রথো রাফির গল্প ‘মধু’
প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২০
ধড়হীন একটা মাথা, ডান গালের একটা অংশ কাটা, রক্তাক্ত। কালো চুলগুলোও রক্তে ভিজে চপচপে হয়ে আছে। চার পাঁচটা প্রজাপতি, অনেক মৌমাছি এর ওপর ধ্যানী হয়ে বসা। একটা ঝোঁপের নিচে পড়ে আছে মাথাটা। একটা জবাফুল তার ডাল নিয়ে এর উপর ঝুঁকে রয়েছে।
এসবই দেখতে পেয়েছিলো সে। তখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। বাড়ি গেলো ও ক্যামেরা নিয়ে ফিরে এলো। নানান এঙ্গেলে ছবি তুললো। ফিল্ম ওয়াশ করে দ্রুত বাছাই করা কিছু ছবি দৈনিক শ্যামবাজারে পাঠিয়ে দিলো। ছাপা হয়ে পরদিন ভোরে সেই ছবি ফের হাজির হলো তার ঘরে। দূরের লোকদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা অনুমানের চেষ্টা করলো সে। এলাকার লোকজন দেখলো, বিস্মিত হলো। ছবিটার প্রসঙ্গে প্রশংসাও করলো পরিচিত অনেকে, বা ওফ, বা ওহ, বা আহারে জাতীয় শব্দও ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো, যা আতঙ্কের চেয়ে বিবমিষাকে প্রকাশ করে বেশি, আর এ জন্য ঠোঁটের যে-যে ধরনের আকার নেয়ার কথা, নিয়েছিলো, যদিও সেসবেরকিছু আকার সে খেয়াল করেছে, কিছু করেনি। আর একজন, তারই বন্ধু, সেই তাকে ঘটনাটা জানিয়েছিলো, প্রথমে। সেই বন্ধুটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো চ্যানেল এভরি হোয়ার-এ। প্রচারও হলো সেদিন সন্ধ্যায়, নিজের ঘরে টিভি না-থাকায়, বরাবরই চক বাজারের স্টলে বসে চা খাওয়া ও সংবাদ দেখার সুযোগ করে নেয়, যদিও সেদিন বাজারে আসার বেশ আগেই সন্ধ্যা শেষ হয়ে যায়।
ছবি তোলার পরপরই গ্রামের লোকজন এসে ভিড় জমায়। সবাই একে একে একটা কাঁটা মাথা দেখতে পায়। একটা ঝোপের নিচে। ডানগালের চামড়া কর্তিত, চামড়ার বেশ অংশ ফাঁক হয়ে ঝুলে আছে, রক্তাক্ত। এবং চুলগুলো রক্তভেজা। মাথাটার ওপর তখনো মগ্ন চার পাঁচটা প্রজাপতি। অনেকগুলো মৌমাছি। মৌমাছিগুলোর কিছু উড়ে যাচ্ছে, কিছু ফিরে আসছে। ভোরের রোদ তেরছাভাবে ঢুকেছে ঝোঁপের ভেতর। আর সূর্যের আলো থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না, হয়নি এই কাঁটা মাথাটাও। মাথাটার একটা রক্তাক্ত চোখ সূর্যোদয় দেখছে, নতুন একটা দিন শুরু হচ্ছে। সূর্যের আলোর ফালিটাও ঐ চোখটাকে লক্ষ্য করছে, এবং উজ্জ্বল করে তুলেছে একে। এসবই সে দেখতে পেয়েছিলো। এক বুড়ো দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে চোখ কুচকে রেখেছে, এক মহিলা আঁচল তুলতে ভুলে গেছে, চোখ বড়ো বড়ো হয়ে আছে, একটা শিশু মুখ-চোখ বুজে কার বুক ঝাপটে ধরেছে, চিত্কার করছে, আর শিশুটার হয়তো মা বা খালা বা ফুঁপু বা চাচির বুকের কাপড় খসে পড়েছে, দুটো স্তনই ভোরের সূর্যের চোখে পড়লো, বোতামছাড়া, সেফটিপিন-হীন ব্লাউজের ব্যর্থতায়, চোখে