অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
রওশন আরা মুক্তার গল্প ‘অলৌকিক লবঙ্গ’
প্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২১
আমার দাদুবাড়িতে একটা কুয়া ছিল। ছিল বলতেছি কারণ, সেই বাড়িতে এখন ডিপ্টিবল (ডিপ টিউবওয়েল) আছে। আর কুয়া থেকে পানি তোলার কষ্ট বা কুয়ার পানি তোলার বালতি পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা এড়াতেই কীনা জানি না, কুয়াটা এখন ব্যবহার হয় না। তবে কুয়া অব্যবহৃত থাকলে যেমন ময়লা পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, এই কুয়া এমনও না। শ্যাওলা ভাসা পানি দেখছিলাম লাস্ট বাড়ি যাবার সময়। ছোটবেলায় বাড়ি গেলে আমি কুয়ায় উবু হয়ে নানা রকম শব্দ করে সেটার প্রতিধ্বনি শুনতাম। যাই বলতাম তা ফিরে আসতো, এটাই তখন একটা বিশাল ম্যাজিক ছিল আমার কাছে। এছাড়া কুয়াটার গায়ে আমার দাদা-দাদির নাম লেখা ছিল। ডিজাইন করে লাগানো ছিল কিছু পয়সাও; মানে আধুলি আর কি। এসবও দেখতাম খুব খেয়াল করে। মোহাম্মদ জাফর আলী মুন্সী, মোছাম্মৎ আছেন বানু, সাং-সানিয়াপাড়া- এই নামপরিচয় লেখা ছিল কুয়ার গায়ে। আমি আমার দাদাকে পাই নাই। উনি আমার আম্মা-আব্বার বিয়ের আগেই মারা গেছেন। আমরা আমাদের দাদিকে দাদু বলে ডাকতাম। দাদু ছিলেন একটা গাছের মতো। উনাকে কেন্দ্র করেই চলতো বাড়ির সব ধরণের কাজকর্ম। এই কুয়া খননের গল্পটাও দাদুর কাছ শুনছি অনেকবার।
প্রথম ব্যাপার যেটা তা হলো, এই কুয়াটা এইখানে হওয়ার কথা ছিল না, যেখানটায় আছে। আমার দাদাও তখন দুনিয়ায় নাই। আমার ভাই তখন ৬-৭ বছরের ছোট ছেলে। আপা তখন আম্মার কোলে। আমি আসি নাই দুনিয়ায় তখনও। আমার জন্ম ৮৮’র বন্যার কালে। কুয়াটা আমার চেয়ে ১-২ বছরের বড় সম্ভবত। দাদা যেহেতু ছিলেন না, কুয়া কই বসবে সেই সিদ্ধান্ত বাড়ির ছেলেরা, মানে আমার বাবা-চাচারাই নিয়েছিলেন আই থিঙ্ক। আমার ভাইয়ের মুখে শোনা, সেও সেখানে উপস্থিত ছিল যেদিন কুয়াটা খনন করা হচ্ছিল। আর বংশের বড় ছেলে হিসাবে তাকেই কোদাল হাতে মাটি কাটার কাজের শুভ সূচনা করতে দেয়া হয়। তো মাটি কেটে পানি উঠে যাবে যাবে এমন একটা পরিস্থিতি যখন তৈরি হলো, তখন বিকাল-গড়িয়ে সন্ধ্যা। পানি ওঠার আগেই কোদালের মাটিতে উঠে আসলো প্রায় আঙুল সমান একটা লবঙ্গ। জ্বী হ্যাঁ, লবঙ্গ। লবঙ্গ চিনতে পারবে না এমন অনেকেই আছে, এই ধারণা কারণ আমিও লবঙ্গ চিনতাম না। গরম মশলা বলতে যা মাংস রান্নায় দেয়া হয় তাদের ভিতর আমি শুধু এলাচিকে চিনতাম। পায়েশ টায়েশের ভিতর যার বিরক্তিকর বিচি থাকে, সেটাই এলাচি। তাহলে দারুচিনি কোনটা? যেটা গাছের ছাল। লবঙ্গ আর দারুচিনিতে ভেজাল লাগাইয়া দিতাম আমি। আর দিব না কেন? আমি তো ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়েও লবনহীন ডিমভাজা দিয়া ভাত খাইয়া ফেলতে পারতাম। আমার কোনো স্বাদের ফিলিংস ছিল না মনে হয়। এবং কোনটা কী এইটাও আমি কম বুঝতাম।
আমি লবঙ্গ চিনি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। গ্রামে খালাতো বোনের বিয়াতে দেখলাম, কুমকুমের ভিতরে লবঙ্গ ভিজায়া বউয়ের কপালে ডিজাইন করা হইতেছে। লাল-সাদা রঙের কুমকুম দিয়া বউ সাজানোর প্র্যাকটিসের সাথে আগেই পরিচিত ছিলাম, সেই বিয়াতে জানলাম লবঙ্গ দিয়া বউও সাজানো যায়। কারণ লবঙ্গের ছাপটা হয় ফুলের মতো, চারদিকে চারটা পাতার মতো। গাছের ডালের তৈরি ফুল বলা যায় একে। লবঙ্গ সাধারণত একটা নখের সাইজের হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কুয়া খনন করতে গিয়া যে লবঙ্গ পাওয়া গেছিল, মাটির অনেক গভীরে- সেটা ছিল আঙুলের সমান। দাদু আমাকে তার কেনি আঙুল (কড়ে আঙুল) দেখায়া বলতেন, সাইজটা এমনই ছিল। এবং সেই লবঙ্গের ছিল অসাধারণ ঘ্রাণ। দাদুর মতে সেটার বাস্না (সুগন্ধ) সারা বাড়িতে ছড়িয়ে যায়, আর আশেপাশের মানুষও সেটা দেখতে আমাদের বাড়ি ছুটে আসে। মাটির এত নিচে তাজা লবঙ্গ পাওয়া গেলে তা নিয়ে সবারই আগ্রহ হওয়াটা স্বাভাবিক। এমন ঘটনা তো আর প্রতিদিন ঘটে না।
কুয়া খনন স্থগিত করে দেয়া হলো। কারণ ঘটনার আকস্মিকতায় কী করা যায়, কেউ বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এছাড়া সন্ধ্যাও হয়ে যায়। সবাই যে যার কাজ করে ঘুমিয়ে পড়লে আমার বাবা-চাচাদের কেউ একজন স্বপ্নে দেখেন, এই জায়গাটিতে কুয়া খনন করা যাবে না। কুয়া খনন করতে হবে অনত্র, কারণ হিসাবে জানা যায়, খননকৃত স্থানে রয়েছে পরিদের নিবাস। এবং তারা চায় না সে স্থান ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। মানে ওই মুহূর্তে তারা যেতে চায় নাই। পরি নিয়ে আমার আব্বারও কিছু কাহিনি আছে। তিনি মোরগফুলের বাগান করে সেখানে জ্যোছনা রাত্রে বাঁশি বাজানোর চেষ্টা করতেন। একদিন দাদু কোদাল দিয়ে সেই বাগান ম্যাসাকার করে দিয়ে বলেন, এসব করা যাবে না। ব্যস। আমার আব্বার বাগানও শেষ, বাঁশিবাদকতা ও পরির দেখার ইচ্ছা সব খতম। আমার দাদুর অদ্ভুত পাওয়ার ছিল। অতিরিক্ত ভালোবাসতেন তবে বন্দি করতেন না। অবশ্য বাগান ম্যাসাকারের যথেষ্ট কারণ ছিল। আমার আব্বা দেখতে আনকমন ধরণের সুন্দর ছিলেন। নজর লাগাটা খুব স্বাভাবিক ছিল গ্রামদেশে তখন। এমনই এক নজর লাগার শিকার হয়ে বালকবেলায় আব্বার সারা শরীরে ফোস্কাও পড়ছিল। এগুলোও দাদুর কাছেই শোনা।
যাই হোক, স্বপ্ন মারফত জানা গেল, কুয়া করতে হবে অন্য আরেকটা স্থানে। যেখানে করা হচ্ছে ওই স্থানে পরিরা থাকতে চায়। কুয়া করলে অসুবিধাও হতে পারে। পরদিন গ্রামের অন্যান্যদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত হলো, গর্তটা ভরাট করে দেয়া হবে। আর স্বপ্নে যে স্থানে করতে বলা হইছে, সেখানেই হবে কুয়া। যেই কথা সেই কাজ। পরিদের ঘরবাড়ি ঠিক করে দেয়া হলো। আর আমাদের বাড়িতে হয়ে গেল সুন্দর এক কুয়া। এই কুয়ার পানিতেই খাওয়া, গোসল, কাপড় ধোয়া, থালাবাটি মাজা সব কাজ হতো। আশপাশের মানুষও এই কুয়ার পানি নিয়ে যেত। তখন তো আর এত টিউবওয়েল ছিল না। আমাদের কুয়ার পানিতেও কোনো আর্সেনিক বা অন্য সমস্যাও হয় নাই কখনই। আমি নিজেও বাড়িতে গেলে যতই পুকুরে দাপাই না কেন, কুয়ার পানি দিয়েই গোসল শেষ করতাম। এমন সুশীতল পানি আমি আর কোথাও দেখিও নাই, পাইও নাই, খাইও নাই! দুঃখের ব্যাপার, কুয়াটা আছে কিন্তু পানি আর ভালো নাই।
এ গল্প শুনে আমার প্রশ্ন ছিল, লবঙ্গটা কই? দাদুর সহজ সরল উত্তর, নাই। নাই মানে? এমন বিশাল একটা কাহিনি। লবঙ্গ না দেখলে ক্যামনে বুঝতাম, এইটা যে অলৌকিক? তখন শুনলাম আরও মজার কথা। আশপাশের বা দূর-দূরাফির (দূর-দূরান্তের) অনেক মহিলারা দাদুর হেফাজতে থাকা লবঙ্গটা দেখতে আসছিলেন। যা দাদু কাঁচের বয়ামে তুলে রাখছিলেন। কিন্তু সেইসব মহিলারা চিমটা দিয়া দিয়া লবঙ্গটা নিয়ে শেষ করে ফেলে। লবঙ্গের সুবাসটাই নাকি এমন ছিল যে, সবাই সেটা নিতে চাইত। বাড়ি গিয়ে দেখাতে চাইত। আর সেই পরিস্থান? সেখানে ফেলা হতো বাড়ির সব ধরনের ছাই। ছাইজাঁক বলা হতো তাকে।