যেখানে পথ নাই নাইরে
রফি হকপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৮
কোন খেলাটা খেলব কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই— রবীন্দ্রনাথ বেশ মজা করে ‘লেখা’র জায়গায় খেলা করেছেন। জীবন অ্যাকাউন্টেসির পরীক্ষা নয়। তবু কেউ কেউ ইক্যুয়েশন ব্যালেন্স করার ব্যর্থ চেষ্টা ফেষ্টা করে। গানটি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে— তা হলে তো আর ভাবনা নেই! প্রকৃতির পরম সত্য কিংবা অদৃশ্য কোনো শক্তির আপন খেলার সাথি হয়েছি জন্মের পর থেকেই! আকাশ থেকে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছি, ভেসে বেড়াচ্ছি আপন খেলায়।
কানে বাজছে ব্রক্ষ্মসংগীত— হৃদয় মাঝে হৃদয়নাথে কর দরশন; ঘুচিবে যন্ত্রণা, পাইবে স্বান্ত্বনা। গান আক্ষরিক অর্থে ধরার কিছু নাই। আমি যখনই ফ্লাইটের ভেতর আইল ধরে নিজের আসন খুঁজি তখনই রবীন্দ্রনাথের ‘আইলো হৃদয়নাথ আইলো’ গানটি সুরসহ মনে পড়ে। সুরটিই কানে ভাসে। বাস্তবে এইরকমের কঠিন টাইপের গান শুনেছি কীনা মনে পড়ে না। আসলেও রবীন্দ্রনাথের এমন গান আছে কীনা, তাও জানি না। এই যে কল্পনা করে এমনটা ভাবছি— এও তো একরকমের খেলাই।
যাদের দিন যায় দশটা পাঁচটা অফিস করে, বেবিফুড কিনতে, বিসিজি ট্রিপল অ্যান্টিজেন ও পোলিওর হিসেব রাখতে— তারা নিশ্চয়ই এভাবে ভাবে না! ডেবিট ক্রেডিট নিখুঁত ছন্দে মেলানোর অভ্যেস যাদের, তাদের জীবনের সবটাই কী মেলে? একদিন তারাও হয়তো দ্যাখে, ভুল কল্পনা, ভুল আবেগের ট্রেনে-বাসে-প্লেনে বা ভুল ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছে। কিন্তু গন্তব্যের ঠিকানা জানে না! কোন খেলাটা খেলব কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই— আহা, জীবনের সমুদয় ইক্যুয়েশনস ভোরের শিশিরে মতো মিথ্যে হয়ে যায়!
এই মিথ্যে হয়ে যাওয়াটাই বিমূর্ত বা অ্যাবস্ট্রাক্ট। বাস্তবের আছে বা ছিল থেকেই তো বিমূর্ততার আরম্ভ। কাল যে ঘটনাগুলো ঘটেছে আমার জীবনে— তা আজ নেই। আর ফিরে আসবে না। কাল যে বন্ধুটি ছিল, আজ সে নেই! আবছা মনে পড়বে বন্ধুটির অবয়ব, ধীরে ধীরে একদিন মিলিয়ে যাবে। এরচেয়ে অ্যাবস্ট্রাক্টশন আর কী হতে পারে? কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্টশনের ভিতর থেকে সত্য বের করে আনা শিল্পী ও কবিদের কাজ। শিল্পীরা অনেক আগে থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারে। মানুষকে পড়তে পারে অনায়াসে।
অনেকে শিল্পী কবিদেরকে বোকা ভাবে। হয়তো আক্ষরিকভাবে তাদের হিসেবে তারা বোকাই। কিন্তু প্রতিটি শিল্পী ও কবিই ঈশ্বরের খুব আপনারজন। একেকটা দিন একেকরকম লেখার খেলা। একেকটি গানের সুর, লয়। একেক ভাবনা, মগ্নতা। আবার কারো কাছে ওসব কিছুই না। কোনো কোনোদিন হঠাৎ মনে হয়, পূবে বাতাস ধেয়ে আসছে হঠাৎ। ধমকে থাকা ঝড় নেমে আসছে পাতায় পাতায়। পায়ের নিচে শক্ত মাটিতে প্রোথিত আমার শেকড়-বাকড়, আদিম পৃথিবীর প্রাণরস। বসুন্ধরার পঞ্জরতলে কম্পন জাগে শঙ্কার, বজ্রভীষণ গর্জনরব প্রলয়ের জয়ডঙ্কার।
এই তো আমি, আমার মানবজন্ম। মাথায় দুলে উঠছে সুর— যা না চাইবার, তাই আজি চাই গো। চেনাশোনার কোন্ বাইরে, যেখানে পথ নাই নাইরে...