রথো রাফির গদ্য ‘রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত নিয়ে এ মুহূর্তে বিতর্ক কেন’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪
দেশ একটি গণঅভুত্থানের মধ্য দিয়ে গেছে। মসনদের লোভে শত শত মানুষকে হত্যা করেও গণবিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হয়েছেন শেখ হাসিনা। অবশেষে এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার দাবিটি সামনে এসেছে। বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে চায় তারা। ছাত্রদের এ দাবিকে দলমত নির্বিশেষে সমর্থন জানিয়েছেন সবাই। এ লক্ষ্য পূরণের কাজে এরই মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের। এজন্য দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূল করা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কিংবা সংবিধান সংশোধন, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রবান্ধব করার বিশাল দায় রয়ে গেছে।
এমন কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার আগেই নতুন করে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন এমনটা করা হলো? কেন নতুন সরকারের প্রধান কাজগুলোকে আড়াল করার এই অপচেষ্টা? কেন এ মুহূর্তেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামী বনাম আওয়ামী লীগ এমন আলোচনাকে মাঠে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা? এতে ফের দলীয় বিভক্তির খপ্পরে কি পড়বে না দেশ?
কথা হলো, নতুন প্রজন্ম দেশের জাতীয় সঙ্গীত শোনে। কপালে জাতীয় পতাকা বাঁধা ছাত্র-জনতার এ গণঅভ্যুত্থানেও এই গান স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার হয়েছে। এ গান শুনে কখনও এর ব্যাকগ্রাউন্ড ইতিহাস জানতে যায় না নতুন প্রজন্ম। এ সত্য ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কিংবা এর রচনার পেছনের সেই ইতিহাসকে পাত্তা দেয় না কিংবা ধারণও করে না তারা। আসলে শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, বাংলাদেশের কেউই পেছনের সেই ইতিহাসকে ধারণ করে না।
স্বাধীনতা যেমন সবসময়ের লড়াইয়ের ফল, কখনও প্রথম স্বাধীনতা, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু হয় না। এটা সর্বমুহূর্তের সংগ্রামের ফসল। তা প্রতিমুহূর্তে অর্জন করে নিতে হয়। তাই স্বাধীনতার সংগ্রমের কোনো শেষ নেই, ছিল না কখনও। সংগ্রামের অর্জন কখনও কখনও বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকে, একেই মনে হয় একমাত্র অর্জন ও সফলতা। মোটা দাগে প্রতিটা বড় অর্জন মানুষকে সফলতার স্বাদ দিতে গিয়ে বিভক্তও করেছে। এর ফল ভোগের পাশাপাশি নিজের গোলায় তুলেছে লোভী ও লুটেরা অভিজাত ব্যবসায়ী ও নীতিহীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো। সাধারণ মানুষ আগের মতোই বঞ্চনার খাতায় পড়ে আছে। তো বলছিলাম, জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে এ গান রচনা করেছিলেন, সত্য। সুর নিয়েছিলেন লালন গানের ভক্ত ও গায়ক গগন হরকরার কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ সে কথা স্বীকার ও তার প্রচারের ব্যবস্থা করলেও সে সত্য সবসময় জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির আড়ালে রয়ে গেছে। একে লোকজ সুর হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তাই হয়তো তার কাছে ঋণ স্বীকার করা হয়নি। তবে গানটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সুরের ক্ষেত্রে ঠিকই বাউল কথাটি লিখে রেখেছেন। শিলাইদহে চিঠি বিলি করা হরকরার গানের কথা ভীষণভাবে লালন বা বাউল ঘরানার ও তার সুরে লোকজ ফ্লেভার থাকলেও এ সুরে বলতে গেলে দ্বিতীয় কোনো গান নেই। সুরটা লোকসুর হয়েও অসাধারণভাবে মৌলিক ও হৃদয়কাড়া। কেউ একে অনুকরণ ও অনুসরণ বলতে গেলে করেনি। তাই এ সুরের মৌলিকত্ব কানে আরও জোরালো ঠেকে।
গানের প্রচল রীতি কোনো অনুষ্ঠানে, স্কুলের প্যারেডে, বিভিন্ন দিবসে কিংবা মঞ্চে যখন গান গাওয়া হয় তখন গানের কথা কে লিখেছেন, কিংবা কে সুর করেছেন তা বলা হয় না। সরাসরি কে গাইছেন সাধারণত শুধু তার নামই বলা হয়। যন্ত্র অনুষঙ্গে কারা আছেন, তাও সাধারণত উচ্চারিত হয় না। এটা বাজে রীতি। গানের লেখক, সুরকারের নাম সাধারনত জানে না। তবে সুরের বৈচিত্র্য গানের কথা কার প্রায়শই মনে করাতে না পারলেও সচেতন শ্রোতাকে ঠিকই মনে করিয়ে দেয় সুরকারটি কে। তবে গানের লেখক, সুরকার, মিউজিক কম্পোজিশম কার তা প্রতিবার গাওয়ার সময় উল্লেখ করা উচিত।
প্রচল রীতির কারণেই অজ্ঞ অনেকে তর্ক তোলার সুযোগ পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ গানটির সুর চুরি করেছেন, যা ঠিক নয়। নিজের অজ্ঞতার দায় অন্যের কাঁধে চাপানো কখনও কাম্য নয়। এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝির হাত থেকে রেহাই পেতে, জাতীয় সঙ্গীতের কথা রবীন্দ্রনাথের ও গগন হরকরার সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সুর করেছেন কথাটাও এর সঙ্গে সবসময় জুড়ে থাকা দরকার। শিল্পের বড় মোজেজা হচ্ছে, এটা চিরকাল মানুষের মুক্তির পক্ষে কাজ করে। পথ দেখায়। এক্ষেত্রে লেখকের ইচ্ছের তোয়াক্কা করে না। শিল্প যেনবা কালের বিচারে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। উল্টো তা পক্ষপাতদুষ্ট লেখকের বিরুদ্ধে কাজ করে।
রবীন্দ্রনাথ দুই বাংলার একত্রে থাকার পক্ষে কথা বললেও, পূর্ববঙ্গের মানুষ নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই এ গানকে নিজের করে নিয়েছেন। শিল্প এভাবেই মানুষকে জয় করে নেয়। এটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রাণের গান হয়ে ওঠে। তারা কখনই এ গানের পেছনের ইতিহাসকে গায় না, গায় আত্ম-উপলব্ধির আয়তনটুকু ও এর জনগোষ্ঠীর প্রতি গভীর আত্মীয়তাকে। এই গানের মধ্য দিয়ে গভীর ঐক্যবোধে এই জনগোষ্ঠী জারিত হয়ে থাকে।
আরেকটি কথা, এই যুগে ফোকো, দেরিদা, লাঁকার দর্শনে জারিত নতুন প্রজন্ম জানে, টেক্সট ইজ অল (রলাঁ বার্থ-এর কথা)। পেছনের ইতিহাস ও লেখক কখনও বড় নয়, হতে পারে না। বড় হলো লেখাটি সরাসরি পাঠককে কী বলছে তা। বা পাঠক কি অর্থ করছে তাই সবচেয়ে বড় বিষয়। একমাত্র এ দিক থেকেই একটা লেখাকে গভীরভাবে ধারণ করা সম্ভব। ভূত ও ভগবানের আছরমুক্ত টেক্সটের দেখা পাওয়া সম্ভব। আর বাকি সব পথ, লেখাকে বড় নয়, শুধু লেখককে বড় ও পুজনীয় করার এক ভৌতিক লড়াই। তবে মজার ব্যাপার, জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আমরা টেক্সস্ট পড়ার সেই মুক্ত দর্শন না জেনেই এতোদিন চর্চা করে এসেছি।
টেক্সটের বাইরের ইতিহাস এর অর্থ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে প্রায়শই। এ রীতি আসলে লেখাকে এর ঈশ্বরের ইচ্ছেমাফিক অর্থের হাতে পাঠক গোষ্ঠীকে বন্দী রাখতে চাওয়ারই ইতিহাস। এ প্রবণতা এখনও এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল। ফলে স্বাধীনভাবে টেক্সটের অর্থ উৎপাদনে বঞ্চিত থাকছে তারা। এটা একটা বড় দুঃসহ রোগ। ফলে লেখার অর্থের বদলে লেখার বাইরে ঈশ্বর/লেখক কি বোঝাতে চাইছেন সেটাই কুস্তির বড় বিষয় হয়ে ওঠে। এভাবে দেখা টেক্সট ধর্মীয় চর্চার সমান্তাল হয়ে ওঠে মাত্র।
এ গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অনন্য। এটা যুদ্ধের দামামা বাজায় না, ভালবাসার গভীরতা ছড়ায় শুধু। যুদ্ধের কোন স্মৃতিকেও সামনে আনে না এবং জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা ছড়াতেও যায় না। মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত বস্তুগত ও মানসিক বিষয়গুলোকে শুধু সামনে আনা হয়, যা শ্বাশ্বত। অন্য জাতি বা দেশকে ছোট করার ছিঁটেফোঁটাও নেই এতে। জয় করার গর্বও এটা ছড়ায় না। নিজেকে অজেয়ও ঘোষণা করে না। কাউকে বা বিদেশী রাষ্ট্রকে শত্রু ঘোষণা করে না। গোরামী ও গোয়ার্তুমি বলে কিছু নেই। বিশ্বের আর কোন জাতীয় সঙ্গীত এতটা আগ্রাসন প্রবণতাশূণ্য কিনা তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
