রথো রাফি
রথো রাফির দুটি কবিতা
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২১
ছবিয়াল ও শীতকাল
এটা শীতকাল। তাহলে মনে রেখো
বটতলা বাজারের মাঝখানে
ওই যে বাঁধাকপির পাহাড়
তার ওপর বসে যে এবার কাঁদছে
তার মাথায় গামছা বাঁধা, তার হাতে কাস্তে
হ্যাঁ, মাটির দাগে ভরা
আসমানি রঙের পাঞ্জাবি গায়ে
ওই যে কাঁদছে সাজুর বাপ
ক্যামেরা তাক করেছে তার দিকে
খবরের কাগজের ছবিয়াল
যে প্রতি বছরই
এমন অনেক ছবি তোলে
আর পাঠায়
ছাপাও হয় একটা কি দুটা
তার অ্যালবামে আরও কতজনের ছবি
কেউ গোল আলুর টিলায়
মাথায় হাত দিয়ে বসা
কেউ ঝাঁকাভরা টমেটো
ট্রাকের নিচে ছুঁড়ে দিয়ে
রাস্তাটাকে নিজের রক্তের মতো
বিচ্ছিরি রকমের লাল করে তুলছে
ছবিয়াল হাঁটতে হাঁটতে ভাবে
মানুষের কান্নাগুলি আসলেই যদি
অ্যালবামবন্দি করে ফেলা যেত
শীত শেষ হবে কিন্তু ফের আসবে শীত
ফের ক্যামেরা তাক করতে হবে তাকে
হ্যাঁ, এবার যেমন নতুন আরেক জন
মানে ওই যে সাজুর বাপ কাঁদছে
বাঁধাকপির পাহাড়ে বসে
তার অ্যালবামটির বাইরে সেই
মানুষগুলো কি ভালো আছে
সে খবর তার আর নেওয়া হবে না
ভাবতে ভাবতে হাঁটছে ছবিয়াল
আর এবারও দূরত্ব বাড়ছে
যেন তাই সাজুর বাপের
কান্না ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এখন
নীল দরজার এ পাড়ে
আত্মহত্যার নীল দরজা সবসময় খোলা
আমি তাতে প্রবেশ করতে কখনও রাজি না
কিন্তু আজকাল কেমন যেন ভয় হয়
খাদের কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে
কখন না পড়ে যাই নিচে
অনুরোধ করি, তখন কেউ ভাববেন না
এটা আত্মহত্যা, এ স্রেফ একটি দুর্ঘটনা!
সবাইকেই ভাবতে বলি,
লোকটা স্রেফ পা পিছলে খাদে পড়ে গেছে!
তার অনেক চেষ্টা ছিল, খাদে না পড়ার!
কিন্তু খাদের কিনার থেকে লোকটা
এক তিল দূরে যাওয়ার সুযোগ পেল না এ জীবনে!
এটা সত্যি, আর এটাই তার নিদারুণ ব্যর্থতা!
তার ভাবনা মতো পৃথিবী চলে না,
লোকটা জানতো
কিন্তু পৃথিবীর ভাবনা মতোও
চলতে পারেনি লোকটা!
মনে রাখবেন, লোকটা
বাঁচতে চেয়েছিল আনন্দে, যৌথতায়,
নিজের ভাবনার সঙ্গে
অন্যের ভাবনা মিশিয়ে
নিজের স্বাধীনতা ও অন্যের স্বাধীনতাকে
সযত্নে বাঁচিয়ে রেখে
কিন্তু লোকটা বারবারই দেখতে পেল
একের স্বপ্ন আজও অন্যের স্বপ্নকে হত্যা করে
বাঁচায় না, বাঁচায় না, না-হ, বাঁচায় না,
তবু লোকটা নিজের স্বপ্নের সঙ্গে
অন্যের স্বপ্ন মিশিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, বাঁচতে পারেনি
লোকটা কেমন একা ছিল
একটি আলিফের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো
দেখতো শূন্য মাঠ, দেখতো শূন্য আকাশ,
আর কী নিবিড় সঙ্গবিহীন অন্ধকার
লোকটা দেখতো সঙ্গবিহীন ভিড়ের এক দেশ
তাকে কী ভীষণভাবেই না চেপে ধরেছে
সে আর শ্বাস ফেলতে পারতো না,
তবু প্রাণপণ চেষ্টা করতো
বুকের ভেতর অক্সিজেন টেনে নিতে,
লোকটা সাঁতার না জানা বালকের মতো
শুধু হাত-পা ছুঁড়তো
নির্মম জলের ওপর ভেসে থাকবে বলে,
হৃদয়ের কথা ভেবে হাত বাড়ালেও
কোনো হাতের নাগাল পেত না সে!
লোকটা শুধু জপ করতো,
আত্মহত্যার নীল দরজা সবসময় খোলা
কিন্তু আমি তাতে ভুলেও প্রবেশ করতে রাজি নই