যৌন নিপীড়কেরা

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০১৮

ল্যারি নাসারের শুনানিতে ফলো আপগুলো একটানা আমি দেখে গেছি। শুনানিতে লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। ল্যারির সামনেই দাঁড়িয়ে সেখানে একজন ভিক্টিম বলছিল, কী ভেবে আপনি আমাদের সাথে এই জঘন্য কাজ করতে পারলেন? হ্যাঁ আমি অপ্রাপ্তবয়স্কা ছিলাম, তবে মনে রাখবেন, ছোট্ট অসহায় মেয়েগুলো সব সময় ছোট থাকে না। তারা বড় হয় এবং নিজেদের কষ্টের কথাগুলো বলতে পারে।
এত শক্তিশালী কথাগুলো আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো খুব। চোখে বারবার পানি এসে যাচ্ছিলো। ভিক্টিম আরও বলতে থাকে, সে রাতে ঘুমাতে পারতো না। কীভাবে এই যৌন নিপীড়ন তার শৈশবকে নষ্ট করে দিয়েছে, কালো এক স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। এসব যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতাগুলোর কথা একের পর এক বলে যায় অন্য ভিক্টিমরাও। বিচারকের এই মিডিয়া লাইভের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। এটি যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলোতে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্ক্যান্ডাল ছিল ল্যারি নাসারের যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো। কারণ এর ভিক্টিম সংখ্যা এখনো অস্পষ্ট। দেড়শে কিংবা এরও বেশি ভিক্টিমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তার ১৭৫ বছরের সাজা হয়েছে। ল্যারি নাসার কীভাবে এতদিন ধরে এত বিশাল সংখ্যক ভিক্টিমকে যৌন হয়রানি করেছেন, তা সাধারণ মানুষকে ভাবিয়েছে। হ্যাঁ, ভাবার মতোই ব্যাপারটা!
সম্প্রতি বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তাকে। একসময়ের যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এই জিমন্যাস্ট ডাক্তার একের পর এক তার ক্লায়েন্টদের হয়রানি করেছেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। যার বেশিরভাগ ছিল অপ্রাপ্তবয়স্কা জিমন্যাস্টরা। সেসময় অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যায় বা চাপা দেয়ার চেষ্টা চলে তৎকালীন জিমন্যাস্ট কমিটির দ্বারা। এই যৌন হয়রানি বিষয়ে সম্প্রতি ঝড় ওঠে হলিউডে পরিচালক হার্ভে উইনস্টনের বিরুদ্ধে। তা থেকে বলিউড কিংবা একরকম পুরো বিশ্বেই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শুধু ব্যাতিক্রম ছিল আমাদের দেশে। কেউ এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নয়।

ল্যারি নাসারের ঘটনায় ফিরে গেলে দেখা যায়, সে দেশের গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন করেছে, কেন এবং কীভাবে এই ডাক্তার দিনের পর দিন এতগুলো মাইনর জিমন্যাস্টদের হয়রানি করেছেন। প্রকাশ হয়, সেসময় ৯০ এর দশকের অল্প বয়স্কা মেয়েগুলোর কথা কেউ কানে তোলেনি। আর যেহেতু তারা অলিম্পিকে অংশ নিতে যাচ্ছিল, তাই এরকম স্ক্যান্ডাল চাপা দেয়াই ভালো মনে করে কর্তৃপক্ষ। আবার এদিকে ল্যারি নাসার নামকরা ডাক্তার, এই ইমেজ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল এসব অভিযোগ থেকে। আর তাই, ইউএসএ জিমন্যাস্ট বোর্ডে এই নিপীড়ক নির্বিঘ্নে কাজ করেন ৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। ২০১৭ তে প্রমাণসহ গ্রেফতার হন চাইল্ড পর্নগ্রাফি আইনে। তিনটি বিষয় সব সময় সব দেশে কিংবা কালচারে সমানভাবে দেখা যায়, যৌন হয়রানির কেসগুলোতে ভিক্টিমের অপরিণত বয়স। যেহেতু আমরা সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে এসে গেছি, তাই এরকম হিংস্র অমানবিক একটা আচরণ সম্বন্ধে না আমরা
আমাদের শিশুদের জ্ঞান দেই, না তাদের কথা কানে তুলি। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, নিপীড়কের পরিচয়। নিপীড়ক যদি নিকটাত্মীয় হয় কিংবা পরিচিত কেউ (যেখানে বেশিরভাগ নিপীড়ন পরিচিতদের দ্বারাই হয়) সেখানে আমরা সব সময় ধারণায় থাকি, বাচ্চা মানুষ মিথ্যে বলছে। এই লোক এমন কাজ করতেই পারে না। অথচ অপ্রাপ্তবয়স্ক একটা মানুষ কখনো এইসব বিষয়ে সাধারণ জ্ঞানই রাখে না। নিপীড়ন নিয়ে মিথ্যা বলে তার লাভ কি। এই ভাবনা দূরের ব্যাপার, সমাজের ভয়, লোকের ভয় আরও নানা রকম ভয় থাকেই।

