ম্যাড সাইন্টিস্ট টেসলা

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : জুলাই ০৯, ২০১৯

আপনে ৯টা-৫টা অফিস করেন, অফিস শেষ হইলে গোয়ালঘরে ফিরা যান— এরপর টকশো, নিউজ বা ডেইলি সোপ দেখতে দেখতে ঘুম, আর সেই ঘুম ভাঙে কাঁটায় কাঁটায়। এই ছকবান্ধা জীবনে আপনে অনেক বিস্ময়কর জিনিস আর অদ্ভুত মানুষ দেখছেন। এক ঝলক দেখার পর আপনার মনে হইছে, সেগুলা আসলে কী বা সেই মানুষগুলিইবা কেমন! যা দেখছেন তা হেলুসিনেশন বলে চালায়ে দিতেছেন আর অদ্ভুত মানুষগুলাকে আপনি এক কাতারে নামায়ে রেখে বলতেছেন `এরা উন্মাদ`।

ধরেন, একজন মানুষ তার খাবারগুলারে একটা প্যাটার্নে সাজায়ে নিয়া একটা নির্দিষ্ট পরিমানে খায়, খাওয়ার আগে বিশেষ সংখ্যক ন্যাপকিন ইয়ুজ করে, হোটেলে থাকার জন্য এমন একটা রুম বাইছা নেয় যার নম্বর (রুম নম্বর) তিন দিয়া বিভাজ্য, রুমে ঢুইকা ঠিক গুইণা ১৮টা (তিন ইনটু ছয়) তোয়ালে চায়— এই লোকটারে দেইখা আপনি কী ভাববেন? ভাববেন এ মানুষটা Obsessive Compulsive Disorder এ ভুগতেছে?

আবার যখন দেখবেন এই মানুষটা কারো স্পর্শ এড়ায়ে চলতেছে, ভদ্রতার খাতিরে হ্যান্ডশেক করার পর মুহূর্তেই দৌড়ায়ে গিয়া হাত ধুয়ে নিতেছে. আপনি আরো নিশ্চিত যে, কিছু গড়বড় তো আছেই, তাই না? এমন একটা মানুষরে উন্মাদ ভাইবা এড়ায়ে যাবেন। কেউ কেউ আগায়ে আইসা জানতে চাইবেন, আগ্রহ দেখাইবেন। তারপর জানাবুঝা শেষ হইলে (আসলে না জাইনা-বুইঝা) উপহাস করতে থাকবেন। এমনি এক ছকে বাঁধা গোয়াল ঘরের মতো আজব পৃথিবীতে জন্ম নিছিলেন নিকোলা টেসলা। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের চাইতেও অগ্রগামী। তিনি যা দেখতে পাইতেন, আমরা সাধারন চর্মচক্ষুতে দেখি না। টেসলা তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়া হঠাৎ থামতেন, বিষাদে নিমজ্জিত হইতেন, কারন উনি জানতেন সেইটা ভাষায় বোঝানো যায় না— আর যদি যায়ও শ্রোতা তা বুইঝা নিতে অক্ষম।

টেসলা কিছুক্ষণ পরপর চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ দেখতেন। দেখতেন আঙুলে বিদ্যুতের ঝলক, ঠিকরাইয়া পড়া আলো। তিনি এ বিশ্বে ব্যাপ্ত শক্তিগুলিরে একসাথে অনুভব করতে শিখছিলেন পালাক্রমে। তার কাছে, Universe: Sea of energy vibrating at different frequencies. তিনি এও দাবি করতেন যে, ভিনগ্রহবাসীদের থেকে তিনি ম্যাসেজও পান। এগুলা যে শুধুমাত্র হেলুসিনেশন টার্মটা ব্যবহার কইরা উড়ায়ে দেয়ার বিষয় না, সেইটাও তিনি প্রমাণ করছিলেন একদিন।

হ্যাঁ উনি টেসলা, উনি আপনার চোখে উন্মাদ, কিন্তু উনার বদৌলতে আপনারা আজকে রিমোট কন্ট্রোলারে পরিচালিত প্রযুক্তি পাইছেন, অল্টারনেটিং কারেন্টের (A.C) সাপ্লাই সিস্টেম কেমনে হয় তার সুবিধাও নিতে পারছেন, রাডারের বেইজ নকশা পাইছেন, ফ্লুরোসেন্ট বাত্তি চোখে দেখছেন। ভাবলে অবাক লাগে যে, তিনি মার্কনির দশ বছর আগে রেডিও সিগন্যাল ও শব্দ নিয়া সফল গবেষণা করছেন। আর বিদ্যুৎ ও পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়া কী করছেন তা আপনে ভাবতেও পারবেন না।

