যৌন সহিংসতা এবং আমাদের সমাজচিত্র

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০১৯

নারায়ণগঞ্জে এক শিক্ষক তার মাইনর ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে তাদের উপরে যৌন সহিংসতা (ধর্ষণ) চালিয়ে গেছে দিনের পর দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক শিক্ষকের বিচার চেয়ে তার ছাত্রছাত্রীরা পথে দাঁড়িয়েছে, অপরাধের মাত্রা এক না হলেও তিনিও ছাত্রীদের উপরে চালিয়েছেন যৌন সহিংসতা।

পত্রিকা খুললেই নারী নিগ্রহের খবর। সরকারি কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমজীবী, বাসের ড্রাইভার-হেল্পার— কেউ বাদ নেই। সবাই যৌন অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে নারীদের বিরুদ্ধে। অপরাধের শিকার হচ্ছে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকন্যা থেকে শুরু করে সত্তর বছর বয়সি নারী, রাস্তার পাগলি থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।

কারণ কি? শুধুই যৌনক্ষুধা? নাকি অন্য কিছু? কেউ বলছেন, মেয়েদের পোশাক দায়ী, কেউ বলছেন নারীদের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা দায়ী, কেউ বলছে নারীদের আরো সামলে চলতে হবে। মানে দোষ যেই করুক বা অপরাধের ধরণ যেমনই হোক সবক্ষেত্রেই নারী দায়ী। যার সাথে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাকেই বানানো হচ্ছে আসল অপরাধী।

পুরুষতন্ত্র এক জটিল বিষয়, কেবল পুরুষরাই এর অনুসারী নয়, নারীরাও রয়েছে তালিকায়। এমনকি, যেসব নারী সারাদিন পুরুষদের তুলোধুনো করেন, তারাও পুরুষতন্ত্রের ধারক। পুরুষতন্ত্র কাজ করে আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে, লৈঙ্গিক বৈপরীত্য নিয়ে সেভাবে না। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে, সমাজের চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখাটাই যেখানে মূখ্য। এখানে সাম্যের বা সম্মিলিত কিছুর বা দ্বিমত মেনে নেয়ার কোন সুযোগ নাই। তাই নারীর উপরে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করা আর পুরুষের উপরে নারীর শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। আজ অবশ্য এই নিয়ে কথা বলতে চাই না, এই তর্ক পরে একদিন হবে। আজ কথা বলতে চাই নারীর উপরে যৌন সহিংসতা বেড়ে যাবার কারণ নিয়ে।

হঠাৎ দেখলেন বিনা কারণে আপনার শিক্ষক বা অফিসের সিনিয়র সহকর্মী আপনাকে হেনস্তা করছে বা আপনাকে অপমান করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কারণ কি? নারীরা একটু ভাবতে থাকেন। আপনার মনোযোগে বা কাজে কোনো ঘাটতি? নাকি ওই শিক্ষক বা সহকর্মী আপনার নারী আর তার পুরুষ হবার সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না বলে সহিংস হয়ে উঠেছেন।

আসলে যখন কিছু বারবার ঘটে চলে, তখন আমাদের দেখার বা বুঝার বাইরেও আরো অনেক কিছু ঘটে, যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে সমাজ ব্যবস্থায়। পড়ছিলাম Risk Factors for Sexual Aggression in Young Men: An Expansion of the Confluence Model by Antonia Abbey, Angela J. Jacques-Tiura, and James M. LeBreton.

কয়েকবছর আগে ৪৭০ জন তরুণের উপরে এই সমীক্ষা চালানো হয়। তাদের নিজস্ব পরিচালিত একঘণ্টার অডিও রেকর্ডিংয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন কারণে তারা বিভিন্ন সময় নারীদের প্রতি সহিংস হয়েছে। এরমধ্যে এক শ্রেণি মনে করে, নারীদের ‘না’ মানে আসলে ‘হ্যা’ এবং এই ধারণার উপরে নির্ভর করে তারা যৌন সহিংসতা চালায়। মানে কোনো নারী যৌন সম্পর্কে অনিচ্ছা দেখালেও তারা ধরে নেয়, এটা সত্য নয়, নারীটি অবশ্যই মিথ্যা বলছে। এই শ্রেণির রয়েছে পূর্বের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। এদের কেউ শৈশব বা কৈশোরে কোনো বড় সহিংসতার শিকার হয়েছে, বাবা মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে বা নিজেদের ক্ষমতাহীন মনে করেছে।