হয়তো আর কোন দেশের রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত এতো অনুরাগ ভরা নয়, এতোটা অস্তিত্বের বস্তগত ও মানসিক ভিতের ওপর দাঁড়ানো নয়। এটা ভুলে গেলে ক্ষতি আমাদেরই। বিশ্বের অন্য কোন জাতীয় সঙ্গীত এতোটা আপন দৃশ্যসমাহার ঋদ্ধ নয়, পাশাপাশি এতোটা লোকজ ও প্রাণ গলানিয়া সুরে বাজে কিনা সন্দেহ।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চালু হওয়া ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ শব্দবন্ধটাই বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী মনে হয়। মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ আসল না নকল। শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে, ৭১ দেখি নাই, ২৪ দেখছি। এর মানে কি, সেই সময়কার রাজাকার বাহিনীর কথাও তারা শুনে নাই, তাদের খুন ধর্ষণ সম্পর্কেও জানে না! বছর কয়েক আগে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছে হাসিনা সরকার, যাকে পালাতে বাধ্য করেছে এই ছাত্রছাত্রীরা। তাহলে কি জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারও তাদের কাছে বড় কিছু নয়! অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আলোচনার বাইরে রেখে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে নিরপরাধী ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে দাঁড় করানোর একটা পরোক্ষ পায়তাঁরা কি এর ভেতরে রয়ে গেছে না!
জামায়াতকে রাজনীতি করতে দেওয়া মানে এদেশের নাজি পার্টিকেই রাজনীতি করতে দেয়া! অন্যদিকে, জামায়াত মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে সেনানিয়ন্ত্রিত একটি দল। তাই তারা চায়, আওয়ামী লীগ মাঠে আবার সরব হোক। হয়তোবা এটা সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্টেরও চাওয়া। জামায়াতের সাবেক আমীর মৃত গোলাম আজমের ছেলে জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলার কথা বলেছে। এ কথায় যদি ধরেও নেই, জামায়াতের সবার সায় আছে, তাহলে তা দেশের জনসংখয়ার অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, বড়োজোর ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এত দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বেশি নয়। তারা যদি জাতীয় সঙৃগীত পরিবর্ন না চায়, তাহলেই জামায়াতের চাওয়া বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা।
পাশাপাশি এরই মধ্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে জামায়াত। এর মাধ্যমে সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্টের চাওয়া হয়তো পূরণ করা হয়েছে। জামায়াত ও আওয়ামী লীগকে মাঠে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হচ্ছে হয়তো এভাবেই। জামায়াত যেখানে যুদ্ধাপরাধে জড়িত এবং আদালতে বিষয়টি বিচারাধীন। যেখানে দেশের মানুষ এ দলকে এখনও ক্ষমা করেনি। এখনও দলটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আশা করে তারা। আওয়ামী লীগ শেষপর্যন্ত এ দলকে নিষিদ্ধ করেও গণঅভ্যুত্থানকে রুখতে পারেনি— এটাও সত্য। এখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেয়ার ভেতর দিয়ে জামায়াত চায়, নিজেদের বিচার আদালতে হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিতে।
অন্যদিকে জামায়াতও হয়তো আওয়ামী লীগকে পরোক্ষভাবে বলতে চায়, আমরা তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছি, তোমরাও আমাদের ক্ষমা করে দাও। দুই দলই অপরাধ করেছে, অতএব তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারে দেশের ছাত্রজনতার দাবিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করার একটা জনবিদ্বেষী রাজনীতি এতে রয়েছে বলে সন্দেহ হয়। আওয়ামী লীগের কর্মীদের আওয়াজ এ মুহূর্তে কতটা শক্তিশালী হয়তো তাও পরখ করে নিতে চাইছে জামায়াত। তারা বর্তমানে লুকিয়ে থাকা লজ্জায় মুখ বন্ধ করে রাখা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মুখ খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে জামায়াত তাদের বড় দাবিগুলো সামনে আনা যাবে কিনা তারও অগ্রিম পরীক্ষা এটা।