টেসলারে চিনতে পারেন নাই, নামও শুনেন নাই যারা— তার যদি নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যান, সেইখানে হয়তো তাঁর ঝুঁইকা থাকা ভাস্কর্য দেখতে পাবেন। হুম ইনিই নিকোলাই টেসলা, নায়াগ্রা ফলস-এ উনিই হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাইছিলেন।

নিকোলা টেসলারে যারা অল্পবিস্তর জানেন, তারা সচরাচর এডিসন ও টেসলারে নিয়া বিতর্কে জড়ায়া পড়েন। আমি সেই বিতর্কের মধ্যে নাই। টেসলা কতটুকু দুর্ভাগা বা এই জগতের মানুষ প্রজ্ঞা পরখে অক্ষম কী না সে নিয়াও আমার এই আলোচনা না। তারপরেও প্রসঙ্গক্রমে মার্কনির রেডিওর কথা বলতেই হয়। মার্কনির রেডিও কেবল সিগনাল ট্রান্সমিট করতে পারতো, অথচ এরও দশ বছর আগে টেসলা রেডিও নিয়া যে সফল গবেষণা করছিলেন, তাতে সিগনাল ও শব্দ দুইটাই সম্প্রচার কইরা দেখান। ১৯৪৩ সালে হাইকোর্ট রেডিও নিয়া মার্কনির প্যাটেন্ট অবৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু আমরা রেডিওর প্রসঙ্গ আসলেই মার্কনিরেই অবদানের চূড়ান্ত ফুলমাল্য অর্পণ করি... কেন করি কে জানে!

টেসলা তড়িৎ-পদার্থবিদ্যা নিয়া ব্যাপক গবেষণা করছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, পৃথিবীর সকলেই অনায়াসে বিনামূল্যে `শক্তি`র ব্যবহার করবে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৮৯০ সালে wardonclyffe নামের বিশাল এক টাওয়ার স্থাপন করতে চাইছিলেন। এই টাওয়ার থেকে ছড়ায়ে যাইতে পারতো টেলিফোন ও টেলিগ্রাফি সিগনাল— এটার থেকে সম্প্রচারিত হইতে পারতো স্টকমার্কেট ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস... বিশ্বব্যাপী। এই টাওয়ার দিয়া সারা বিশ্বে বিনামূল্যে শক্তির ব্যবহার ছড়ায়ে পড়তো। এই প্রজেক্টটার সম্ভাবনার কথা ভাইবা জেপি মর্গান প্রথমে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার অনুদান দিছিলেন টেসলারে। কিন্তু মর্গান সাহেব যখন দেখলেন, এতে কইরা এনার্জির ব্যবহার হইবো সুলভে ও বিনামূল্যে— তখনই অনুদান বন্ধ কইরা দিলেন।

টেসলা ভাবতেন, চারপাশে এত শক্তি ছড়ায়ে ছিটায়ে থাকতে আমরা কেন বিদ্যুৎ তৈরি তেল, কয়লা, গ্যাস ব্যবহার করবো? এ নিয়া তাঁর গবেষণাও ছিল প্রচুর। তিনি ২৫ মাইলের মধ্যে বৈদ্যুতিক তার ছাড়াই বিশটা বাতি জ্বালায়া সবাইরে অবাক কইরা দিছিলেন। কিন্তু সমাজের সুবিধাবাদী ক্ষমতাধর যারা, তারা প্রতিনিয়ত এইসকল গবেষণার পথে বাধা হয়া দাঁড়ায়া থাকে... সব যুগে-সব কালে, এইটা কারো অজানা না।

যাই হোক, টেসলা কিন্তু একটা অদ্ভুত তড়িতায়িত জীবন নিয়া আসছিলেন, যদিও সবাই তারে দুর্ভাগাই ভাবে। এই পৃথিবী থিকা টেসলা হয়তো কারো ভালোবাসা কিংবা গভীর আবেগের স্পর্শ নিয়া যাইতে পারেন নাই, তাঁর জন্য ভালোবাসার চিহ্ন মানে বুকপকেটে রাখা এক ফরাসি চিত্রনায়িকার সুগন্ধি রেশমি রুমাল আর একটা সাদা পায়রা। বিকেলের সূর্য ঢইলা পড়লে আমি ছাদে গিয়া পায়রার ঝাঁকে এমনি একটা পায়রা দেখতে পাই... বিষণ্ণ সাদা একটা শরীর, গলা ও ডানায় কয়েকটা সবুজ ছিটা। কতকাল পরে আমি একজন (হয়তো আরো আছে কেউ) তাঁর জন্য মমতা নিয়া আকাশে তাকাই... চারপাশে হাজারো শক্তিকণা অনুভব করি, বিদ্যুতের ঝলকানিও!

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী