সংগৃহিত
যৌথতা: সামষ্টিক স্বার্থের নৈতিক বৈধতা যার ভিত্তি
ফিরোজ আহমেদপ্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০১৮
গভীর রাতে আপাত জটিল এই বিষয়টা নিয়া আলাপটা করে রাখতেই হচ্ছে। অত নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েও কেন বিএনপি-জামায়াত ঢাকা শহরে লোক নামাতে পারে নাই? কারণ নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে তার দুঃশাসনে। ফলে যতই মার খাক, সমর্থকের বাইরে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। ঢল নামেনি। বেগম সুফিয়া কামাল হলের এই মেয়েটার পাশে কেন শত শত ছাত্র এসে দাঁড়ালো গভীর রাতে! মাঝরাতে কেন ছাত্রলীগের নেতাদের ঘুম নষ্ট করে বহিস্কার করতে হলো রগকাটা সভানেত্রীকে? কিসের জোরে পরশু আপাত নিরীহ এই ছেলেমেয়েরা ছাত্রলীগকে ঠেকিয়ে না শুধু, ধাওয়াও দিলো?
কারণ ওই নৈতিক বৈধতার শক্তি যদি অনেককে একত্র করে, যেখানে কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, সকলের স্বার্থই সুতোর বন্ধন, সেখানে আরসব অস্ত্র, প্রশাসন ও শক্তি ম্লান হয়ে যেতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনা মাত্র ঘটা শুরু হয়েছে। আন্দোলনের এ জোর ধরে রাখতে পারলে এই ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি আরও খানিকটা এগিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু এর শক্তির উৎস কি? নৈতিক বৈধতা, সকলের এক দাবি, এক কণ্ঠ। আর কিছু না। বাকিটা অনুষঙ্গ। অস্ত্র কই? মদদ দেবে কে? একটা রূপকথার কথা মনে পড়ছে, বন্ধুকে আটকে রেখেছে তুষাররাণী, জেরডা তাকে খুঁজতে বের হয়েছে। জ্ঞানীবুড়ি দেখিয়ে দিলো তুষাররানীর আস্তানা। জেরডা অবাক হয়ে বলছে, তুষাররানী তো সবাইকে স্তব্ধ, মূক আর স্মৃতিহীন করে শাসন করে। তাকে হারানোর মতো কোনও মন্ত্র তো দাও! বুড়ি বলছে, তুমি এত নিষ্পাপ জেরডা, তোমার আর কোনও মন্ত্র লাগবে না...
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে রোমিলা থাপার এই মজার কথাটা বলেছেন, নাঙা সন্যাসীকে কেন ভয় পেতেন অমন সর্বক্ষমতার উৎস রাজা? কারণ সবাইকে কেনা আর বেচা যায়, শাস্তি কিংবা পুরুস্কার দেয়া যায়, একার জন্য, নিজের জন্য কিছু চায় না বলে রাজার একমাত্র প্রতিদ্বন্দী ওই সন্যাসীই। রাজা নিজের জন্য সব চায়, সন্নাসী নিজের জন্য কিছুই চায় না। তাই কেবল সে-ই রাজার প্রতিস্পর্ধী, তাকে অবমাননা করা হলে রাজার বৈধতাই আর থাকে না। হুবহু একই ভূমিকা পালন করতেন দরবেশরাও। গাজ্জালির ইহয়ুইয়াউ এলেমউদদীনে দেখা মিলবে অজস্র কড়িহীন দরবেশের, যারা খলিফার মুখের ওপর বলে দিতে পারতেন তাদের অপরাধের খতিয়ান। সর্বহারা সে, সব পেল তাই, রবীন্দ্রনাথকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, সবার সমর্থন তার পেছনে, কারণ সে আত্মসর্বস্বতা ত্যাগ করেছে। এই ভূমিকা পালন করেন বুদ্ধিজীবীরা। দুঃখজনকভাবে তাদের সংখ্যা কত কম চারদিকে। কিন্তু এই শক্তি আমরাও অর্জন করতে পারি, যখন আমরা এমন কোনও যৌথ দাবি জানাই, যেখানে আমি আছি ভগ্নাংশ হয়ে, সকলের জন্য মরতে যে প্রস্তুত, তার জন্যও অন্যরা ততখানি সাড়া দেয়।
এ কারণে বন্দুক, পিস্তল, রড, লাঠি, প্রশাসন... এ সবের বাইরেও অনেক বড় একটা অস্ত্র আছে। যৌথতা। সামষ্টিক স্বার্থের নৈতিক বৈধতা যার ভিত্তি।