মোহিতলাল মজুমদারের দুটি কবিতা
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০২০
কবি মোহিতলাল মজুমদারের আজ জন্মদিন। ১৮৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর চব্বিশ পরগণা জেলায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি কিছুদিন কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত দুটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
কালবৈশাখী
মধ্যদিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করিল কে!
ধরণীর `পরে বিরাট ছায়ার ছত্র ধরিল কে!
কানন-আনন পাণ্ডুর করি
জলস্থলের নিশ্বাস হরি
আলয়ে-কুলায়ে তন্দ্রা ভুলায়ে গগন ভরিল কে!
আজিকে যতেক বনস্পতির ভাগ্য দেখি যে মন্দ
নিমেষ গনিছে তাই কি তাহারা সারি সারি নিস্পন্দ?
মরুৎ-পাথারে বারুদের ঘ্রাণ
এখনি ব্যাকুলি তুলিয়াছে প্রাণ?
পশিয়াছে কানে দূর গগনের বজ্রঘোষণ ছন্দ?
হেরি যে হোথায় আকাশটা হে ধূম্র মেঘের ঘটা,
সে যেন কাহার বিরাট মুণ্ডে ভীমকুন্তল জটা!
অথবা ও কিরে সচল অচল
ভেদিয়া কোন্ সে অসীম অতল
ধাইছে উধাও গ্রাসিতে মিহিরে, ছিড়িয়া রশ্মিছটা!
ওই শোনো তার ঘোর নির্ঘোষ, দুলিয়া উঠিল জটাভার
শুরু হয়ে গেছে গুরুগুরু রব নাসা গর্জন ঝঞ্ঝার।
পিঙ্গল হল গল তলদেশ,
ধূলি ধূসরিত উন্মাদ বেশ
দিবসের ভাগে টানিয়া খুলিছে বেণিবন্ধন সন্ধ্যার।ৎ
অঙ্কুশ কার ঝলসিয়া ওঠে দিক হতে দিক-অন্তে!
দিগ্ বারণেরা বেদনা-অধীর বিদারিছে নভ দন্তে।
বাজে ঘন ঘন রণ দুন্দুভি,
ঝরে সে আওয়াজ কভু যায় ডুবি,
যুঝিতেছে কোন্ দুই মহাবল দ্যুলোকের দূর পন্থা!
বঙ্কিম-নীল অসির ফলকে দেহ হল কার ভিন্ন?
অনাবৃষ্টির অসুরের বাধা কে করিল নিশ্চিহ্ন?
নেমে আসে যেন বাঁধভাঙা জল,
ম্লান হয়ে আসে মেঘকজ্জল,
আলোকের মুখে কালো যবনিকা এতখনে হল ছিন্ন।
হেরো, ফিরে চলে সে রণবাহিনী বাজায়ে বিজয়শঙ্খ,
আকাশের নীল নির্মল হল ধৌত ধরার পঙ্ক।
বায়ু বহে পুন মৃদু উচ্ছ্বাসে
নদী উথলিছে কুলুকুলু ভাষে,
আলো-ঝলমল বিটপীর দল নিশ্বাসে নিঃশঙ্ক।
নববর্ষের পুণ্য বাসরের কালবৈশাখী আসে।
হোক সে ভীষণ, ভয় ভুলে যাই অদ্ভুত উল্লাসে।
ঝড়-বিদ্যুৎ বজ্রের ধ্বনি
দুয়ার জানালা ওঠে ঝনঝনি
আকাশ ভাঙিয়া পড়ে বুঝি, তবু প্রাণ ভরে আশ্বাসে।
চৈত্রের চিতাভস্ম উড়ায়ে জুড়াইয়া জ্বালা পৃথ্বীর,
তৃণ-অঙ্কুরে সঞ্চারি রস, মধু ভরি বুকে মৃত্তির,
সে আসিছে আজ কাল-বৈশাখে
শুনি টংকার তাহার পিনাকে
চমকিয়া উঠি, তবু জয় জয় তার সেই শুভ কীর্তির।
এত যে ভীষণ, তবু তারে হেরি ধরায় ধরে না হর্ষ
ওরি মাঝে আছে কাল-পুরুষের সুগভীর পরামর্শ।
নীল-অঞ্জন-গিরি-নিভ কায়া,
নিশীথ নীরব ঘনঘোর ছায়া
ওরি মাঝে আছে নববিধানের আশ্বাস দুর্ধর্ষ।
ফুটফুটে জোছনায়
ফুটফুটে জোছনায় জেগে শুনি বিছানায়
বনে কারা গান গায় ঝিমিঝিমি ঝুমঝুম।
চাও কেন পিটিপিটি, উঠে পড়ো লক্ষ্মীটি!
চাঁদ চায় মিটিমিটি, বনভূমি নিঝ্ঝুম।
ফাল্গুনে বনে বনে, পরীরা যে ফুল বোনে
চলে এসো ভাইবোনে, চোখ কেন ঘুমঘুম?