পড়লো ধবধরে সাদা দাঁড়িঅলা বুড়োর, বাচ্চাটাকে কুলে ঝাপটে ধরেছে ঐ মহিলাটি, তখন এক কিশোরী তাকে ছড়িয়ে-পড়া ময়লা শাড়িটা টেনে তুলে চেষ্টা করছে ঐ মহিলার হাতে, আর একটা ফটোলেন্স, একটা ভিডিও লেন্সও মাথাটাকে লক্ষ্য করছে, লক্ষ্য করছে দেখতে আসা লোকজনকেও, মহিলাকেও। সে ফটো তোলা শেষে লোকজনকে জিগ্যেস করলো, তাকে চেনে কি না। কেউই তাকে চিনতে পারছে না। একজন পাশের গ্রামের কেউ হতে পারে বলে অনুমান করলো। হাঁ এই ঝোপটার পাশেই একটা মসজিদ, এর পরেই পশ্চিম দিকে শুরু হয়েছে বিশাল প্রান্তর, কেবল জমি আর জমি, একেবারে নদীর পাড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে, কোন বাড়ি নেই, মাঠের মাঝ দিয়ে সিঁথির মতো একটা পথ, নদীর ঘাটে যাওয়ার, আর দিগন্ত পেরিয়ে শহরের যাওয়ার, নদীর বুকের উপর দিগন্ত উপুর হয়ে থাকে সারাদিন, নির্বিকার, নীল।
রক্তাক্ত চোখটা দেখছে, ছবি তোলে চলে যাচ্ছে সে, আরো নতুন লোক আসছে, বুড়োর ঠোঁট তিরতির কাঁপছে, এবং মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে, টুপিটা একেবারেই হেলে পড়েছে, সেদিকে খেয়াল নেই। এক তরুণ ছেলে এগিয়ে এসে ঝুকছে মাথাটার উপর, নাকমুখ চোখ চুল গলার রক্তাক্ত কাটা জায়গাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এরপর সবার দিকে নীরবে তাকালো, লোকগুলো তাদের দৃষ্টি তার উপর ফেললো, এবং দেহটা মনে হয় নদীতে ফেলে দিয়েছে, তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলে এ কথাকটি, লোকজন বললো: তা হতে পারে।
ডানগালের চামড়া কর্তিত, চামড়ার বেশ অংশ ফাঁক হয়ে ঝুলে আছে, রক্তাক্ত, এবং চুলগুলো রক্তভেজা। মাথাটার ওপর তখনো মগ্ন চার পাঁচটা প্রজাপতি, অনেকগুলো মৌমাছি । মৌমাছিগুলোর কিছু উড়ে যাচ্ছে, কিছু ফিরে আসছে। একটা ঝোপের নিচে। ভোরের রোদ তেরছাভাবে ঢুকছে ঝোঁপের ভেতর। আর সূর্যের আলো থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না, এই কাঁটা মাথাটাও হয়নি। এক ঝাঁক চড়ুই ঝোপে ঝাঁপিয়ে নামতে এসেও পলকেই অন্যদিকে উড়ে গেলো। মাথাটার একটা রক্তাক্ত চোখ সূর্যোদয় দেখছে, নতুন একটা দিন শুরু হচ্ছে।
তো ঘরে কয়েকদিন পরেই মধু নিয়ে ফেরে লোকটা, মানে ফটো-সাংবাদিক লোকটা। বাজার থেকে বাড়ি আসার পথে ঐ লোকটি তাকে ডেকে মধুর শিশিটা হাতে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু তারও আগে, অজ্ঞাত নিহত লোকটার পরিচয় জানা গিয়েছিলো, আর এ ঘটনার নেপথ্যের পার্থিব কারণগুলাও। যদিও বাজারে গুঞ্জন, আর হাহুতাশের কথা এ ঘটনাকে ঘিরে পাক খাচ্ছেই নিরন্তর, তবু এ নিয়ে তার ভাবনা আর ব্যস্ত ছিলো না, টুকটাক খোঁজ-খবরটুক রাখা ছাড়া, এ নিয়ে আবেগ তার নিঃশেষ হয়েছিলো দুএকদিনেই। মনে হয় খুন, মারামারি, মাথা ফাটাফাটি সবচেয়ে সাধারণ ঘটনা তার পেশা-জীবনে, ফলে বিস্ময়ের ধার এমনি ক্ষয়ে গেছে অনেকটা।
কিন্তু বউকে ডেকে, দেখো পোলার জন্য মধু আনছি বলে ঘরে ঢুকে, সে শিশি থেকে কয়েকফোঁটা মধু নিয়ে তার শিশুটার মুখ হা করিয়ে জিভে দেওয়ার সময় একটা ভাবনা তাকে থমকে দেয়। সে মুধুর ফোঁটাটা ড্রপার থেকে তার শিশুটার জিভে আর ফেলতে পারবে না বলে মনে হয়। কিন্তু ফোঁটাটা ড্রপার থেকে ছুটে যাওয়ার এক মুহূর্ত আগেই লোকটির চিন্তার আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে একটু কেঁপে ছিটকে পড়ে, ছিটকে দশ আঙুল নিচে নেমে মধুর ফোঁটাটা শিশুর জিভের দশ আঙুল ওপরে হাওয়ায় ভেসে থাকে স্থির হয়ে। মুধুর ফোঁটাটা ড্রপার থেকে শিশুটার জিভে আর ফেলতে পারবে না বলে তার মনে হয়। কিন্তু ফোঁটাটা ড্রপার থেকে ছুটে যাওয়ার এক মুহূর্ত আগেই লোকটির চিন্তার আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে একটু কেঁপে ছিটকে পড়ে, ছিটকে দশ আঙুল নিচে নেমে মধুর ফোঁটাটা শিশুর জিভের দশ আঙুল ওপরে হাওয়ায় ভেসে থাকে স্থির হয়ে। এই ফাঁকে তার ভাবনাটি আবার তাকে চালিত করতে থাকে অতীতে, কল্পনায়, যুক্তির মারপ্যাচে, আর সম্ভাবনার ঘূর্ণীতে তাকে এক পলক পাক খাওয়ায়।
ঝোঁপের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা পুব থেকে এসে পশ্চিমে চলে গেছে। ঘটনার স্থন থেকে সে-রাস্তা বরাবর পুব দিকে হেঁটে পাঁচ সাতটা বাড়ি পেরোলেই ঐ লোকটার বাড়ি, যে-বাড়িতে মৌচাকটি সে দেখেছিলো, এবং নিজের শিশুটিকে মধু খাওয়ানোর একটা আবেগ তাড়া করে তাকে। সেই লোকটিকে, বাজারে নিজের ছোট চেম্বারে, ডাকিয়ে এনে তাই অনুরোধ করেছিলো : আমাকে, চাকটা ভাঙলে, মধু দিয়ো। এই তো দশপনের দিন আগের ঘটনা।
লোকটার কল্পনা হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে অসীম ব্যাপ্তি পায়। দেখতে পেলো, প্রজাপতিগুলো কাটা মাথা থেকে উড়ে, জবা ফুলটা পেরিয়ে, একের পর এক আরো ফুলে গিয়ে বসছে। আর তাদের পা থেকে রক্তের ছুপ লেগে যাচেছ প্রার্থনার মতো ছড়িয়ে থাকা কোমল পাপড়িগুলোতে। একটা মৌমাছির ডানা রক্তে লেপ্টে ভারী হয়ে পড়েছে, উড়তে পারছে না। একটা প্রজাপতি উড়তে গিয়ে হেলছে দুলছে, আগের স্বাভাবিকতা নেই, রক্তের একটা দাগ তার ডানার সমস্ত সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। একটা হামিং বার্ড কাটা মাথার কানের চপচপে রক্তের ভেতর থেকে লম্বা ও সরু ঠোঁট উঠিয়ে নিয়ে জবার লম্বা পাপড়ির কুচি দেয়া লাল টকটকা শাড়ির অনেক গভীরে ডুবিয়ে দিচেছ ফের, মধুর লোভে। আর লোকটার মনে হচ্ছে, হামিং বার্ডটা বুঝি মধুর স্বাদ পাচ্ছে না আর আগের মতো, উল্টো আরো-পিপাসার্তই হয়ে পড়ছে। ব্যাকুল হয়ে ফুলের পর ফুলের গভীরে তার রক্তমাখা ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে, ফুলের গোপীনয়তায় রক্তের দাগ লেগে যাচ্ছে। সে ভাবলো: আমি কি এক ফোঁটা আমার বা শিশুটার জিভে এখন আর ঢেলে দিতে পারি! ভেবে বিস্মিত হলো, এক পলকের জন্যই তা। মুহূর্ত পরেই যেন স্বাভাবিক হলো সে, এবং পত্রিকার বান্ডেলটা বুক শেল্ফে থেকে নামালো।
তার প্রকাশিত রিপোর্ট এবং ছবিটা ফের দেখতে বান্ডেল থেকে পত্রিকাটা তুলে নিয়ে ভাঙা টেবিলের উপরমেলে ধরলো। ছবির ক্যাপশন: নির্মমতার আজব ছবি! খুনের ঘটনা নতুন নয় পৃথিবীতে, কিন্তু এমন দৃশ্য ভাষার ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে আমাদের বিমূঢ় করে ফেলে। যদিও আমরা ভয়ংকর ছবি ছাপি না, পাঠকদের মনে আঘাত লাগতে পারে ভেবে, তবু এই ছবিটা ছাপা হলো। কারণ, এমন অদ্ভুত ছবি এর আগে কেউ কি দেখেছে! কাটা মাথার ওপর এতগুলো প্রজাপতি ও মৌমাছি । এই ছবি খুবই দুলর্ভ। দুঃখজনক হলেও আকর্ষণীয়। যেনো একটা অজ্ঞাত নিঃস্পাপ নিহত-মুখে সৌন্দর্য তার মায়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছে। আমরা অবশ্যই খুনীর দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার দাবী করছি।
এখন তার মনে পড়লো। সে দেখতে পেয়েছিলো কয়েকটা মৌমাছি পথটার পূব দিক থেকে উড়ে আসতে, আর কয়েকটাকে কাটা মাথা থেকে পূব দিকে উড়ে যেতে। সে দেখতে পেয়েছিলো কয়েকটা মৌমাছি পথটার পূব দিক থেকে উড়ে আসতে, আর কয়েকটাকে কাটা মাথা থেকে পূব দিকে উড়ে যেতে। সে দেখতে ...
সে এক মুহূর্ত কল্পনা করলো, নিজের বাড়ির পাশের ডোবার পাড়ে সে বসা, আকাশ স্বচ্ছ নির্বিকার নীল, মাথার উপর কেমন ছড়িয়ে রয়েছে। আর ডোবার পানি চকচক করছে অগভীর, সূর্যের আলো ডোবার তলাকেও দৃশ্যমান করে রেখেছে, থিঁতানো কাদার ঢেউ খেলানো নিথর-তল, পানি স্থির, সে বোতলটা ঐ মধুর বোতলটা ছুঁড়ে মারলো, আর ঢেউ উঠলো গোল, বাড়ছে বৃত্তগুলো, সূর্যের আলোয় চকচক করলো বৃত্তগুলো, সে বোতলটা ঐ মধুর বোতলটা ছুঁড়ে মারলো, আর ঢেউ উঠলো গোল, বাড়ছে বৃত্তগুলো, সূর্যের আলোয় চকচক করলো বৃত্তগুলো,পাড়ে এসে লাগলো, এরপর আর ঢেউ নেই, দেখতে পেলো সে, বোতলটা কাঁদার গায়ে সেঁটে আছে। পানি নিথর, কিন্তু তা মানুষের মনের মতোই, খরকুটাও ছুঁড়ে মারলে কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে, ফের কেমন নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়ে; বোতলটা দেখা যাচ্ছে, পানির নিচে পড়ে থাকা বোতলটার দিকে সে তাকিয়ে রইলো। বউ তার পেছনে, কাঁধের পাশে, দাঁড়িয়ে বোতলটার কথা জিগ্যেস করছে তাকে, সে বউয়ের মুখের দিকে তাকালো, ঘাড় ঘুরিয়ে।
কিন্তু তারও আগে, লোকটা টের পেলো, মধুর ফোঁটাটাকে আর কোনভাবেই সে থামাতে পারছে না, দেখতে পেলো, হাওয়া থেকে শিশুর জিভের দিকে ফোঁটাটি হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, এবার...