আমার পরিচিত এক বড় আপু তার বাচ্চাকে শিখিয়েছেন, তার স্পর্শকাতর জায়গায় কেউ আদর করা মানে সেটা ভিন্ন কিছু। সেটা টর্চার করা। এই শিক্ষাগুলো যে কী জরুরি, সেটা কীভাবে বোঝাই সবাইকে? তাই যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ল্যারিদের মতো জন্তুগুলো পার পেয়ে যায় শুধু নামকরা কেউ বলে। তৃতীয় ধাপে আসি পরিবারের বাইরে হওয়া ঘটনায়। স্কুল-কলেজ কিংবা ক্রীড়া-প্রতিষ্ঠান কিংবা সে হোক কর্মক্ষেত্র, প্রতিষ্ঠান- বদনামের ভয়ে এড়িয়ে চলে এই ধরণের অভিযোগ। সেক্ষেত্রে শুধু নিপীড়ক নয়, এই ধরণের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সমান আইন প্রয়োগ করা দরকার। ল্যারি নাসার কেসে ভিক্টিমরা বারবার বলেছেন শুনানিতে, অভিযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের অবহেলা এবং ধামাচাপা দেয়ার ঘটনা। এক্ষেত্রে শুধু ল্যারি কেন, তৎকালীন কর্তৃপক্ষও সমানভাবে দায়ী।
তাদের নিরাপদ প্রশ্রয়ে এই ধরণের জন্তু নিজের ভিক্টিম সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় এক ধরণের ম্যানিয়াক হিসেবে এদের চিহ্নিত করলেও সবার সে ধরণের রোগ নেই, এটা একটা ক্রাইম। ঠাণ্ডা মাথার ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্ট্রি ছাড়া এইসব নিপীড়নে যারা যুক্ত তাদের বেশিরভাগই নিপীড়কই শুধুমাত্র। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে যখন বিশ্ব তোলপাড় তখনো আমাদের দেশ নিশ্চুপ। তাই বলে ভাবার কারণ নেই, এদেশ নিপীড়ক মুক্ত। কারণ ঘুরে ফিরে সমাজ আর লোকলজ্জা, আইনের শিথিলতা আর সমাজের ঠাণ্ডা মনোভাব। আমরা কবে পারবো এই ধরণের অপরাধীদের উপযুক্ত সাজা দিতে? কবে পারবো আমাদের শিশুদের নির্ভয়ে ছেড়ে আসতে? কবে পারবো ভিক্টিমদের বলতে, সে দোষী নয়, দোষী তার নিপীড়ক? কবে পারবো সচেতনতা সৃষ্টি করতে? কেন আমরা এখনো এগুলো নিয়ে কথা বলতে ভয় পাই?

যৌন নিপীড়নের কেস আমাদের দেশেও নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ঝড় উঠছে এর বিরুদ্ধে, কিন্তু বিচার হচ্ছে কি? আর হাজার মেয়ের এমনকি ছেলেদেরও অজানা কথা না হয় বাদই দিলাম, এই সমাজে মেয়ে মাত্রই সে কোনোভাবে কখনো না কখনো যৌন নিপীড়নের শিকার। কেউ মুখ ফুটে না বললেও একটা মেয়ের পরিবার কিংবা মেয়েটি নিজে চেপে গেলেও জানে, আমাদের সমাজ ভার্জিন মেয়ে চায়। কিন্তু কখনো জানতে চেয়েছেন, বোন, মেয়ে কিংবা স্ত্রী অথবা মায়ের কাছে? কাছের বন্ধু কিংবা প্রেমিকার কাছে সে নিরাপদ বোধ করে কীনা? তাকে হয়রানির শিকার হতে হয় কীনা? আমাদের সমাজ হাজারো নিপীড়কে ভরা। সম্মান শুধু যোনীতে আটকে থাকে না, একটা মানুষের আত্মসম্মানবোধে আটকে থাকে। তার ব্যাক্তিগত সম্মানে কেউ যখন আঘাত করছে, তাকে মুখে বা শারীরিকভাবে নিপীড়ন করছে, তাকে যৌন হয়রানি করছে, তখন আপনার বোধ যদি জ্বলে না ওঠে, তাহলে মানুষ হিসেবে আপনি
শুধুই একটা জননাঙ্গ হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন সমাজে এবং অন্যকেও তাই হিসেবে দেখছেন। নিপীড়কের একমাত্র পরিচয় সে নিপীড়ক। পুরুষ-নারী কিংবা সম্পর্কের নামে তাকে চিহ্নিত করার অবকাশ থাকে না। সে সমাজের নোংরা কীট শুধুমাত্র, সমাজের জন্য হুমকি। ল্যারি নাসারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে যদি নিপীড়কের সাথে তার প্রশ্রয়দাতার ও বিচার নিশ্চিত না করা যায়।