‘ইহযৌবন’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ
যেভাবে লেখা হলো ‘ইহযৌবন’
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৪
বাংলা একাডেমির সপ্তম তলার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় একটা প্রকাণ্ড শিরীষগাছ। দেখা যায় গাছটার ছড়ানো-ছিটানো ডাল। একটা সময় সেই বেলকনিতে এক-দেড় ঘণ্টা পর পর আমি সিগারেট খেতে যেতাম। সিগারেট ধরিয়েই তাকাতাম গাছটার দিকে। আর তখন টের পেতাম এক অদ্ভূৎ ঘ্রাণ। ঘ্রাণটা কিসের, ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। কখনো মনে হতো রোদের ঘ্রাণ, কখনো মনে হতে বৃষ্টির ঘ্রাণ, আর কখনো মনে হতো বৃষ্টিভেজা ও রৌদ্রতাপে শুকাতে থাকা কোনো ঝরাপাতার ঘ্রাণ। ঘ্রাণের সঙ্গে মনে পড়ে যেত শৈশব-কৈশোরের নানা স্মৃতি। চোখের সামনে ভেসে উঠত গ্রীষ্মের দুপুর, বর্ষার সকাল, শীতের সন্ধ্যা। এই ঘ্রাণের সঙ্গে কেন মনে পড়ে যেত শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি―এটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।
একদিন মনে হলো, আচ্ছা, এই ঘ্রাণ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়? আশ্চর্য দুঃসাহস! কোনো ঘ্রাণ নিয়ে কি উপন্যাস লেখা যায়! উপন্যাস লেখা এত সহজ! উপন্যাসের জন্য চাই ক্যানভাস। উপন্যাসের জন্য দরকার নানা চরিত্র, চরিত্রের নানা বিশ্লেষণ। মন বলল, মানুষের অসাধ্য কী আছে? দেখি না চেষ্টা করে। পরীক্ষা করে দেখি না কেন আমার কল্পনার দৌড় কতটুকু। অতঃপর পরীক্ষায় লেগে গেলাম। কোনো ক্ষীণস্রোতা নদীতে যদি একটা বাঁশ গেঁড়ে দেওয়া হয়, বাঁশটাতে প্রথমে আটকা পড়ে শ্যাওলা, লতাপাতা আর খড়কুটো। জঞ্জালের পরিমাণ ক্রমে বাড়তে থাকে। সেই জঞ্জালকে ঘিরে ধীরে ধীরে জমতে থাকে পলি। জমতে জমতে একটা সময় জেগে ওঠে ছোট্ট চর। সেই চর একটা সময় রূপ নেয় বিশাল চরে।
আমিও সেই ঘ্রাণের মাঝখানে গেঁড়ে দিলাম একটা খুঁটি। প্রথমে খুঁটিতে আটকা পড়ল একটা চরিত্র, যার নাম কুশল আদিত্য, যে মনে করে বিশ্বভ্রমণই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই সে জন্মেছে। তারপর আটকা পড়ল আরেকটি চরিত্র―মশর হুদা, যে হুট করে ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। এই দুজনকে নিয়েই কাহিনিটা এগোতে লাগল। লিখে ফেললাম দুটি অধ্যায়। আর তখন খেয়াল করলাম, কাহিনিটা ঢাকা শহরে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু আমি ঢাকার ক্যানভাসে এই উপন্যাস লিখতে চাই না, ক্যানভাস হবে ঢাকার বাইরে কোনো বিভাগীয় কিংবা জেলা শহর।
কী করা যায়? বিরতি নিলাম। উপন্যাসটার কাহিনিবৃত্ত থেকে বেরিয়ে গেলাম। উপন্যাস হয়ে না উঠলে, মনের মতো করে আখ্যানটাকে এগিয়ে নিতে না পারলে আমি এমনটাই করি। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে এই উপন্যাস। দিন যায়, কিন্তু নতুন করে শুরু করা হয়ে ওঠে না। একদিন লিখিত অধ্যায় অধ্যায় দুটি মুছে দিলাম কম্পিউটার থেকে। কারণ, একেবারে গোড়া থেকে শুরু করব উপন্যাসটি। আবারও দিন যায়, কিন্তু শুরু করাটা হয়ে ওঠে না। ভাবি, কেবলই ভাবি। ভাবতে ভাবতে একদিন লিখতে শুরু করলাম এইভাবে, ‘শ্রাবণের মেঘমেদুর এক দুপুরে অফিসের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই কুশল টের পেল কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। ভুবনপুরের আশপাশে কোথাও কামিনীগাছ নেই, কুশল কখনো দেখেনি। তবু কোথা থেকে আসছিল যুগপৎ স্নিগ্ধ , দিব্য, মনোহর ও স্মৃতিজাগানিয়া সেই ঘ্রাণ, সে বুঝে উঠতে পারছিল না।’
বুঝতে পারি, বাংলা একাডেমির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে টের পাওয়া সেই রোদের ঘ্রাণ কিংবা বৃষ্টির ঘ্রাণ কিংবা বৃষ্টিভেজা ও রৌদ্রতাপে শুকাতে থাকা কোনো ঝরা পাতার ঘ্রাণকে আমি কামিনী ফুলের ঘ্রাণের রূপ দিয়ে ফেলেছি। কামিনী ফুল কেন? জানি না। এই ফুল কিংবা এই ফুলের ঘ্রাণের সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই, কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ লেখায় এসে গেল। আমি বাদ দিলাম না। আর বুঝতে পারি, আমি যা চেয়েছিলাম, উপন্যাসের ক্যানভাসটাকে কোনো বিভাগীয় কিংবা জেলাশহরে সরিয়ে নিয়ে যেতে, সেটা পেরেছি। লেখা শুরু করতে পেরেছি সিলেট শহরের একটি ভবনের বেলকনি থেকে।
লেখা এগিয়ে নিয়ে যাই। একটু একটু করে লিখতে থাকি। লিখি কুশল আদিত্যের কথা। তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। স্নিগ্ধ, দিব্য ও মনোহর সেই ঘ্রাণ তাকে মনে করিয়ে দেয় চারুহাসিনী চম্পকবর্ণা হরিণলোচনা তরুণী মদিনার স্মৃতি, এক তুমুল ঝড়ের রাতে যার সঙ্গে সে মেতে উঠেছিল যৌবনের তুরীয় আনন্দে। সেই আনন্দ একদিন তার জীবনে ফিরে আসে নিদারুণ বিষাদ হয়ে। কামিনীর ঘ্রাণ কুশলকে তাড়াতে তাড়াতে নিয়ে যায় মধ্যযুগে রচিত এক কাহিনিকাব্যের কাছে, হুট করে ধনী হয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর মশকর হুদার কাছে, গুপ্ত এক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে, হিমঘরে রক্ষিত এক নারীর বেওয়ারিশ লাশের কাছে।
‘ইহযৌবন’ নামের এই বৃত্তান্তে ঢুকে পড়ে এয়াকুত মস্তান। সিলেটে হযরত শাহ জালালের দরগার গেটে নিরুপম আবাসিক হোটেলের ডানে দুই ভবনের মাঝে গলিতে তার বসবাস। চটের বস্তা বিছিয়ে থাকে। হাতে একটা ডুগডুগি নিয়ে উদাস বসে থাকে দিনমান। যেন কোনো ভাবুক। যেন ভ‚লোক, দ্যুলোক আর গোলকের সমস্ত ভাবনা তার মাথায়। আর মাঝেমধ্যে কাঁদে। নাকের জল চোখের জল একত্র করে কাঁদে। কেউ কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘একটা মার্বেলের জন্যি কান্দি। ছোটবেলায় হারায়া ফেলছিলাম, এখন কোথাও খুঁইজা পাই না।’ দরগায় ভয়াবহ বোমা হামলায় নিহত হয় এয়াকুত মস্তান। বহুদিন হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে থাকার পর দাফন করা হয় তার লাশ। কিন্তু পরদিন বৃষ্টিস্নাত ভোরে সে অক্ষত উঠে আসে কবর থেকে, কারু বাঙালি ছদ্মনাতে ঘুরে বেড়ায় নগরীর রাস্তাঘাটে।
লিখি উদয় হাসানের কথা, যাকে জ্যোৎস্নায় ডাকে, যে স্বপ্ন দেখে যুক্তবাংলা প্রতিষ্ঠার। লিখি হারিসের কথা, যে ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পেতে নৌকায় বসবাস করে। লিখি নাম-পরিচয় ভুলে যাওয়া এক ভয়ংকর খুনির কথা এবং কুয়াশার সফেদ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতে চাওয়া এক দুর্ধর্ষ চোরের কথা। এভাবেই এগুতে থাকে ইহযৌবন নামের এই উপন্যাস। ছয় মাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল উপন্যাসের প্রাথমিক খসড়া। তারপর তো সম্পাদনা, যা আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে করি, করতে থাকি। অনেক শব্দ বাদ দিই, অনেক শব্দ যোগ করি। প্রতিটি বাক্যকে মনের মতো করে সাজাই। কখনো কখনো দেখা যায় এই প্রসঙ্গটা বাদ পড়ে যাচ্ছে, নতুন একটা প্রসঙ্গ ঢুকছে।
আনন্দ বা বেদনার যে সময় আমরা পেছনে ফেলে আসি, তাকে বলি অতীত, তাকে বলি স্মৃতি। অতীত কি কখনো মানুষের পিছু ছাড়ে? ছাড়ে, আবার ছাড়েও না। কোনো কোনো অতীত তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। আবার কোনো কোনো অতীত মৃত্যুহীন নক্ষত্রের মতো সদা জাগরুক থাকে। তাকে ভোলা যায় না কোনোভাবেই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সে আসে মেঘের মতো ভেসে, কোকিলের কুহুতানের মতো ডেকে ওঠে। ‘ইহযৌবন’ মূলত অতীত ও বর্তমানের টানাপড়েনের কাহিনি।
এই আখ্যানে বলতে চেয়েছি, মানুষ ফেরেশতা নয়, শয়তানও নয়। মানুষ শুভ-অশুভের মিশ্রণে এক বিচিত্র ও জটিল প্রাণী। তার ভেতরে ফেরেশতা ও শয়তানের যৌথ বসবাস। এই উপন্যাসের আমি আমার কল্পনাশক্তির পরীক্ষা করতে চেয়েছি। কতটা সফল হয়েছি কিংবা কতটা ব্যর্থ, তা পাঠক বলবেন।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের জন্য নিরন্তর ভালোবাসা। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। বইমেলায় পাঠক সমাবেশের প্যাভিলিয়নে (২ নং) পাওয়া যাচ্ছে। দাম ৪৯৫ টাকা।
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