আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান
রথো রাফির গদ্য ‘আমাদের মূল্যায়নের ভুল রীতিনীতি’
প্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২৪
মানুষের পড়ার সময় অনেক কম। তাই পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পছন্দের লেখককে সবার আগে চা-ই। এটাই পুঁজি হয়ে ওঠে হাঁটেমাঠে প্রধান লেখক নির্বাচনের রাজনীতিতে। এ রাজনীতি পত্রিকা সম্পাদক, সমালোচক ও প্রকাশকদের খুবই প্রিয়। তারা প্রত্যেকে নিজের ব্যবসায়িক, সংঘ, রাজনৈতিক ও পাঠকগোষ্ঠীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের পছন্দের লেখককে সামনে আনতে চায়।
আরেকজনকে প্রধান করতে গিয়ে অন্যজনকে অপ্রধান করে তোলার বিকার ছড়িয়ে পড়ে সমাজে। সেই বিকারই তীব্র হয়ে উঠেছে শামসুর রাহমান নাকি আল মাহমুদ সেরা, এমন তুল্যমূল্য কথাবার্তায়। এক্ষেত্রে বাজারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটা বাড়ে এ দুজনের, প্রকাশকরা বলতে পারবেন। মানুষের জীবনে কবিতা অনেক, সময় কম। তাই বলে প্রধান কবিদের একজনকে বেছে নিয়ে নিজেকে আরেকজন থেকে বঞ্চিত করতে হবে, এমন তো নয়।
আল মাহমুদে যে মজা, শামসুর রাহমানে অন্যরকম মজা। বৈচিত্র্যকে নিতে না পারা পাঠক, সাহিত্যের পাঠক নয়, অনেক সময় এমন আশংকাও দেখা দেয় মনে। তাদেরকে অনেকটা আত্মমাদকাসক্ত ও ধার্মিক ঝোঁকগ্রস্ত মনে হয়।
সুধীন্দ্রনাথে যা পাওয়া যায়, তা তো জীবনানন্দে সেইভাবে পাওয়া যাবে না। কেন জীবনবাবুকে একা বাছাই করে নিজেকে সুধীন বঞ্চিত করবো! কেন শক্তি পড়লে বিনয় পড়া যাবে না। কেন রফিক আজাদ পড়বো না। কেন আবু সাঈদ ওবায়দল্লাহ বাদ যাবে পাঠের তালিকা থেকে। আল মাহমুদ না জন্মালে এ কবির জন্ম অসম্ভব ছিল বলা যায়। তাতে কি তিনি যে কবিতাগুলো লিখেছেন, সেগুলো কি আল মাহমুদে লভ্য হতো কখনও!
একইভাবে আল মাহমুদ সামনে না থাকলে সৈয়দ হকের পক্ষে হয়তো `পরাণের গহীন ভেতর` লেখা অকল্পনীয়ই ছিল। তাই বলে কি তা আল মাহমুদে কখনও মিলবে? কিংবা মান্নান সৈয়দ ও সিকদার আমিনুল হকের বেশ কিছু লেখা কি ঢাকার মাটি ছাড়া সম্ভব সৃষ্টি, তারা কেন-ই বা পড়ার বাইরে থাকবেন? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেন পাঠকের চোখে থাকবে না। ফরহাদ মজহারের `এবাদত নামা` না পড়া তো নিজের বৈচিত্র্য তৃষ্ণাকে বঞ্চিত করার নামন্তরই।
একইভাবে আল মাহমুদের যে কোনো কথাই মান্য নয়। তিনি বলেছিলেন, “রফিক আজাদে কিছু নেই।” এটা এই একই রাজনীতির অংশ। অপরকে অবিবেচকের মতো খারিজ করা। হুমায়ূন আজাদ যেমন আল মাহমুদকে তার কবিতা সংকলনে জায়গা দেননি, যে আল মাহমুদের সোনালি কাবিন চোখের সামনে উপস্থিত না থাকলে তার সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় `সবকিছু নষ্টদের হাতে যাবে` কবিতাটির জন্ম অসম্ভব হতো বলেই মনে হয়। এও আজাদের এক ন্যাক্কার ধূর্তপনা কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কাছে স্রেফ মাথানত করা।
নিজেকে প্রথাবিরোধী দাবি করা আজাদের জন্য এ অতি অসম্মানজনক তো বটেই। কেননা এই হূমায়ূন আজাদই রক্ষণশীল টি এস এলিয়ট নিয়ে মেতে থাকেন আগাগোড়া। হায় স্ববিরোধ! এক্ষেত্রে সাহিত্য বিবেচনা কাজ করেনি একতিলও। এসবই সম্ভব হয়, সাহিত্যবস্তুর চেয়ে ব্যক্তি সাহিত্যিকের দিকে অতিমনোযোগ দেয়ার ফলে।
একটি ভালো সাহিত্যবস্তু সবসময়েই ইতিবাচক। এ কখনও নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। এই বিশ্বাসে আস্থাহারা মানুষজন সারাক্ষণ লেখার বদলে লেখককে গ্রহণবর্জনে উৎসাহিত হয়ে থাকে। একটি ভালো লেখা সবসময়ে এর লেখকের খারাপ দিকের চরম বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। স্বয়ং আল মাহমুদই এর বড় উদাহরণ। পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সোনালি কাবিন প্রসঙ্গে তাকে বারবার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর তার পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এ প্রশ্নের কত হাস্যকর উত্তর দিতে যে হয়েছে তাকে।
মানুষজন সেসব জবাবে আসলে হেসেছে। কারণ, আল মাহমুদ সোনালি কাবিন অস্বীকার করতে পারেননি, পারেনও না।আসলে এসবই মানুষকে/পাঠককে বোকা ভেবে নিজেকে চোখ ঠেরে নেতিবাচক খেলায় মেতে ওঠার ভুল ফল। ভালো লেখাকে আঁকড়ে থাকে মানুষ/পাঠক। লেখকের অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থানকে নয়। ফলে আলোচনার ভুলরীতি পাঠক সমাজে ধীরে মার খেতে থাকে, কবির জয় ঘটে সময়ের ধারাবাহিকতায়।
তো কথা হলো, মানুষের হাতে সময় তো এতটা ফুরিয়ে আসেনি এখনও। যে আমাদের প্রধান কবিদের একজনকে পছন্দ হলে অন্যজনকে পড়াই যাবে না। আমাদের মূল্যায়নের ভুল রীতিনীতি ও লাফঝাঁপ আমাদেরকে সাহিত্যের বিচিত্র স্বাদ থেকে স্রেফ বঞ্চিত করে— এই মনে হচ্ছে আজকাল। কবি ডিলান থমাসের একটা কথা আছে, একটা নতুন কবিতা লিখিত হওয়ার পরে পৃথিবীটা আর আগের মতো থাকে না। তো আমরা নতু কবিতা খুঁজবো, একটা হোক দুটো হোক, আমাদের বিচিত্র কবিতার ভাড়ার সমৃদ্ধ করবো, এটাই তো হওয়া উচিত।
কিন্তু একজনকে প্রধান বানাতে গিয়ে এমন অনেক নতুনকে হারিয়ে ফেলি। অথচ বৈচিত্র্যই কবিতাকে মূল্যবান করে। একজনকে প্রধান করে তোলা ও সমপর্যায়ের আরেকজনকে অপ্রধান করার মধ্য দিয়ে সেই মহমূল্যবান বৈচিত্র্যকেই ধ্বংস করার পথ উন্মুক্ত করি।
লেখক: কবি ও সংবাদকর্মী