আরেক শ্রেণি, সংখ্যায় এরা কম, নিজেদের অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাবে এবং মনে করে, অবশ্যই নারীরা তাদের অগ্রাহ্য করতে পারে না। এই ধারণা এতটাই বদ্ধমূল যে, কোনো নারী তাকে অগ্রাহ্য করলেই সে সহিংস হয়ে অপরাধ ঘটায়। এই শ্রেণি নারীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকে প্রেমের বা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ইংগিত হিসেবে নেয়। যেমন এদের সাথে হেসে কথা বললে, বেড়াতে যাওয়া বা কেবলমাত্র হাত ধরলেও এরা মনে করে, নারীটি শারীরিক সম্পর্কে আগ্রহী এবং নিজে থেকে সেটা সরাসরি প্রকাশ করছে না।

মদ বা মাদকদ্রব্য গ্রহণও আরেকটি বড় কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই মাদকাসক্ত পুরুষরা টার্গেট করে সামনে উপস্থিত নারীদের, সে পরিচিত বা অপরিচিত উভয়ই হতে পারে। আমাদের দেশে চলন্ত বাসে যে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে অনেকক্ষেত্রেই অপরাধীদের একাধিক জন হয় মদ বা অন্য কোনো মাদকে আসক্ত। এটি একটি বড় গবেষণা এবং আমি কেবলমাত্র ক্ষুদ্র একটা অংশ তুলে ধরেছি।

আরেকটি লেখা পড়লাম, সেটা নিউইয়র্ক টাইমসে এসেছে, Why men dominate women নামে। যা বুঝলাম, এখানে বলা হয়েছে সম্প্রতি নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ যতটা না শারীরিক, তারচেয়ে বড় মানসিক ব্যাপার। নারীরা সবক্ষেত্রেই এগিয়ে চলেছে, যেটা পুরুষদের একটা বড় অংশ মেনে নিতে পারছে না, তাদের জিনগত বিন্যাস আর পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব তাদের নারীদের প্রতি ক্ষিপ্ত করে তুলছে। এবং যৌন হয়রানির মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চাইছে, এখনও তারাই শ্রেষ্ঠ।

জার্নালগুলো বিদেশি হলেও, পড়ে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমার এক ড্রাইভার নারীদের পেশা হিসেবে গাড়ি চালানোকে বেছে নেয়াকে নিতেই পারতো না। বলত, সবদিকে পুরুষদের কোণঠাসা করে এবার আমাদের রুজির উপরে ভাগ বসাতে এসেছে। এইগুলা বাজে মেয়েলোক, এদের রাস্তায় নামিয়ে পিটাতে হবে। (আমি অবশ্য একদিন পরেই তাকে বিদায় করে দিয়েছিলাম)।

একবার ভেবে দেখুন, সে আমার সামনে এভাবে বলতে পারলে, যদি একা একজন নারীকে কোথাও হাতের নাগালে পায়, কিভাবে তার হিংসাকে নিবৃত্ত করবে। কোনো কোনো শিক্ষিত লোকও এরকমই ভাবে। রাগে, হিংসায় ফুঁসতে থাকে। সভ্য সমাজের বলে নিজের হিংসা অন্যভাবে চরিতার্থ করে, সরাসরি ঝাপিয়ে পড়ে না।

জানি না যেভাবে সমাজ এগিয়ে চলেছে, এই অবস্থা থেকে কবে বা কিভাবে মুক্তি আসবে। তবে পারিবারিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির সাথে সাথে মাদক নিয়ন্ত্রণ করে এর থেকে অনেক ক্ষেত্রেই বের হওয়া সম্ভব হতে পারে। সন্তানদের নারী-পুরুষের ভেদাভেদ না শিখিয়ে, মানবতার পাঠ দিয়ে গড়ে তুললে হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্ম এই শ্রেষ্ঠত্বের রশি টানাটানি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে শিখবে।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী