাঁটা, পুষ্প, কাঁটা, হাড়, মাংস, হাড়, কতবার, কতবার
হাড়ের গভীর থেকে, হাড়ের ছাই থেকে, জাগে তবু প্রজ্ঞা
অথচ আমিও জানি, সে জ্ঞান আত্মার নয়
আত্মজ্ঞানের নয়, অপর সত্তার
ভেতরের নয়, যেন স্রেফ বাহিরের
আর অনুভব করি, বাহির থেকে এসে
তারা ভেতরে বসে থেকে, যেন বাহির বাতাসে
দিনরাত আমার শাখা প্রশাখা নাড়ায়,
ভেতরে বসে বীজ হয়, ফের বীজ বাহিরে উড়ে যায়,
উড়ে যায়, কোথায় কোথায় কে জানে
তোমার হাড়ে যদিও কখনও তুমি ছিলে না
তোমার ভাবনা যদিও ছিল না হাড়ে, হাড়ের ছাইয়ে
তবু চারপাশ সেই ছাইয়ে মেখে গেছে,
তাদের ভয়, তাদের আনন্দ,
তাদের কত না স্বপ্ন, তাদের কল্পনা
আমি দেখি, যেন শখে উড়ানো ঘুড়ির কিছুটা সময় ওড়া নীলিমায়
তারপর সুতো ছিঁড়ে যাওয়া
কেন ছিঁড়ে যাওয়া, সে কি আমার মনের ভুল বিবেচনা
নাকি সুতো চিনতে ভুল হওয়া
নাকি নির্বাচনে, নাকি জোর বাতাস
নাকি জোর বাতাস দেখে উড়াতে চাওয়া
কে জানে, আসলে কোথায় থাকে, দৃষ্টির প্রশান্তি নির্মল আকাশ
আমি দেখি, দেখি, কীভাবে বাহির ভেতর হয়ে
ফের বাহির হয়ে যায়
আর পাল্টে পাল্টে কত অচেনা হয়ে ওঠে তারা
তবু যেন আর এত অচেনা নয়
সূর্যের অস্ত যাওয়া সর্বদা লাল, সর্বদা লাল, সর্বদা লাল
আমাদের দিগন্তে যেন, এই ঘটে বারবার
কাগজের নৌকা
কাগজের নৌকার বেশি নির্ভরতা কোথাও নেই।
আমি যা বানাতে শিখেছি তা শুধু ওই কাগজের
নৌকা। আমি যা উপহার পেয়েছি তাও শুধু তা-ই।
তুমিও কি আজ কাঠের নৌকায় চড়েছো বলে
ভাবছো। তুমি কি জানো, তা কাঠ নয়, কিংবা
তা শুধু রঙ করা সেই কাঠের টেক্সচার। দৃশ্যের
অধিক কিছু পায় না নাগাল আমাদের স্বপ্ন।
হয়তোবা তুমিও পাবে না। দৃশ্যের অধিক খুঁড়ে
সবাই কাগজের নৌকাই শুধু পায়। আর নিজেকেও
আবিস্কার করে ওই মাঝ সমুদ্রে। হাহাকার করে
কাগজের নৌকাটি ছাড়া আর কোনো অবলম্বন
হায়, আমরা করিনি আজও আবিষ্কার। তুমি যদি
কখনও বুঝতে বুদ্বুদই সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু
তোমার প্রাণ বুদ্বুদ হয়ে উঠুক, তা কি আসলে
চাইতে পারতে! ওহ কাগজের নৌকায় চড়া প্রাণ,
মাঝ সমুদ্রে সেই তুমি আজও বুদ্বুদ বিরোধী,
স্বপ্নের মাপে নীল পরিধি মাপো তুমি! কিন্তু আজও
দৃশ্যের কাছে দৃষ্টির শুধু পরাজয়! কাগজের নৌকা
নিয়ে খেলছে শিশু, দেখে, ঈর্ষা হয়, খুব ঈর্ষা হয়!
মেক-আপ
মাঝ মাঝে সবকিছু কেমন অর্থহীন মনে হয়!
মনে হয়, জয় মানেই আসলে নিকৃষ্ট পরাজয়!
এ বাজারে যারই মুখ দেখি, তীব্র মেক-আপ মাখা,
করুণ, কিংবা নকল হাসিতেই সবাই আত্মহারা!
হাসিই সেরা মেক-আপ, হায়, জানতো যদি তারা!
অহংকার
গরমের দিনে পুকুরে ডুব দেওয়ার মতো তুমি আরাম
কিন্তু তোমার হৃদয় এখন নাগালের কত বাইরে
যেন বেতের কাঁটাঝোপে লুকিয়ে পড়া সবচেয়ে সুন্দর মোরগটি
কক্ক-র কক কক্ক-র কক ডাক ছড়ায় অহংকারী গলায়
আমার কান সে ডাক শুনতে পায়, কিন্তু এগোতে পারে না