সবচেয়ে বড় কথা, সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে বিএনপি একক আধিপত্য অর্জনের আশংকাই বেশি বলে মনে করে জামায়াত। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এলে বিএনপির ভোটের একক আধিপত্য অর্জন কঠিন হয়ে উঠবে। এ ছাড়া অভ্যুত্থানকারী ছাত্রদের নতুন দলও তৈরি হয়নি। এটা হতে পারে সামনের দিনগুলোতে। তবে সময় লাগবে। ছাত্র অধিকার পরিষদ ও এই নতুন দলটি গঠিত হলে জামায়াতের সুবিধা কিছুটা হতে পারে। এতে বিএনপির কিছু ভোট কমবে এবং কিছু আসন কমবে। জাতীয় পার্টিও কিছু আসন পাবে। এর ফলে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত সংসদে বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকার মতো আসনে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
এ আশাই হশতো আওয়ামী লীগ বিরোধীতার আসর থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথও উন্মুক্ত হতে পারে। প্রতিবেশি দেশের মিডিয়ায়ও জামায়াতের আমিরের প্রতি সম্প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। আর জাতীয় সঙ্গীত অপছন্দ প্রসঙ্গে কিছু কথা। যারা যোশ পায় না এ গানে, তাদের জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আত্মরক্ষায় বলিয়ান রণসঙ্গীত তো আছেই— চল চল চল উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল। সেটা সামরিক কায়দায় সামরিক ব্যারিকেডে বাজে কুচকাওয়াজে কুচকাওয়াজে। জনগণও গায়, তেতে ওঠে বিজয় দিবসে, জনপরিসরে। সেটাও কথায় ও সুরে অনন্য। অনেক দেশেই রণ সঙ্গীত নেই। এক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীতই রণসঙ্গীতের দায় পালন করে থাকে। আমাদের সেই দায় নেই। কারণ আমাদের রণসঙ্গীতও আছে।
যদি প্রতীকী অর্থে বলতে হয়, জাতীয় সঙ্গীত ও রণসঙ্গীত-এ গান দুটি আসলে আমাদের অজ্ঞাতেই আমাদের সেকুলার মননকে সামনে রেখেছে। মুসলমান প্রধান দেশের মানুষ একই ভাষার ভিন্ন দেশি ও ভিন্ন ধর্মী লেখকের গান হৃদয়ে জায়গা দিয়ে সবসময় গেয়ে আসছে। মনে রাখা উচিত বরীন্দ্রনাথ মানে বাংলা ভাষা। কবিতা, গান, গদ্য, গল্প উপন্যাস দিয়ে তিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বজ্ঞান ধারণের উপযোগী করেছেন। তাকে ভুলে যাওয়া মানে নিজের হৃদয় ও নিত্যপ্রয়োজন প্রকাশে জিভে নেচে ওঠা প্রিয় শব্দগুলোকেই ভুলে যাওয়ার শামিল। অন্যদিকে নজরুল তো সেকুলারের আরেক মহান চুড়া। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। আমরা তাকে দেশে এনে নিজেদের প্রয়োজনে নাগরিক করে নিয়েছি। নিজের জীবন যাপনে, কবিতা, গানে, গদ্যে, উপন্যাসে ধারালো ছুরির মতো তার সেকুলার আত্মা চকচক করছে! আমরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনকেই মাথায় রেখেছি।
সত্যি বলতে, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ধর্মের ক্ষেত্রে দেশবিদেশের কোন সীমা নেই। সাহিত্য ক্ষেত্রে দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে বিদেশীদের বাদ দিতে গেলে বিজ্ঞান ও ধর্ম ক্ষেত্রে কী হবে, তা কে জানে! তখন দেশপ্রেম রক্ষায় কী উত্তর দেবো আমরা! তবে কথা হলো রবীন্দ্রনাখ ও নজরুল যতোটা না বিদেশি, তার চেয়ে বেশি দেশি। বলতে গেলে দুইজনেরই সক্রিয়তার নিরিখে গোটা জীবনই কেটেছে অবিভক্ত বাংলায়। মানে তারা এই বাংলাদেশের মাটিতে দাপটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর নজরুল তো ঢাকা এসে উম্মাদনা জাগিয়ে তুলতেন তরুণদের মধ্যে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহেও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি এখনও বাংলাদেশে সংরক্ষিত।
এদিকে জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুও অবিভক্ত বাংলার মানুষ। তাই তারা সবাই কোনভাবেই বাংলাদেশের বাইরের নয়, বরং বলা উচিত এরা একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তাদের লেখালেখির বিষয় ছিলো দুই বাংলার মানুষেরাই। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাঙ্গালিদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। ৪৭ এর সীমান্ত ভাগ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাঙালীদের জীবনে অনেক পার্থক্য এনে দিয়েছে, সত্যি। তাই বলে মাত্র ৭৯ বছরেই তা শেষ হওয়ার নয়।
লেখক: কবি